বাংলাদেশে গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ কল্যাণসহ সাতটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে নোবেলজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তারই হাতে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের মধ্যে সম্প্রতি দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে।
অধ্যাপক ইউনূস অভিযোগ করেছেন যে, প্রতিষ্ঠানগুলো ‘জবরদখল’ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, ‘তাদের টাকাতেই ওইসব প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছে’ দাবি করে গ্রামীণ ব্যাংক বলছে, আইন মেনেই প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে।
ব্যাংকের চেয়ারম্যান বিবিসিকে জানিয়েছেন, এখন আইনজীবীদের সাথে পরামর্শ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেবে প্রতিষ্ঠানটি। তবে অধ্যাপক ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন দাবি করেছেন, অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে তোলা অভিযোগ গুলো ভিত্তিহীন।
তাহলে কি শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক ইউনূসকে প্রতিষ্ঠান গুলো থেকে সরে যেতে হবে? গ্রামীণ ব্যাংকের সাথে অধ্যাপক ইউনূসের দ্বন্দ্ব ঠিক কোনদিকে গড়াচ্ছে?
অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ
যে সাতটি প্রতিষ্ঠান নিয়ে এ দ্বন্দ্ব, সেগুলো হচ্ছে – গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ টেলিকম, গ্রামীণ ফান্ড, গ্রামীণ মৎস্য ফাউন্ডেশন, গ্রামীণ উদ্যোগ, গ্রামীণ সামগ্রী এবং গ্রামীণ শক্তি।
এসব প্রতিষ্ঠানের জন্মলগ্ন থেকেই সেগুলোর চেয়ারম্যান পদে রয়েছেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সর্বশেষ ঘটনা প্রবাহের শুরু গত সপ্তাহে। গত বৃহস্পতিবার অধ্যাপক ইউনূস সংবাদ সম্মেলন করে তার প্রতিষ্ঠানে ‘জবর দখলের’ অভিযোগ করেন।
পাল্টা জবাব হিসেবে শনিবার গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান আরেকটি সংবাদ সম্মেলন করে দাবি করেছেন, অধ্যাপক ইউনূসের দাবি সঠিক নয়।
এর আগে, সোমবার ১২ই ফেব্রুয়ারি গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মকর্তা পরিচয়ে কয়েকজন ব্যক্তি মিরপুরে গ্রামীণ টেলিকম ভবনের ঢুকে পড়ে এবং তারা মূল ফটকে তালা লাগিয়ে দেয়।
ঢাকার মিরপুর চিড়িয়াখানা রোডে অবস্থিত গ্রামীণ টেলিকম ভবনটিতে রয়েছে ১৬টি কোম্পানির কার্যালয়, যার সবক’টির চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
১৫ই ফেব্রুয়ারি দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে অধ্যাপক ইউনূস অভিযোগ করেন, সোমবার ওই ব্যক্তিরা গ্রামীণ টেলিকম এবং গ্রামীণ কল্যাণসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ‘দখল’ নেওয়ার চেষ্টা করেছে।
পুলিশের কাছে এ নিয়ে প্রতিকার চেয়েও সহযোগিতা পাননি বলেও সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন তিনি। সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, “আমরা একটা ভয়ংকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে গেছি। আমরা একটা স্বপ্নের বীজতলা হিসেবে এই ভবন তৈরি করেছিলাম। কিন্তু ১২ই ফেব্রুয়ারি কিছু বাইরের লোক এসে এটা জবরদখল করে নিলো। আমরা তাদের কাছে বাইরের লোক হয়ে গেলাম।”
নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, “আমরা পুলিশের সহায়তা চাইলাম তারা প্রথমে জিডি গ্রহণই করলো না। তারপর একবার এসে ঘুরে গেলো , কিন্তু কোন অসুবিধা দেখলো না।”
“তারা আমাদের দরজায় এসে তালা দিয়ে যাচ্ছে, সকালবেলা এসে আবার খুলে দিচ্ছে। এইরকম জবরদখল আর দেখিনি। আইন-আদালত কোথায় গেলো?” সংবাদ সম্মেলনে প্রশ্ন রাখেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস।
এদিকে, অধ্যাপক ইউনূসের সংবাদ সম্মেলনের একদিন পর সংবাদ সম্মেলন করে গ্রামীণ ব্যাংক। সেখানে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফুল মজিদ দাবি করেছেন, চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও গ্রামীণ ব্যাংকসহ বাকি প্রতিষ্ঠানগুলোেত ড. ইউনূসের কোনো মালিকানা বা অংশ নেই।
“সব প্রতিষ্ঠানই তৈরি করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায়। এসব প্রতিষ্ঠান গ্রামীণ ব্যাংকের”, শনিবার সাংবাদিকদের বলেন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মি. মজিদ।
‘‘গ্রামীণ ব্যাংকের আইনি অধিকারগুলো ফিরিয়ে আনা হবে। এগুলো অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিষ্ঠান নয়”, বলেন তিনি। সম্প্রতি সাতটি প্রতিষ্ঠানের সবগুলোতেই আইন মতো চিঠি পাঠানো হয়েছে বলেও জানিয়েছেন ব্যাংকটির কর্মকর্তারা।
ইতিমধ্যে অধ্যাপক ইউনূসের পরিবর্তে তিনটি প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান পদে মনোনীত করা হয়েছে গ্রামীণ ব্যাংকের বর্তমান চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফুল মজিদকে।
এদিকে, ড. ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন বিবিসি বাংলাকে বলছেন, গ্রামীণ ব্যাংকের এসব দাবি সত্য নয়। “এই কোম্পানি গুলো করতে কোন টাকা লাগে নাই, গ্যারান্টির ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে। কাজেই এসব দাবি সম্পূর্ণ মিথ্যা”, বলেন তিনি।
অন্যদিকে, মালিকানা প্রশ্নে আইনি অধিকার ফিরিয়ে আনতে ইতিমধ্যেই কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে বলে জানিয়েছে গ্রামীণ ব্যাংক। অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের হাত ধরেই ১৯৮৩ সালে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
দারিদ্র্য বিমোচনের মাধ্যমে শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখায় ২০০৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংক এবং ড. ইউনূস নোবেল পুরস্কারও পান। পরে বয়সসীমা অতিক্রমকে কেন্দ্র করে ২০১১ সালে ড. ইউনুসকে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অপসারণ করা হয়।
যা বলছে গ্রামীণ ব্যাংক
গ্রামীণ ব্যাংকটির চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফুল মজিদ শনিবার সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, ওই ভবনের সবগুলো প্রতিষ্ঠানই তাদের প্রতিষ্ঠানের টাকায় গড়ে তোলা হয়েছে।
তিনি দাবি করেন, গ্রামীণ কল্যাণ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ৪৪৭ কোটি টাকা নিয়েছেন। একইভাবে, গ্রামীণ টেলিকম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েও ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক থেকে ২৪ কোটি টাকা অনুদান নিয়েছেন বলেও জানান। কিন্তু গ্রামীণ টেলিকম এ পর্যন্ত গ্রামীণ ব্যাংককে সুদ ও লভ্যাংশ বাবদ কোনো টাকা ফেরৎ দেননি।
এছাড়া নিরীক্ষা করতে গিয়ে আর্থিক হিসাবের অনেক কাগজ পাওয়া যায়নি বলে সংবাদ সম্মেলনে দাবি করেন গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান এ কে এম সাইফুল মজিদ।
“গ্রামীণ কল্যাণ, গ্রামীণ টেলিকম এসব প্রতিষ্ঠান নব্বইয়ের দশকে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক আর্থিক তথ্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। অনেক তথ্য সরিয়ে ফেলা হয়েছে। তথ্য ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে” বলেন তিনি।
এ অবস্থায় আইন মেনেই গ্রামীণ টেলিকম ভবনের সাতটি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ নেওয়া হয়েছে বলে দাবি করেছেন মি. মজিদ।
ড. ইউনূসের আইনজীবী যা বলছেন
গ্রামীন ব্যাংক থেকে কয়েক শ’ কোটি টাকা নিয়ে প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার যে অভিযোগ করা হচ্ছে, সেটি ভিত্তিহীন বলে দাবি করেছেন অধ্যাপক ইউনূসের আইনজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন।
মি. মামুন বিষয়টিকে ব্যাখ্যা করছেন এভাবে – গ্রামীণ ব্যাংকসহ ওই প্রতিষ্ঠান গুলো করা হয়েছে কোম্পানি আইনের ২৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী।
বাংলাদেশের ১৯৯৪ সালের কোম্পানি আইনের এই ধারা অনুযায়ী বড় অ্ঙ্কের অর্থ ব্যয় না করেই কেবল ‘গ্যারান্টি’ দিয়ে যেকোন দাতব্য ও অলাভজনক কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা যায়। এক্ষেত্রে শর্ত থাকে যে, কোম্পানিটি সমাজ ও মানুষের কল্যাণে কাজ করবে এবং যাদের টাকায় কাজগুলো হবে, তারা কোন মুনাফা নিতে পারবেন না।
“কাজেই ড. ইউনূসসহ অন্যান্য যারা এই কোম্পানি করেছেন, তাদের কোন টাকা দেয়া লাগে নাই, শুধু গ্যারান্টি দিয়েই হয়ে গেছে” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. মামুন।
“তাহলে তারা (গ্রামীণ ব্যাংক) টাকা দিলেন কোথায়?” তিনি প্রশ্ন করেন। মি. মামুন দাবি করেছেন যে, গ্রামীণ ব্যাংকের টাকায় নয়, বরং বিদেশি অনুদান এবং সদস্যদের নিজেদের টাকাতেই সাতটি কোম্পানি গড়ে তোলা হয়েছে।
“তারা নিজেরা টাকা দিয়েছেন এবং সামাজিক ব্যবসার নীতি অনুযায়ী, তারা কোন লাভ নেন না। পাশাপাশি বাইরের সাহায্য-সহযোগিতায় এই প্রতিষ্ঠান গুলো গড়ে উঠেছে” বলেন মি. মামুন।
ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত সামাজিক ব্যবসার গ্রামীণ প্রতিষ্ঠানগুলো কোম্পানি আইন – ১৯৯৪ এর অধীনে নিবন্ধিত প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানি। প্রতিষ্ঠাকালে এসব প্রতিষ্ঠানের আর্টিকেল অব এসোসিয়েশনের একটা বিধান রাখা হয়েছিলো যাতে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিনিধিত্ব রাখা যায়।
সে বিধানে বলা হয়েছিলো, গ্রামীণ ব্যাংক গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণে দুই বা তিনজন পরিচালক এবং চেয়ারম্যান পদে একজনের মনোনয়ন দিতে পারে।
এই বিধানের আওতায় গ্রামীণ ব্যাংক ১৯৯৫ সালে গ্রামীণ টেলিকম এবং ১৯৯৬ সালে গ্রামীণ কল্যাণে প্রথম চেয়ারম্যান হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে মনোনয়ন দেয়।
গত ২৭ বছরে চেয়ারম্যান পদে নতুন আর কাউকে মনোনয়ন দেয়নি গ্রামীণ ব্যাংক। তবে সম্প্রতি তিনটি প্রতিষ্ঠানে চেয়ারম্যান ও পরিচালক পদে নতুন ব্যক্তিকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
গত ১৫ই ফেব্রুয়ারির সংবাদ সম্মেলনে ড. ইউনূস বলেছিলেন, গ্রামীণ ব্যাংকের পদক্ষেপের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে আদালতে যাবেন তারা।
এ বিষয়ে কোন অগ্রগতি আছে কী-না জানতে চাইলে ড. ইউনূসের এই আইনজীবী বলেন, “যারা মালিকানা দাবি করছেন, দখল পেতে হলে তাদেরকে আদালতের রায়ের মাধ্যমে পেতে হবে। আদালতে সেটি প্রমাণ করা তাদের দায়িত্ব” বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. মামুন।
ড. ইউনূসের আইনজীবীর অভিযোগের বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে বিবিসি বাংলা যোগাযোগ করে গ্রামীণ ব্যাংকের চেয়ারম্যান মি. মজিদের সাথে। “আমাদের যা বলার ছিল, সেটি আমরা ইতিমধ্যেই সংবাদ সম্মেলনে বলেছি”, বিবিসি বাংলাকে বলেন মি. মজিদ।
এছাড়া আইনগত বিষয়গুলো নিয়ে আইনজীবীর সাথে পরামর্শ করার পর পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলেও জানিয়েছেন তিনি।
আইন কী বলছে?
গ্রামীণ ব্যাংক যেভাবে ড. ইউনূসের প্রতিষ্ঠানগুলো মালিকানা ও নিয়ন্ত্রণ দাবি করছে, সে বিষয়ে বাংলাদেশের প্রচলিত আইন কী বলছে?
কোম্পানি আইন বিশেষজ্ঞ আইনজীবী আহসানুল করিম বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, প্রতিষ্ঠান গুলো যদি সত্যিই কোম্পানি আইনের ২৮ নম্বর ধারা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠিত হয়ে থাকে, তাহলে আইনগতভাবে গ্রামীণ ব্যাংক খুব একটা সুবিধা করতে পারবে না।
তিনি আরও বলেন, “এ ধরনের প্রতিষ্ঠান যদি অন্যকোন প্রতিষ্ঠানের টাকা দিয়ে করা হয়েও থাকে, তাহলে সেটা জন্য দায়ী থাকবেন যিনি টাকাটা নিয়েছেন তিনি।”
“কাজেই অভিযোগকারী প্রতিষ্ঠান চাইলে ব্যক্তির বিরুদ্ধে হয়তো আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারেন, কিন্তু কোম্পানির মালিকানা বা দখল দাবি করতে পারেন না। আইন সেটি সমর্থন করে না” বলেন মি. করিম।
আপনার মতামত জানানঃ