এখন থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি ১৩০০ বছরের প্রাচীন খিলাফতের সমাপ্তি ঘোষণা করেছিল। খিলাফতের এই অবসান আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এক ঘটনা। আমরা যে তুরস্কের কথা আলোচনা করছি, সেই তুরস্ক এখন সাড়ে আট কোটি জনসংখ্যার দেশ এবং বিশ্বের ১৯তম বৃহত্তম অর্থনীতি।
তবে খিলাফতের পতন শুধু তুরস্কের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, এমন ভাবার অবকাশ নেই। ইসলামের যে রাজনৈতিক ইতিহাস তার বাঁকবদলেরও সাক্ষ্য দেয় এই পতন। প্রায় ৬০০ বছর ধরে যে অটোমান সাম্রাজ্য ইউরোপ, আফ্রিকা এবং মধ্যপ্রাচ্যে বিকাশ ও বিস্তার লাভ করেছিল, নানাভাবে সেখানকার জনজীবনকে প্রভাবিত করেছিল, সেই সাম্রাজ্যের চিরসমাপ্তি ঘটে ১৯২৪ সালে।
এই ফাঁকে বলে রাখি, খিলাফত কী? খিলাফত একটি ইসলামিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। আরও পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে, মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর ইন্তেকালের পর মুসলিম উম্মাহর নেতৃত্বদানকারী প্রতিষ্ঠান বলতে খিলাফতকেই বোঝানো হয়।
এ নিয়ে বিতর্কের কোনো অবকাশ নেই যে একটা সময় প্রতিদ্বন্দ্বী একাধিক মুসলিম শাসক নিজেকে খলিফা বলে দাবি করেছেন।
ইতিহাসে বেশ কিছু খিলাফতের উল্লেখ পাই আমরা। যেমন নবম শতাব্দীর আব্বাসীয় খিলাফত, যে খিলাফত ইরান, ইরাক ও আফগানিস্তানজুড়ে আরব উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রাধান্য বিস্তার করেছিল। পরের দশকে তারা গিয়ে পৌঁছায় তিউনিসিয়া পর্যন্ত। এর বাইরেও ১৩ শতাব্দী থেকে পরবর্তী বেশ কিছু বছর মিসরকে কেন্দ্র করে আরও কয়েকটি খিলাফতের উত্থান ঘটে।
হাউস অব ওসমান তথা তৎকালীন অটোমান বংশ ১৫১২ সালে প্রথম খিলাফতের দাবি নিয়ে হাজির হয়। পরবর্তী দশকগুলোয় আব্বাসীয় খিলাফতের শাসনাধীনে থাকা ইসলামের পবিত্র নগরী মক্কা, মদিনা ও বাগদাদে সাম্রাজ্য বিস্তার করে তারা তাদের এই দাবিকে আরও জোরালো করে তোলে। সময়টা তখন ১৫৩৪ সাল।
উনিশ শতকের আগে অটোমানরা খিলাফতের ব্যাপারে উদাসীন ছিলেন, এমন দাবিকে চ্যালেঞ্জ করেছেন ইতিহাসবিদেরা।
গবেষণা বলছে, ষোড়শ শতকে, অটোমান সাম্রাজ্যের ঘনিষ্ঠ সুফি সাধকেরা নতুন করে খিলাফতের ধারণা চর্চা শুরু করেন। তাঁরা বলতে শুরু করেন যে, খলিফা একজন রহস্যময় ব্যক্তিত্ব। তাঁকে স্রষ্টা স্বয়ং নিয়োগ দিয়েছেন। তিনিই তাঁর প্রজাদের ওপর পার্থিব ও আধ্যাত্মিক কর্তৃত্বের অধিকারী। কালক্রমে আদালতও খলিফাকে (সুলতান) দুনিয়ায় স্রষ্টার প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থাপন করতে শুরু করে।
অটোমান খিলাফত নিয়ে সাম্রাজ্যের ইতিহাসে নানামাত্রিক আলোচনা হয়েছে। হবে না–ইবা কেন? এই খিলাফত ১৫১২ সাল থেকে ১৯২৪ সাল পর্যন্ত মোট ৪১২ বছর স্থায়িত্ব পেয়েছিল।
সুলতান দ্বিতীয় আব্দুলহামিদের ক্ষমতা থেকে উৎখাতের চিত্রকর্ম। সেটি আঁকেন আরেক সুলতান আব্দুলমেসিদ।
১৮৬৮ সালে জন্মগ্রহণকারী যুবরাজ আবদুলমেসিদ প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পর থেকে কঠোর নজরদারি ও বন্দিত্বের ঘেরাটোপে থেকেছেন। যুবরাজের ওপর এই বিধিনিষেধ জারি করেছিলেন তৎকালীন সুলতান দ্বিতীয় আবদুলহামিদ।
১৯০৯ সালে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আবদুলহামিদকে উৎখাত করা হয়। সেই সঙ্গে প্রবর্তন করা হয় সাংবিধানিক খিলাফত। চিত্রশিল্পী, কবি ও উচ্চাঙ্গসংগীতের একনিষ্ঠ সমঝদার আবদুলমেসিদ এ সময় একজন জনব্যক্তিত্ব হিসেবে আবির্ভূত হন। তিনি নিজের পরিচয় দিতেন গণতান্ত্রিক যুবরাজ হিসেবে। তিনি শুধু আবদুলহামিদকে উৎখাতের ছবিই আঁকেননি, যাঁরা তাঁকে উৎখাত করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে ছবিও তুলেছিলেন।
কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধে (১৯১৪–১৯১৮) অটোমান সেনাবাহিনীর পরাজয় যুবরাজকে বিষণ্ন করে তুলেছিল। ইস্তাম্বুলসহ অটোমানদের সাম্রাজ্যভুক্ত অঞ্চলে মিত্রবাহিনীর দখলদারি তাঁকে আরও বেশি হতাশ করে তুলেছিল।
আবদুলহামিদের ভাই মেহমেত ভাহিদেদ্দিন তখন সুলতান–খলিফা। আবদুলমেসিদ ক্রাউন প্রিন্স। সে হিসেবে তিনিই সিংহাসনের উত্তরসূরি। কিন্তু ১৯১৯ সালে ভাহিদেদ্দিন আনাতোলিয়ায় মিত্রবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধে মুস্তাফা কামাল পাশাকে সমর্থন দিতে অস্বীকৃতি জানান। মুস্তাফা সে সময় উদীয়মান জাতীয়তাবাদী নেতা।
জাতীয়তাবাদীরা ১৯২০ সালের ২৩ এপ্রিল আঙ্কারায় গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি প্রতিষ্ঠা করলেন। নতুন একটি রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় সে–ই প্রথম ধাপ। পরের বছর মুস্তাফা কামাল আবদুলমেসিদকে আনাতোলিয়ায় জাতীয়তাবাদী সংগ্রামে যুক্ত হওয়ার আমন্ত্রণ জানান।
কিন্তু ইস্তাম্বুলের যে ডলমাবাচে প্রাসাদে যুবরাজ বসবাস করতেন, সেটি ব্রিটিশরা ঘেরাও করে রেখেছিল। আবদুলমেসিদের পক্ষে সে সময় মুস্তাফা কামাল পাশার আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা ছাড়া আর কোনো উপায় ছিল না। মুস্তাফার অনুসারীরা এই প্রত্যাখ্যানকে অপমান বলে ধরে নিয়েছিল। জনমত যখন খিলাফতের বিরুদ্ধে চলে যায়, তখন তারা আবারও এই প্রসঙ্গ তোলেন।
১৯২২ সালের অক্টোবরে জাতীয়তাবাদীদের জয়ে একটি আধুনিক তুরস্ক গঠনের সুযোগ তৈরি হলো। সুলতান ভাহিদেদ্দিনকে তুরস্কের সিংহভাগ মানুষ পছন্দ করত না। ফলে দ্রুতই সালতানাতের অবসান ঘোষণা করা হলো। আনুষ্ঠানিকভাবে ১ নভেম্বর ধসে পড়তে শুরু করল অটোমানদের সাম্রাজ্য।
ভাহিদেদ্দিন ১৭ নভেম্বর ব্রিটিশ যুদ্ধজাহাজে করে খুবই দীনহীনবেশে ইস্তাম্বুল ছাড়লেন। খুবই অমর্যাদাকর প্রস্থান ছিল তাঁর। ভাহিদেদ্দিনের অনুপস্থিতিতে সরকার তাঁকে খিলাফত থেকে অপসারণের ঘোষণা দেয়। তাঁর পরিবর্তে তাঁরা আবদুলমেসিদকে খলিফা হিসেবে বসানোর সিদ্ধান্ত নেয়। আবদুলমেসিদও খুশি মনে এই প্রস্তাব মেনে নেন এবং ২৪ নভেম্বর, ১৯২২ সালে খলিফা হিসেবে আনুষ্ঠানিক দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
প্রথমবারের মতো অটোমান যুবরাজ খলিফা হলেন, তিনি কিন্তু সুলতান নন। আর তাঁকে খলিফা হিসেবে নিযুক্ত করল গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি।
দ্বিতীয় আব্দুল হামিদ এবং তাঁর মেয়ে ফ্রান্সের রাস্তায় হাঁটছেন। খেলাফতের পতনের পর সপরিবারে বিদেশে নির্বাসিত হন তিনি।
খুব দ্রুতই দুই পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব সংঘাত শুরু হয়ে গেল। খলিফা নিযুক্ত হলেও আবদুলমেসিদের রাজনৈতিক বক্তব্য দেওয়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছিল অ্যাসেম্বলি। এর পরিবর্তে, আঙ্কারায় সরকার ইসলামের নতুন একটা পথনির্দেশিকা উপস্থাপন করে। এতে খলিফা একটি আনুষ্ঠানিক পদ বৈ অন্যকিছু নয়। কিন্তু পরে তাঁর নাতনি রাজকুমারী নেসলিশাহ লেখেন যে এই নির্দেশনা মেনে চলার কোনো অভিপ্রায় আবদুলমেসিদের ছিল না।’
দ্য নিউইয়র্ক টাইমস ১৯২৩ সালের এপ্রিলে লিখেছিল, খলিফা একজন চিত্রকর। তিনি আর কারও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থে বাধা হয়ে দাঁড়াবেন বলে মনে হয় না।
কিন্তু তুরস্কের পরিস্থিতি ছিল অন্যরকম। প্রতি শুক্রবার ইস্তাম্বুলের বিভিন্ন মসজিদে আবদুলমেসিদ বিপুলসংখ্যক ভক্ত অনুসারীদের নিয়ে নামাজ পড়তে যেতেন। গণমানুষের এই ভালোবাসা ও জাঁকজমক আঙ্কারার জন্য অস্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একবার তো তিনি ১৪ বৈঠার নৌযানে করে বসফরাস পাড়ি দিয়ে একটি মসজিদে উৎসাহ–উদ্দীপনার সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন। মসজিদ প্রাঙ্গণও সাজানো হয়েছিল নানা চিত্রকর্ম ও ফুলে। একজন খলিফাকে স্বাগত জানাতে যা যা করা সমীচীন, তা–ই করেছিলেন তিনি।
একবার তো তিনি ১৪ বৈঠার নৌযানে করে বসফরাস পাড়ি দিয়ে একটি মসজিদে উৎসাহ–উদ্দীপনার সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন। মসজিদ প্রাঙ্গণও সাজানো হয়েছিল নানা চিত্রকর্ম ও ফুলে। একজন খলিফাকে স্বাগত জানাতে যা যা করা সমীচীন, তা–ই করেছিলেন তিনি।
আবদুলমেসিদ পুতুল খলিফা হয়ে থাকতে রাজি ছিলেন না। তিনি ভোজসভার আয়োজন করতেন। ‘খালিফাত অর্কেস্ট্রা’ও গঠন করেছিলেন। আঙ্কারার বিরক্তির উদ্রেক করে নিয়মিত প্রাসাদে রাজনৈতিক সভা করতেন।
ইস্তাম্বুল স্বাধীন হওয়ার পর ২৯ অক্টোবর ১৯২৩ সালে তুরস্ক প্রজাতন্ত্র হিসেবে ঘোষিত হয়। জন ফিনলে নামের এক মার্কিন নাগরিক গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলির অধিবেশনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি খুবই উত্তেজিত হয়ে ঘোষণা দিলেন, এই জাতি প্রথমবারের মতো দুনিয়ার মুখোমুখি হওয়ার সুযোগ পেল।
জন ফিনলে আরও বলেন, ‘আগ্রহী এবং আশাবাদী এবং আমি আরও যোগ করতে চাই …নুয়ে পড়া সাদা চুলের খলিফা, মাথায় ফেজ টুপির বিপরীতে লাতিফ হানিফের (প্রেসিডেন্ট মুস্তাফা কামালের স্ত্রী) সুশ্রী মুখাবয়ব কত যে পার্থক্য গড়ে দিল!’ অনেকেই বলে থাকেন, তুরস্কের ভবিষ্যৎ ও অতীতকে বোঝাতে এর চেয়ে ভালো তুলনা আর হয় না।
এ সময়ে একটি ঘটনায় শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ১৯২৩ সালের ২৪ নভেম্বর ভারতের মুসলিম নেতৃত্ব তুরস্কের প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দেন। তাঁরা এই বলে সতর্ক করেন যে খলিফার সম্মানে আঘাত লাগে এমন কিছু, কিংবা খিলাফতের অবসান ঘটানোর যেকোনো চেষ্টা তুরস্ককে ইসলাম থেকে বিচ্ছিন্ন ঘোষণার নামান্তর। পাশাপাশি বিশ্বের নৈতিক শক্তি হিসেবে তুরস্কের যে অবস্থান, তারও ইতি ঘটাবে এমন পদক্ষেপ।
ইস্তাম্বুলের তিনটি পত্রিকায় এই চিঠি ছাপা হয়। ফলে ওইসব পত্রিকার সম্পাদকেরা গ্রেপ্তার হন, তাঁদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলা হয় এবং প্রকাশ্য ট্রাইবুন্যালে তাঁরা জেরার মুখে পড়েন। শেষ পর্যন্ত তাঁরা মুক্তি পান, কিন্তু তাঁদের পত্রিকা চুপসে যায়।
সরকার ক্রমাগত বুঝতে পারছিল আবদুলমেসিদের খিলাফত প্রজাতন্ত্রের সংহতির জন্য গুরুতর হুমকি হয়ে উঠছে। ১৯২৪ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসনের মৃত্যুর পর আঙ্কারা সরকারি ভবনে পতাকা অর্ধনমিত করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে ওয়াশিংটনের সঙ্গে তাদের কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন হয়। কিন্তু ইস্তাম্বুলে খলিফা তাঁর নিজ প্রাসাদ ও নৌযানে তুরস্কের পতাকা অর্ধনমিত করার নির্দেশ দেন।
১৯২৪ সালের প্রথমার্ধে সরকার খিলাফতের সমাপ্তি ঘোষণা করে। বড় বড় পত্রিকা অটোমান পরিবারকে আক্রমণ করে একের পর এক নিবন্ধ ছাপতে শুরু করে।
২৯ ফেব্রুয়ারি শুক্রবার আবদুলমেসিদ যখন সাপ্তাহিক শোভাযাত্রা নিয়ে মসজিদের দিকে এগোচ্ছিলেন, তখন সেখানে মুসলিমদের চেয়ে মার্কিন পর্যটকের সংখ্যা ছিল বেশি। তারপরও তিনি তাঁর অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেননি। তিনি আগের মতোই বের হতেন, সিনা টান করে আশপাশের মানুষের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করতেন। যদিও ভেতরে ভেতরে তিনি বুঝতে পারছিলেন তাঁর অবস্থান এখন নড়বড়ে।
৩ মার্চ সোমবার গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি শুধু খিলাফত অবসানের ঘোষণা দিয়েই ক্ষান্ত হলো না, আবদুলমেসিদের পরিবারের সকলের নাগরিকত্ব কেড়ে নিয়ে নির্বাসনে পাঠাল। সরকার প্রাসাদ বাজেয়াপ্ত করল। নির্দেশ দিল এক বছরের মধ্যে তাদের ব্যক্তিগত সম্পদ বিক্রি করে দেওয়ার।
পুরো বিষয়টি নিয়ে অ্যাসেম্বলিতে সাত ঘণ্টা বিতর্ক হয়। প্রধানমন্ত্রী ইসমেত পাশা অ্যাসেম্বলিকে বলেন, ‘যদি অন্য মুসলিমরা আমাদের প্রতি সহানুভূতি জানান, সেটি খলিফার জন্য নয়; বরং আমাদের শক্তিমত্তার কারণে।’ অ্যাসেম্বলিতে তাঁর যুক্তি গৃহীত হয়।
৩ মার্চ মধ্যরাতের কিছু আগে ইস্তাম্বুলের গভর্নর হায়দার বে ও পুলিশ প্রধান সাদেদ্দিন বে আবদুলমেসিদকে খিলাফতের অবসানের খবর জানান।
খলিফা তখন তাঁর গ্রন্থাগারে বসে পবিত্র কোরান শরিফ পড়ছিলেন। গভর্নর ও পুলিশ প্রধান তাঁকে নির্বাসনের আদেশ পড়ে শোনান। আবদুলমেসিদ জবাবে বলেন, ‘আমি বিশ্বাসঘাতক নই। কোনো অবস্থায় আমি এখান থেকে যাব না।’
এ সময় আবদুলমেসিদ তাঁর শ্যালক দামাদ শেরিফের কাছে ছুটে যান। তিনি বলেন ‘আমাদের কিছু একটা করতে হবে। তুমি কিছু একটা করো।’ কিন্তু দামাদের পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না।
‘আমার জাহাজ ছেড়ে যাচ্ছে, মহোদয়’, এটুকু বলে মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মান জানিয়ে চলে যান দামাদ। খলিফার মেয়ে রাজকুমারী দুরুসশেহভারের বয়স তখন ১০ বছর। সরকার নয় বরং তুরস্কের মানুষ তাঁদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে এই ক্ষোভ আজীবন বয়ে বেড়িয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘আমার বাবা, যাঁর পরিবার ৭০০ বছর ধরে শাসন করেছে…যিনি তাঁর জীবন ও সুখ দেশের মানুষের জন্য বিসর্জন দিয়েছেন; সেই মানুষই তাঁর কদর করল না।’
ভোর পাঁচটার দিকে আবদুলমেসিদ তাঁর তিন স্ত্রী, পুত্র–কন্যা ও পুরোনো গৃহপরিচারক–পরিচারিকাদের নিয়ে বেরিয়ে আসেন। সিংহাসনচ্যুত খলিফাকে সৈনিক ও পুলিশেরা নীরবে সালাম জানান। ততক্ষণে পুরো প্রাসাদ পুলিশে ভরে গেছে।
এরপর তিনি পশ্চিম ইস্তাম্বুলের কাটালকা অভিমুখে রওনা দেন। তাঁরা যখন ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছিলেন, একজন ইহুদি স্টেশনমাস্টার তাঁদের আতিথেয়তায় এগিয়ে আসেন। তিনি বলেন, হাউস অব ওসমান সব সময় ইহুদিদের প্রতি সদাশয় ছিল। এই কঠিন সময়ে তাঁদের পাশে থাকতে পারাটা কৃতজ্ঞতার চিহ্ন বহন করে। এই কথায় আবদুলমেসিদ কেঁদে ফেলেন।
ইস্তাম্বুলে রাজকুমারীকে প্রাসাদ ছেড়ে যাওয়ার জন্য দুই দিন ও এক হাজার লিরা দেওয়া হয়। পরিবারের অন্যান্য সদস্যের দেশত্যাগের জন্য দেওয়া হয় এক সপ্তাহ সময়। রাজকুমারী যখন শহর ছাড়েন, তখন কিছু মানুষ জড়ো হয়েছিলেন। মাথা নিচু করে রাজকুমারীকে বিদায় দেন তাঁরা।
কিছুদিনের মধ্যেই আবদুলমেসিদের পুরো পরিবারকে সুইজারল্যান্ডের নয়নাভিরাম লেক লেমেনের কাছে টেরিয়েট শহরে স্থানান্তরিত করা হয়।
খিলাফতের পতনকে নতুন যুগের সূচনা বলে গণ্য করল সরকার। মুসলিমদের শান্ত করতে কামাল একটি বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, খিলাফতের কর্তৃত্ব আইনিভাবে তুরস্কের গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলিকে হস্তান্তর করা হয়েছে।
এরপর ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শাসন ব্যবস্থার সূচনা হলো। ১৯২৮ সালে তুরস্কের সংবিধান থেকে ইসলামের উল্লেখ আছে এমন যেকোনো বিষয় প্রত্যাহারের ব্যাপারে অ্যাসেম্বলিতে বিল পাস হয়। ফলে ঈশ্বরকে সাক্ষী রেখে শপথ নেওয়ার প্রথাও বাতিল হলো।
কিন্তু তুরস্কের বাইরে খিলাফাতের অবসান নানা বিতর্কের জন্ম দেয়। এমন আওয়াজও উঠেছিল যে মক্কায় কিং হুসেইন অব দ্য হেজাজের নেতৃত্বে নতুন খিলাফত প্রতিষ্ঠিত হবে। মিসরের রাজা ফুয়াদের মনে আশা ছিল, তিনিই হবেন খলিফা। আফগানিস্তানের আমিরও পিছিয়ে থাকলেন না। নিজেকে প্রার্থী ঘোষণা করলেন। কিন্তু মুসলিম বিশ্বকে নেতৃত্ব দেওয়ার মতো যোগ্যতা আছে এমন কাউকে খুঁজে পাওয়া গেল না।
নির্বাসনে যাওয়ার এক সপ্তাহ পর সুইস একটি হোটেল থেকে আবদুলমেসিদ ঘোষণা দিলেন, ‘এই গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা আছে শুধু মুসলিম বিশ্বের। তারা পুরো কর্তৃত্ব নিয়ে স্বাধীনভাবে এই সিদ্ধান্ত দেবেন।’
আবদুলমেসিদ এই বক্তব্যের অন্তর্নিহিত কথা ছিল অটোমান খিলাফতের বৈধতা শুধু অটোমান সাম্রাজ্যের ওপর না; বরং গোটা বিশ্বের মুসলিমদের ওপর নির্ভর করছে।
কিন্তু এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শক্তিশালী সমর্থন প্রয়োজন ছিল। খলিফার পরিবার ফ্রেঞ্চ রিভিয়েরার একটি ভিলায় গিয়ে আশ্রয় নিল। তাদের ব্যয় বহন করছিলেন হায়দরাবাদের নিজাম। তিনি তখন বিশ্বের অন্যতম ধনী ব্যক্তি ও ভারত উপমহাদেশের সম্পদশালী একটি প্রিন্সলি এস্টেটের (দেশীয় রাজ্য) প্রধান।
হাউস অব ওসমানের সঙ্গে প্রিন্সলি এস্টেটের আসফ জাহি বংশের একটি ঐক্যের ওপর ভর করে খিলাফত ফেরাতে চাইলেন আবদুলমেসিদ। ১৯৩১ সালে ভারতীয় রাজনীতিক শৌকত আলী খলিফার কন্যা রাজকুমারী দুরুসশেহবার এবং নিজামের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজকুমার আযম জাহর বিয়ের ব্যবস্থা করলেন।
এই দম্পতির ছেলে, যিনি হায়দরাবাদের পরবর্তী রাজা হবেন, তাঁকেই আবদুলমেসিদ খলিফা হিসেবে মনোনীত করলেন। কিন্তু সেই খিলাফতের ঘোষণা আর এল না। প্রজাতন্ত্র হিসেবে ভারতের আবির্ভাবের পর ১৯৪৮ সালে হায়দরাবাদ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
আবদুলমেসিদ আর কখনো ইস্তানবুলে ফিরে যেতে পারেননি। কিন্তু নির্বাসিত জীবনেও তিনি মানতে চাইতেন না যে খিলাফতের অবসান হয়েছে। ১৯২৪ সালের জুলাই মাসে আবদুলমেসিদ শেকস্পিয়ারের হ্যামলেটকে উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ভাগ্যের নির্মমতায় তিনি ক্ষতবিক্ষত– তবে সেই ড্যানিশ যুবরাজের মতো তিনি তখনো হৃদয়বান, তাঁর চেতনা আর জোরাল বিশ্বাস আছে।
আবদুলমেসিদ ১৯৪৪ সালের ২৩ আগস্ট প্যারিসের কাছে একটি ভিলায় ৭৬ বছর বয়সে মারা যান। মার্কিন সেনাবাহিনী তখন ফ্রান্সের মুক্তির জন্য জার্মানির সঙ্গে যুদ্ধ করছিল। হঠাৎ একটি গুলি ভিলার দিকে ছুটে এলে হৃদ্যন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা যান তিনি।
১৯৩৯ সালে আবদুলমেসিদ ভারতে সমাহিত হওয়া ইচ্ছা পোষণ করেছিলেন। নিজাম তাঁর জন্য একটি সমাধিসৌধও নির্মাণ করিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৪ সালে খলিফার মরদেহ ভারতে আনার ঝুঁকি ছিল। তুরস্ক সরকার আবদুলমেসিদকে সে দেশে দাফন করতে না দেওয়ার ব্যাপারে অনড় থেকে গেল। ফলে প্রায় এক দশক আবদুলমেসিদের মরদেহ থেকে যায় প্যারিসে।
অবশেষে ১৯৫৪ সালে ইসলামের খলিফাকে মদিনার জান্নাত আল বাকি কবরস্থানে দাফন করা হয়। সৌদি আরবের এই কবরস্থান মুসলমানদের জন্য অতি পবিত্র হিসেবে বিবেচিত। কারণ, এখানেই ঘুমিয়ে আছেন ইসলামের নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)–এর স্বজন ও সঙ্গীরা।
আপনার মতামত জানানঃ