দক্ষিণ কোরিয়ায় এক রোবট হত্যা করেছে এক ব্যক্তিকে। এ সময় ওই ব্যক্তি একটি কৃষিজ পণ্যের প্রক্রিয়াকরণ সেন্টারে কাজ করছিলেন। কিন্তু রোবটটি তাকে বাক্স মনে করে চাপ দিয়ে মুখমণ্ডল এবং বুক দুমড়ে মুচড়ে দেয়। পরে তার মৃত্যু হয়।
বুধবার বার্তা সংস্থা ইয়োনহাপ রিপোর্টে বলেছে, ঘটনার সময় রোবটটিতে ত্রুটি দেখা দিয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছে। ফলে সে মানুষ এবং বাক্সের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনি। নিহত ব্যক্তির বয়স ৪০-এর কোটায়। তিনি তখন সাউথ গিওঙ্গস্যাং প্রদেশে কৃষিপণ্য বিতরণ সেন্টারে রোবট সেন্সর অপারেশন পরীক্ষা করছিলেন।
কারখানায় ব্যবহৃত ওই রোবটটি তখন ক্যাপসিকাম তুলে নিয়ে বাক্সে ভরে তা প্রক্রিয়াকরণ করছিল। পুলিশ বলেছে, এমন সময় সেখানে উপস্থিত হন ওই ব্যক্তি।
কিন্তু রোবটটি মানুষ ও বাক্স আলাদা করে চিনতে পারেনি। রোবটিক হাত দিয়ে ওই ব্যক্তির শরীরের উপরের অংশকে চাপ দিয়ে পরিবাহক বেল্টের ওপর ফেলে দেয় রোবটটি। তারপর তার মুখ ও বুকের ওপর প্রচণ্ড জোরে চাপ দেয়।
তাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে নেয়া হয়। কিন্তু কিছুক্ষণ পরে তিনি মারা যান। এর আগে দক্ষিণ কোরিয়ার ৫০-এর কোটার আরেক ব্যক্তি রোবটের হাতে আহত হন। তিনি একটি অটোমোবাইল পার্টস তৈরির কারখানায় কাজ করার সময় রোবটের ফাঁদে আটকে পড়েন। এতে মারাত্মক আহত হন তিনি।
প্রসঙ্গত, চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের দোরগোড়ায় আমরা। এই শিল্পবিপ্লবের সফল বাস্তবায়ন হলে প্রতিষ্ঠানে মানুষের পরিবর্তে রোবট ও মানুষবিহীন উন্নতমানের প্রযুক্তির ব্যবহার বেড়ে যাবে কয়েকগুণ। এতে করে শিল্প বিপ্লবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে কর্মবাজারে। অটোমেশন প্রযুক্তির ফলে ক্রমশ শিল্প কারখানা হয়ে পড়বে যন্ত্রনির্ভর। যার ফলে বিশ্বব্যাপী মানুষ কর্মহীনতার ঝুঁকিতে পড়বে।
গত কয়েকশত বছর ধরেই মেশিন মানুষের কাজের জায়গাগুলো দখল করে নিচ্ছে। ফরচুন ম্যাগাজিনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের অন্তত ৫০০টি নেতৃস্থানীয় কোম্পানি তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়া ছেড়ে দিয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার হাতে; অর্থাৎ যন্ত্র এখন মানুষকে নিয়োগ দিচ্ছে।
বর্তমানে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি, হেলথ-কেয়ার, কাস্টমার-কেয়ার সহ প্রায় সবখানেই মেশিন, রোবট, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং অটোমেশনের জয়জয়কার। গার্মেন্টস শিল্পে বর্তমানে মেশিনের জয়জয়কার। অথচ উনিশ শতকের শেষের দিকেও রঙ করা, সুতা কাটা, বুননের কাজগুলো সাধারণ শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালিত হতো। পূর্বে জাহাজ শিল্পে যে পরিমাণ শ্রমিক প্রয়োজন হতো, তার প্রায় অধিকাংশ কমে গেছে ভারি ভারি মেশিনের কল্যাণে। বর্তমানে বড় বড় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর কল্যাণে চালকবিহীন গাড়িও রপ্তানি হচ্ছে।
চাকরি হারানো সহ মানুষ হিসেবে পৃথিবীতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার ভয় স্বাভাবিকভাবেই ঝেঁকে বসছে। মানবসভ্যতাকে টিকিয়ে রাখতে প্রযুক্তিকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। এমনটি অনুরোধ করছেন খোদ প্রফেসর স্টিফেন হকিং।
টাইমস ম্যাগাজিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে স্টিফেন হকিং বলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার আধিপত্য বিস্তার রোধে উপায় মানবজাতিকে খুঁজে বের করতে হবে। প্রযুক্তি এত ভয়ংকর গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে যে, আমরা পারমাণবিক যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যেতে পারি। আমরা উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া যুক্তি এবং কারণ দর্শানোর মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে পারি।”
২০১৫ সালের স্টিফেন হকিং বলেছিলেন, “কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কর্মদক্ষতাই হলো আমাদের জন্য আসল হুমকি। অত্যাধুনিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিটি কাজেই অতিরিক্ত দক্ষ। যদি আমরা তাদের দক্ষতাকে মোকাবেলা না করতে পারি; তাহলে আমাদের জন্য বিপদ অপেক্ষা করছে।”
শুধু স্টিফেন হকিং নয়। আমেরিকার প্রযুক্তিভিত্তিক প্রতিষ্ঠান টেসলা’র সিইও এলন মাস্কও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে মানবসভ্যতার জন্য হুমকি হিসেবে দেখছে। ২০১৪ সালে এক সম্মেলনে মাস্ক বলেন, “আমি মনে করি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমাদের আরো সতর্ক হওয়া উচিত। যদি আমাকে অনুমান করতে হয়-যে আগামীতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় হুমকি কোনটি। আমি বলবো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা।”
রোবটের আধিপত্য নিয়ে আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞের মতে, “পৃথিবী তার নিজস্ব গণ্ডিতে ঘূর্ণায়মান। পৃথিবীতে উপস্থিত প্রতিটি বস্তু বা প্রাণ নিজস্ব চক্র বা প্রক্রিয়ার ভেতরে অবস্থান করছে। সেই প্রক্রিয়ায় যদি কোনো ধরনের ব্যাঘাত ঘটে তাহলে পুরো গঠনতন্ত্রই ধ্বংস হয়ে যাবে। বিশৃঙ্খল হয়ে পড়বে পুরো গণ্ডি। মানুষের জায়গা যদি রোবট নিয়ে নেয়; তাহলে পৃথিবীর গঠনতন্ত্রে বিশৃঙ্খলা তৈরি হবে। যার প্রভাব পড়বে পুরো সৃষ্টি জগতে। অস্তিত্ব সংকটে পড়বে মানুষসহ সকল প্রাণীকুল।”
আপনার মতামত জানানঃ