পৃথিবীর উন্নত-অনুন্নত রাষ্ট্রের প্রধান অর্থনৈতিক চালিকাশক্তি প্রবাসীদের উপার্জিত আয় রেমিট্যান্স। বিশ্বে দক্ষ জনশক্তির শ্রমের মূল্য অনেক বেশি এবং জনসংখ্যার ৩.৪ শতাংশ অভিবাসী। তাদের উপার্জিত অর্থ সমগ্র বিশ্বের জিডিপিতে ৯.৪ শতাংশ অবদান রাখছে।
১২৫টি দেশের শ্রমিকেরা ৪০টির মতো উন্নত রাষ্ট্রে শ্রমের বিনিময়ে রেমিট্যান্স পাঠায়। ভারত ২০০৮ সাল থেকে রেমিট্যান্স উপার্জনে প্রথম। ভারতীয়রা ইংরেজিসহ বিভিন্ন ভাষা ও কারিগরি শিক্ষায় অনেক এগিয়ে। তারা জিডিপিতে ২.৯ শতাংশ অবদান রাখছেন।
ঐতিহাসিকভাবে স্বীকৃত যে, বাংলাদেশের মানুষ খুবই পরিশ্রমী। কিন্তু ভাষাগত জটিলতা ও কারিগরি শিক্ষায় অনেক পিছিয়ে। প্রবাসীদের সমস্যার সমাধান, দক্ষ জনশক্তি রপ্তানি এবং হুন্ডি ব্যবসা প্রতিরোধ করা গেলে রেমিট্যান্সেই বদলে দেবে বাংলাদেশ।
প্রবাসীরা বাংলাদেশের অমূল্য সম্পদ। তাদের শ্রম, দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথ প্রদর্শক। রেমিট্যান্স এ দেশের আর্থসামাজিক বিকাশে অনুঘটক। দেশের জিডিপিতে প্রবাসীদের অর্জিত রেমিট্যান্সের অবদান ৬ শতাংশের বেশি। ২০০৮ সালে বিশ্বমন্দা ও করোনাকালীন বাংলাদেশকে সংকটমুক্ত রাখতে রেমিট্যান্সের ভূমিকা ছিল উল্লেখযোগ্য। অর্থনৈতিক উন্নয়নে অনেক দেশের আদর্শ বাংলাদেশ। অর্থনৈতিক ভারসাম্য রক্ষায় মূল চালিকাশক্তি রেমিট্যান্স ও রপ্তানি আয়। রপ্তানি আয় যখন কমে যায়, তখন রেমিট্যান্স তা পূরণ করে দেয়।
প্রবাসীদের সংখ্যা নিয়ে অনেক গরমিল দেখা যাচ্ছে। বিএমইটির মতে, প্রবাসী ১ কোটি ৪৮ লাখ, বিবিএস খানা জরিপে (২০২২) ৫৫ লাখ ৫৩ হাজার। কিন্তু আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর তথ্যমতে, প্রবাসীর সংখ্যা ২ কোটিরও বেশি। ১৯৭০ সালে এই ভূখণ্ডের প্রবাসী সংখ্যা ছিল ৮৪ মিলিয়ন। ২০২২-২৩ সালে ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার। ২০০৮-২২ সাল পর্যন্ত ৮০ লাখেরও বেশি লোক মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপ-আমেরিকা গেছে। কর্মসংস্থান ও জনশক্তি মন্ত্রণালয়ের মতে, প্রতি বছর ৮ লাখ লোক শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে।
চলতি বছর ৬০ লাখ দক্ষ জনশক্তি বিদেশে পাঠানো হবে বলে সংসদে জানিয়েছেন, প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী এমপি।
বিশ্বে প্রবাসী আয় প্রাপ্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান সপ্তম এবং দক্ষিণ এশিয়ায় তৃতীয়। চলতি বছর প্রবাসে যাওয়া ৩ লাখ ৮ হাজার কর্মীর মধ্যে নার্স, চিকিত্সক, আইটি বিশেষজ্ঞ ছিলেন ৫০ হাজার ১৫৮ জন। ২০২৩ সালে ড্রাইভার, ইলেকট্রিশিয়ান, পাইপ ফিটিং, পেইন্টার, জিপসন, হোটেল শ্রমিকসহ গেছেন ৩ হাজার ৬৪০ জন। রেমিট্যান্স প্রাপ্তিতে শীর্ষ ১০টি দেশের মধ্যে ছয়টি দেশই মধ্যপ্রাচ্যের। সৌদি আরব, আরব আমিরাত থেকে রেমিট্যান্স আসে বেশি। ওমান, কুয়েত, জর্ডান, কাতার, বাহরাইনও আছে উল্লেখ্যযোগ্য অবস্থানে।
রেমিট্যান্স পাঠানোয় ঢাকা প্রথম, চট্টগ্রাম দ্বিতীয় এবং তৃতীয় অবস্থানে সিলেট বিভাগ। সিলেট বিভাগের রেমিট্যান্স ব্যয় হয় ভোগবিলাস ও বড় বড় অট্টালিকা নির্মাণে। বিশ্বব্যাংক বলেছে, চলতি বছর প্রবাসী আয় হবে, ৮৬ হাজার কোটি টাকা।
গত ১৯ এপ্রিল ইতালির মনকালকোন শহরের জাহাজ নির্মাণশ্রমিকেরা ২৯০ কোটি টাকা পাঠিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। গত ১১ এপ্রিল জাতীয় একটি দৈনিকের শিরোনাম ছিল ‘মাত্র পাঁচ দিনে এলো প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা রেমিট্যান্স’। ২০১৬-২০২২ সালে বাংলাদেশের রেমিট্যান্স আসে ১২ হাজার ৬১২ কোটি টাকা।
কাগজে-কলমে প্রবাসীরা অর্থনীতির মেরুদণ্ড বলা হলেও তাদের বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করা যাচ্ছে না। দেশে প্রবাসীদের অর্থ দিয়ে কেনা জায়গা-জমি, বাসাবাড়ি, দালান, দোকান, প্লট দখল করেন আপনজন, এমনকি কেয়ারটেকারও। ব্যাংকের জমানো টাকা নিয়ে স্ত্রী উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনাও অনেক। প্রবাসীরা পাসপোর্ট তৈরি, নবায়ন, জন্ম সনদ, জাতীয় পরিচয়পত্র তৈরিতে চরম হয়রানির শিকার হন।
দীর্ঘদিন ঘুরে সংশোধন করতে না পেরে বড় অঙ্কের ঘুষ দিয়ে কাজ করাতে হয়। দেশের জেলা-উপজেলার নির্বাচন অফিসের ঘুষ বাণিজ্য এখন ওপেন সিক্রেট। ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের মতে, ২০২২ সালে ৮০ হাজার ৮১১ জন নারী-পুরুষ খালি হাতে দেশে ফিরে এসেছেন। অসাধু ট্র্যাভেলস এজেন্সি তাদের জাল কাগজপত্র দিয়ে পাঠিয়েছিল।
এশিয়ার সবচেয়ে বড় ও উন্নত দেশ সৌদি আরবে ১৯৭৬ সাল থেকে জনশক্তি রপ্তানি করা হচ্ছে। সে দেশে বর্তমানে বাংলাদেশি ২৮ লাখ শ্রমিক কর্মরত আছেন। গত ফেব্রুয়ারি মাসে সৌদি আরবে গিয়ে বাংলাদেশি অনেক প্রবাসীর সঙ্গে কথা হয়। সিলেটের ওসমানীনগরের বুরুঙ্গা এলাকার সামছুল ইসলাম জানালেন, সৌদি আরবে দুই-তিন বছর পর চুক্তি মোতাবেক আকামা নবায়ন করার কথা থাকলেও মালিকপক্ষ ছয় মাস পর নবায়নের তাগিদ দিয়ে দুই-তিন বছরের অর্থ আদায় করে নেয়।
অর্থ প্রদানে ব্যর্থ হলে দক্ষ শ্রমিকেরাও অবৈধ হয়ে যান। কাজ করে বেতন না পাওয়ার ঘটনা অহরহ। তিনি জানান, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে এমন অবস্থা।
গত দুই যুগ ধরে ইউরোপ, আমেরিকার দেশগুলোতে হাজার হাজার শিক্ষিত তরুণ পাড়ি জমিয়েছেন। জলপথে অনেকের করুণ মৃত্যুও হয়েছে। একসময়ের দারিদ্র্যপীড়িত এ দেশের লোক ছিল বিশ্বে অবহেলিত। বর্তমানে বাংলাদেশের সুনাম ও মর্যাদা অনেক বেশি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের সরকার আমাদের শ্রমিকদের অনেক গুরুত্বসহকারে বসবাসের সুযোগ দিলেও আমাদের বাংলাদেশের মিশনগুলোর কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিপদগ্রস্ত মানুষের খোঁজ-খবর নেন না।
এ ধরনের অভিযোগ মধ্যপ্রাচ্চ্য ও ইউরোপের দেশে অবস্থানকারী প্রবাসীদের। সম্প্রতি কানাডায় সপরিবারের যাওয়ার হিড়িক পড়েছে। ফ্রান্স আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক দিলোয়ার হোসেন কয়েছ বলেন, ‘প্রতিদিন বাংলাদেশ থেকে আসা অনেক লোককে সহায়তা এবং কাজের ব্যবস্থা করে দিয়ে থাকেন।
কিন্তু যাদের কারিগরি শিক্ষা মোটেই জানা নেই, তাদের নিয়ে সমস্যায় পড়ে যাই। অনেক সময় তাদের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করতে কষ্ট হয়। প্রবাসে একজন ইলেকট্রিশিয়ান যে পরিমাণ আয় করতে পারেন, পাঁচ জন অদক্ষ শ্রমিক তা করতে পারেন না।’ সুতরাং কারিগরি প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রবাসে আসার অনুরোধ জানান তিনি।
২০০৯ সাল পর্যন্ত কারিগরি শিক্ষায় এ দেশে ১ শতাংশের কমও লোক ছিল। ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ২০ শতাংশ এবং ২০৪১ সালে ৫০ শতাংশ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। সিলেট জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের উদ্যোগে গত ৪ এপ্রিল বিশ্বনাথ উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে ‘দক্ষ জনশক্তি রেমিট্যান্স বৃদ্ধি করে’ শিরোনামে এক কর্মশালার আয়োজন করা হয়।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহিনা আক্তারের সভাপতিত্বে কর্মশালায় প্রধান অতিথি প্রবাসী কলাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, ‘প্রবাসীরা এ দেশের উন্নয়নের চাবিকাঠি। যারা বিদেশে যেতে আগ্রহী, তারা যেন কারিগরি শিক্ষায় দক্ষতা অর্জন করেন।
অনুষ্ঠানে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন সিলেট জেলা কর্মসংস্থান ও জনশক্তি অফিসের সহকারী পরিচালক মখলিসুর রহমান। এই নিবন্ধনের লেখক, প্রবাসীদের সমস্যা ও সম্ভাবনার চিত্র তুলে ধরে প্রবাসীদের সমস্যা সমাধানে মন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। লিয়াকত আলী নামের একজন প্রবাসী জানালেন, তিনি ওমান ও কুয়েতে ১০ বছর ছিলেন। ছয় মাসের মধ্যে ভিসা নবায়নে বড় অঙ্কের টাকা না দেওয়ায় মালিক তাকে দেশে পাঠিয়ে দেন।
বিশ্বের ১৬৮টি দেশে জনশক্তি রপ্তানি হলেও ২৬টি দেশে বাংলাদেশ মিশনে শ্রমকল্যাণ উইং আছে ২৯টি। এসব উইংয়ে জনবলেরও সংকট রয়েছে। প্রবাসীদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও অধিকার আদায় করে উইং।
আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়ায় ৩৫ লাখের বেশি প্রবাসী আছেন, যাদের মধ্যে প্রায় ৪ হাজার প্রবাসী ১০ কোটি টাকা করে দেশে বিনিয়োগ করতে পারেন। এ ব্যাপারে প্রবাসীদের উত্সাহ, উদ্দীপনা ও নিরাপত্তার বিষয়টি মিশনগুলো বিবেচনা করতে পারে। সর্বাবস্থায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোয় প্রবাসীদের উত্সাহিত করতে প্রচার-প্রচারণা, হুন্ডি ব্যবসায়ী ও প্রতারক ট্র্যাভেলস, এজেন্সিদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে রেমিট্যান্সের জোয়ারে উন্নয়নে অনেক দূর এগিয়ে যাবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্বাধীনতা অর্জনকারী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ও বিরল সম্মানে ভূষিত করেছেন। দেশ ও জাতির কল্যাণে প্রবাসীদের সব সমস্যার সমাধানে উদ্যোগ গ্রহণ, হুন্ডি ব্যবসা বন্ধ এবং দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ একান্ত জরুরি।
আপনার মতামত জানানঃ