বিদ্যুতের দামের পর এবার বাড়ানো হচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রেনের ভাড়া। ট্রেনের ভাড়া বাড়িয়ে কি রেলওয়ের লোকসান কমানো যাবে? না কমানো গেলেও বাড়ানো যাবে জনগণের দুর্ভোগ৷ দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যে কদিন আগেই বাড়ানো হলো বিদ্যুতের দাম। এবার বাড়ানো হচ্ছে যাত্রীবাহী ট্রেনের ভাড়া।
দেশের প্রথম শ্রেণির দৈনিক প্রথম আলোর সংবাদ অনুসারে, ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বে ভ্রমণের ক্ষেত্রে বর্তমানে যাত্রীদের জন্য যে ছাড় রয়েছে, সেটা প্রত্যাহার করা হবে। এর ফলে ১০০ কিলোমিটারের অধিক দূরত্বের ভাড়া ২০ থেকে ৩০ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। যেমন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত শোভন শ্রেণির ভাড়া ৬০ টাকা, এসি স্নিগ্ধা শ্রেণির ভাড়া ১২০ টাকা এবং এসি (বার্থ) কামরার ভাড়া বাড়বে ২১৬ টাকার মতো।
বাড়তি এই ভাড়ার হার আগামী ১ এপ্রিল থেকেই কার্যকর হবে। যাত্রীবাহী ট্রেনের এই ভাড়া বাড়ানোর যুক্তি হিসেবে রেলের লোকসান কমানো এবং বিভিন্ন খাত থেকে সরকারের রাজস্ব আয় বাড়ানোর কথা বলা হচ্ছে।
এখন প্রশ্ন হলো, রেল খাতে তো জনগণের করের অর্থে হাজার হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলো। ২০১২ সালে ৫০ শতাংশ এবং ২০১৬ সাড়ে ৭ শতাংশ ভাড়াও বাড়ানো হলো। তাহলে রেলের লোকসান কমছে না কেন?
বর্তমান ভাড়া বৃদ্ধির কারণে সীমিত আয়ের মানুষের ওপর অর্থনৈতিক চাপ বাড়লেও রেলের আয় বাড়বে ৩০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র ৩০০ কোটি টাকার বাড়তি রাজস্ব আয়ের জন্য সীমিত আয়ের মানুষের ওপর নতুন করে ভাড়া বৃদ্ধির চাপ তৈরি করতে হচ্ছে। সরকারের রাজস্ব আয়ের এই হাল কার দোষে?
দেশের অর্থনীতির আকার বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আয়, বিশেষ করে উঠতি ধনীদের কাছ থেকে সরকারের প্রত্যক্ষ কর আহরণ সেই তুলনায় বাড়েনি। দেশে ধনী ও উচ্চমধ্যবিত্ত মানুষদের ৮৭ শতাংশ কোনো ধরনের আয়কর দেন না। জিডিপির সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজস্ব আয় না বাড়লেও ব্যয়বহুল উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া বন্ধ হয়নি। দেশি–বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে একের পর এক অবকাঠামো প্রকল্প করা হয়েছে।
পরিকল্পনার ত্রুটি, অনিয়ম ও দুর্নীতির কারণে এসব প্রকল্পের ব্যয় বারবার বেড়েছে। এর ফলে ঋণ পরিশোধে বাংলাদেশকে এখন তুলনামূলকভাবে বেশি অর্থ খরচ করতে হচ্ছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম সাত মাসে (জুলাই-জানুয়ারি সময়ে) বিদেশি ঋণ পরিশোধ ৪৫ শতাংশ বেড়েছে, আর সুদ পরিশোধ বেড়ে হয়েছে দ্বিগুণ।
এভাবে যে অর্থনৈতিক সংকট তৈরি হয়েছে, তার সমাধানের জন্য প্রয়োজন ছিল ধনীদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ কর আহরণ বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি, অপচয় ও লুণ্ঠন বন্ধ করা। কিন্তু তা না করে সরকার নানাভাবে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে অর্থ আদায় বাড়াতে চাইছে। কয়েক দিন আগে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পর এখন আবার রেলের ভাড়া বৃদ্ধির উদ্যোগ এরই ধারাবাহিকতা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে রেলের আয় ছিল ১ হাজার ৭৮৩ কোটি টাকা আর ব্যয় ছিল ৩ হাজার ৩০৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ লোকসান ১ হাজার ৫২৪ কোটি টাকা। দেখা যাচ্ছে, ২০১২ ও ২০১৬ সালে দুই দফায় রেলের ভাড়া বাড়ানো হলেও পরিস্থিতির উন্নতি হয়নি। কারণ, রেলের আয় বাড়ানোর জন্য ভাড়া বাড়ানোই একমাত্র বা সঠিক উপায় নয়। এর জন্য যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে ট্রেন প্রতি আয় বাড়াতে হবে ও ব্যয় হ্রাস করতে হবে।
যাত্রী পরিবহনের ভাড়া ছাড়াও আরও যেসব বিষয়ের ওপর ট্রেনপ্রতি আয় নির্ভর করে, তার মধ্যে রয়েছে ট্রেনপ্রতি যাত্রীবাহী কোচের সংখ্যা, কোচের যাত্রী ধারণক্ষমতা ও কোচের সিটের কত শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে (অকুপেন্সি রেট), তার হার ইত্যাদি।
কোচের সংখ্যা বাড়লে ট্রেন থেকে আয় বাড়ে কিন্তু খরচ সমানুপাতে বাড়াতে হয় না। কারণ, রেলওয়ের অনেক খরচ কোচের সংখ্যার সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, যেমন রেললাইন, ইঞ্জিন, গার্ড, চালক, প্ল্যাটফর্ম ইত্যাদি। ফলে যেসব রুটের ট্রেন জনপ্রিয় এবং কোচগুলো সব সময় যাত্রী বোঝাই হয়ে চলে, সেসব ট্রেন ও ট্রেনের কোচসংখ্যা বাড়ানো হলে আয় বৃদ্ধি পায়। কিন্তু বাংলাদেশে চাহিদা ও জনপ্রিয়তা থাকা সত্ত্বেও বিভিন্ন রুটে প্রয়োজনীয় সংখ্যক ট্রেন ও ট্রেনপ্রতি পর্যাপ্তসংখ্যক কোচ বা বগি সরবরাহ না করার কারণে রেলের আয় বাড়ছে না।
রেলপথ মন্ত্রণালয়ের বার্ষিক প্রতিবেদন ২০২২-২৩ অনুসারে, ২০০৯ থেকে জুন ২০২৩ পর্যন্ত বাংলাদেশ রেলওয়ের অর্জিত সাফল্যের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ১৪৩টি নতুন ট্রেন চালু, ৮৭৩ কিলোমিটার নতুন রেলপথ নির্মাণ, ১৩৯১ কিলোমিটার রেললাইন পুনর্বাসন/পুনর্নির্মাণ, ১৪৬টি নতুন স্টেশন বিল্ডিং নির্মাণ, ২৩৭টি স্টেশন বিল্ডিং পুনর্বাসন/পুনর্নির্মাণ, ১০৩৭টি নতুন সেতু নির্মাণ, ৭৯৪টি রেলসেতু পুনর্বাসন/পুনর্নির্মাণ, ১০৯টি লোকোমোটিভ সংগ্রহ, ৬৫৮টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ সংগ্রহ, ৫৩০টি যাত্রীবাহী ক্যারেজ পুনর্বাসন, ৫১৬টি মালবাহী ওয়াগন সংগ্রহ, ২৭৭টি মালবাহী ওয়াগন পুনর্বাসন ইত্যাদি।
এসব কাজে যে বিপুল ব্যয় করা হয়েছে তার কতটুকু মৌলিক কাঠামোগত সমস্যা সমাধানে কাজে লেগেছে, সেটা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। এই খরচের বড় অংশই গেছে নতুন রেললাইন ও স্টেশন ভবন নির্মাণের পেছনে। পর্যাপ্ত ইঞ্জিন, কোচ ও লোকবলের ব্যবস্থা না করেই নতুন রেললাইন নির্মাণ ও একের পর এক নতুন ট্রেন চালু করা হয়েছে।
ফলে একদিকে নতুন লাইনগুলোতে পর্যাপ্তসংখ্যক ট্রেন চালানো যাচ্ছে না। অন্যদিকে বিদ্যমান ট্রেনগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী কোচ দেওয়া যাচ্ছে না। এমনকি গরিবের ট্রেন বলে পরিচিত অনেক লোকাল ও কমিউটার ট্রেন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
একটি হিসাব থেকে দেখা গেছে, রেলের সব কটি ট্রেন নিরবচ্ছিন্নভাবে চালাতে হলে দরকার ৩ হাজারের বেশি কোচ আর প্রায় ৫০০ ইঞ্জিন। কিন্তু রেলে বর্তমানে কোচ আছে ১ হাজার ৭৮৮, যার ৪৭ শতাংশেরই অর্থনৈতিক মেয়াদকাল শেষ। আর সচল ইঞ্জিনের সংখ্যা মাত্র ২৯৫, যার ৬০ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ। আর মালবাহী ওয়াগনের সংখ্যা ৩ হাজার ২৪৭, যার ৬৭ শতাংশ মেয়াদোত্তীর্ণ।
এই জীর্ণ-পুরোনো ইঞ্জিন, কোচ ও ওয়াগনগুলো প্রায়ই নষ্ট থাকায় সব সময় কাজে লাগানো যায় না। প্রয়োজনের তুলনায় কম ইঞ্জিন থাকার কারণে একটি ইঞ্জিন দিয়ে দিনে একাধিক ট্রেন পরিচালনা করা হয়। ফলে পথিমধ্যে প্রায়ই ইঞ্জিন বিকল হওয়ার ঘটনা ঘটে, ট্রেনের শিডিউল বিঘ্নিত হয়।
বর্তমানে রেলস্টেশনের মাস্টার, লোকোমাস্টার (চালক), পোর্টার, লেভেল ক্রসিং গেটম্যান ইত্যাদি জনবলসংকট রয়েছে। মোট ৪৭ হাজার ৬৩৭টি পদের বিপরীতে জনবল রয়েছে মাত্র ২৪ হাজার ৫০০ জন। রেলের দুই অঞ্চলের লোকোমাস্টার (এলএম), সহকারী লোকোমাস্টার (এএলএম) ও সাব লোকোমাস্টার (এসএলএম) পদের সংখ্যা ২ হাজার ২৩৬। বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৮৫০ জন, যা ট্রেন চালানোর কাজে নিয়োজিত জনবলের চাহিদার বিপরীতে মাত্র ৩৮ শতাংশ।
এ রকম ইঞ্জিন, কোচ, ওয়াগন ও জনবলসংকটের কারণে ৬২ হাজার ৮৬১ কোটি টাকা বিনিয়োগে তৈরি করা নতুন তিনটি রেললাইনে পূর্ণাঙ্গ রেলসেবা দিতে পারছে না রেলওয়ে। এগুলো হলো দোহাজারী-কক্সবাজার, খুলনা-মোংলা বন্দর ও কমলাপুর-ভাঙ্গা থেকে পদ্মা সেতু রেললাইন। অস্থায়ী জনবল দিয়ে ঢাকা-কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালু করা হলেও ইঞ্জিন–সংকটের কারণে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার রুটে ট্রেন চালু করা যায়নি।
সাড়ে ১০ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগে ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথ ডাবল লাইনে উন্নীত করার পর ট্রেন বেড়েছে মাত্র একটি। ১ হাজার ৭১৪ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে নির্মিত ঈশ্বরদী-পাবনা-ঢালারচর রেলপথে ট্রেন চলে মাত্র একটি।
রেলওয়ে একদিকে বুলেট ট্রেন, বৈদ্যুতিক ট্রেন, বৃত্তাকার ট্রেনসহ নানা প্রকল্পের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে বড় অঙ্কের অর্থ ব্যয় করেছে। অন্যদিকে দেশে রেলকোচ তৈরি কিংবা মেরামতের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে প্রয়োজনীয় সামান্য বিনিয়োগটুকুও করেনি। যেমন ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথে বুলেট ট্রেন চালুর সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ১০০ কোটি টাকা, ঢাকার চারদিকে বৃত্তাকার রেলপথ নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ২৫ কোটি টাকা কিংবা ঢাকার ভেতরে ও চারপাশে চারটি সাবওয়ে নির্মাণের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে ৩২২ কোটি টাকা খরচ করা হয়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য যদিও কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।
অন্যদিকে নষ্ট ও পুরোনো যন্ত্রপাতি ও প্রয়োজনীয় লোকবলের অভাবে খুঁড়িয়ে চলছে দেশের বৃহত্তম সৈয়দপুর রেলওয়ে কারখানা। বর্তমানে কারখানাটিতে ২ হাজার ৮৫৯টি পদের বিপরীতে কর্মরত আছেন মাত্র ৬২২ জন। ৭৫০টি যন্ত্রপাতির বেশির ভাগই নষ্ট। এমনকি মেরামতকাজের জন্য পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দও পাওয়া যায় না।
গত অর্থবছরে ২৭ কোটি টাকা চাহিদার বিপরীতে বরাদ্দ দেওয়া হয় মাত্র সাড়ে ছয় কোটি টাকা। ফলে একসময় যে কারখানায় বছরে ৯০০ কোচ মেরামত এবং ২০ কোচ নতুন নির্মাণ করা হতো, সেখানে এখন বছরে সর্বোচ্চ ৪৫০টি কোচ মেরামত করা হয় এবং নতুন কোচ নির্মাণ করা হয় না। শুধু তা–ই না, ২০১৬ সালে প্রথমে ৭৫৩ কোটি টাকা এবং পরে ১ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা ব্যয়ে সৈয়দপুরে রেলের নতুন কোচ তৈরির কারখানা করার উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবায়িত হয়নি। অথচ দেশে কোচ তৈরি করতে পারলে অর্ধেক ব্যয়ে কোচ নির্মাণ করা সম্ভব হতো।
রাষ্ট্রের সেবা খাত হিসেবে এবং দরিদ্র জনগণের জন্য সবচেয়ে নিরাপদ, সস্তা ও পরিবেশবান্ধব বাহন হিসেবে রেলওয়েকে লাভজনক হতেই হবে এমন কোনো কথা নেই। জনগণের অর্থ থেকে রেলওয়ে খাতে বছরে কিছু টাকা ভর্তুকি দরিদ্র জনগণের সস্তা যাতায়াত ও পরিবহনের ব্যবস্থার মাধ্যমে সড়ক খাতের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভর্তুকির তুলনায় অনেক বেশি কল্যাণকর ভূমিকা পালন করে। লেখক: কল্লোল মোস্তফা, প্রথম আলো।
আপনার মতামত জানানঃ