জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে এমন অপকর্ম হামেশাই ঘটছে। অনেক ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা ভয়ভীতি ও লোকলজ্জার ভয়ে এসব প্রকাশ করেন না। স্বামীকে আটকে রেখে স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের মামলায় গ্রেপ্তার হওয়া আসামি মামুনুর রশিদ ওরফে মামুনের বরাত দিয়ে র্যাব এসব কথা বলেছে। এসব বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হওয়া উচিত বলে মনে করে র্যাব।
গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র্যাবের মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন এসব কথা বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে র্যাবের মুখপাত্র বলেন, মামুনের বক্তব্য অনুযায়ী এ ধরনের ঘটনা সেখানে হামেশাই হচ্ছে। অনেকেই এসব ঘটনা ভয়ভীতি ও লজ্জার কারণে প্রকাশ করেন না।
র্যাবের মুখপাত্র আরও বলেন, ‘বিশ্ববিদ্যালয়ে যাঁরা মাদক ব্যবসায়ী, অনৈতিক কাজ যাঁরা করছেন, তাঁদের প্রবেশের ক্ষেত্রে দায়িত্ব অবশ্যই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের নিতে হবে। আমরা যাঁদের আটক করছি, তাঁদের কাছ থেকে যে তথ্য পেয়েছি, তা অ্যালার্মিং (উদ্বেগজনক)। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে আরও কঠোর হওয়া উচিত।’
গৃহবধূকে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনায় অন্যতম অভিযুক্ত জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের আন্তর্জাতিকবিষয়ক সম্পাদক মোস্তাফিজুর রহমান ও তাঁর তিন সহযোগীকে গত শনিবার রাতেই গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। গত বুধবার রাজধানীর ফার্মগেট এলাকা থেকে মামুনকে এবং ধর্ষণের ঘটনায় অন্যতম সহায়তাকারী মো. মুরাদকে (২২) নওগাঁ থেকে গ্রেপ্তার করে র্যাব।
গতকালের সংবাদ সম্মেলনে র্যাব বলে, মোস্তাফিজের সঙ্গে মামুনের সুসম্পর্ক ছিল। এ কারণে মোস্তাফিজদের অনেক চাহিদা মামুন পূরণ করতেন। মামুন বলেছেন, তিনি ও মোস্তাফিজ এ ঘটনায় সরাসরি যুক্ত।
র্যাব বলছে, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে বহিরাগত হয়েও নিয়মিত যাতায়াত ছিল মামুনুর রশিদ ওরফে মামুনের (৪৪)। মামুন নিয়মিত কক্সবাজার থেকে ইয়াবা এনে ক্যাম্পাসে বিক্রি করতেন। গত শনিবার রাতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের একটি কক্ষে স্বামীকে আটকে রেখে তাঁর স্ত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষণের মূল পরিকল্পনাকারী এই মামুন।
সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের পরিচালক আরও বলেন, সবশেষ গ্রেপ্তার দুজনকে জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, মামুন প্রায় ২০ বছর আগে ঢাকার জুরাইন এলাকায় এসে পোশাকশ্রমিক হিসেবে চাকরি নেন। পরে তিনি আশুলিয়া এলাকায় পোশাক কারখানায় চাকরির পাশাপাশি মাদক কারবারে জড়িয়ে পড়েন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকাসহ বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু মাদকসেবী শিক্ষার্থীকে মাদক সরবরাহ করার ফলে তাঁদের সঙ্গে তাঁর সখ্য তৈরি হয়। পরে তিনি পোশাক কারখানার চাকরি ছেড়ে ২০১৭ সাল থেকে পুরোপুরি মাদক কারবারে যুক্ত হন।
মামুনের বিরুদ্ধে দেশের বিভিন্ন থানায় মাদকসংক্রান্ত আটটি মামলা রয়েছে এবং এর আগে এসব মামলায় একাধিকবার কারাভোগও করেন মামুন। আর মুরাদ জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের স্নাতকোত্তরের শিক্ষার্থী। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের মীর মশাররফ হোসেন হলে থাকতেন। তাঁর বিরুদ্ধে নওগাঁ থানায় মারামারিসংক্রান্ত একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে।
খন্দকার আল মঈন বলেন, একই এলাকায় বসবাসের কারণে তিন-চার বছর আগে মামুনের সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর স্বামীর পরিচয় হয়। পরিচয়ের সূত্রে মামুন মাঝেমধ্যে ভুক্তভোগীর স্বামীর মাধ্যমেও বিশ্ববিদ্যালয়সহ আশপাশের এলাকায় মাদক সরবরাহ করাতেন।
কিছুদিন আগে মামুনের থাকার জায়গার সমস্যা হলে ভুক্তভোগীর স্বামীকে ফোন দিয়ে কিছুদিনের জন্য তাঁদের বাসায় অবস্থান করবেন বলে জানান। পরে মামুন ভুক্তভোগীর ভাড়া করা বাসায় ‘সাবলেট’ হিসেবে প্রায় তিন-চার মাস ছিলেন। সেই সূত্র ধরে তিনি শনিবার রাতে পূর্বপরিকল্পিতভাবে প্রথমে স্বামী এবং পরে তাঁর স্ত্রীকে ক্যাম্পাসে ডেকে এনে দলবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা ঘটান।
ক্যাম্পাসে এমন অপকর্ম প্রায়ই হয়—এই অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর আ স ম ফিরোজ-উল-হাসান গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, ধর্ষণের এমন অভিযোগ তাঁদের কাছে কেউ কখনো করেননি। যে স্থানে ঘটনা ঘটেছে, সেটি মূল ক্যাম্পাস থেকে বেশ খানিকটা দূরে। পর্যাপ্ত জনবল না থাকায় ওই স্থানটি প্রায় অরক্ষিত থাকে। বহিরাগতসহ কেউ কেউ সেটির সুযোগ নিতে পারে।
স্বামীকে আটকে স্ত্রীকে ধর্ষণের অভিযোগের পঞ্চম দিনে বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মশালমিছিল, লিফটলেট বিতরণ ও জনসংযোগ করেছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা। গতকাল বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান আন্দোলনে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের প্লাটফর্ম ‘নিপীড়ন বিরোধী মঞ্চ’ থেকে শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে বিভিন্ন এলাকায় লিফটলেট বিতরণ করেন। একই প্ল্যাটফর্ম থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সমাবেশ করা হয়।
এদিকে সন্ধ্যা সাতটার দিকে চার দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ মিনারের পাদদেশ থেকে মিছিল বের করেন শিক্ষার্থীদের আরেকটি দল। মিছিলটি কয়েকটি সড়ক ঘুরে পরিবহন চত্বরে এসে শেষ হয়। পরে সেখানে একটি সংক্ষিপ্ত সমাবেশ করেন তাঁরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন।
দাবিগুলো হলো ধর্ষণে অভিযুক্ত ও পলায়নে সহযোগিতাকারীদের রাষ্ট্রীয় আইনে দ্রুততম সময়ে বিচার নিশ্চিত করা, মীর মশাররফ হোসেন হল ও বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর হলের প্রাধ্যক্ষ এবং হল প্রশাসনের বিরুদ্ধে অভিযুক্তদের পলায়নে সাহায্য করার অভিযোগের ভিত্তিতে তদন্ত কমিটি গঠন করা, সব আবাসিক হল থেকে অছাত্রদের বিতাড়িত করা, ক্যাম্পাসের নিরাপত্তা শাখার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং যৌন নিপীড়নবিরোধী সেল কার্যকর করতে হবে।
আপনার মতামত জানানঃ