ডারুইনের বির্বতন তত্ত্ব আবিষ্কারের পর থেকেই বিজ্ঞানী মহলে নীরব বিপ্লব ঘটে যায় প্রাণী বিবর্তন শাখার যোগসূত্র প্রতিষ্ঠার। সেই ধারাবাহিকতায় একে একে উন্মোচিত হয়ে সমৃদ্ধ হতে শুরু করে প্রাণী বিবর্তন ইতিহাসের ধারা। প্রকৃতিতে প্রাপ্ত প্রাচীণ ফসিলের দাঁত, মাথার খুলি, হাড়গোড়, কঙ্কাল বিবেচনায় এনে প্রাণী বিজ্ঞানিরা নিশ্চিত হয়ে বলেছেন আজ বিশাল বপু নিয়ে যে সব হাতিকে বনেবাদারে বা আমাদের আশেপাশে হেলেদুলে চক্কর মারতে দেখি তা ৬০ মিলিয়ন বছরের প্রাকৃতিক বিবর্তনের অনন্য উপহার।
বিস্ময়কর হলেও সত্যি হাতির পূর্ব পুরুষরা কিন্তু মোটেই এত বিশাল সুস্বাস্থ্যের অতিকায় দানব ছিল না। প্রাপ্ত ফসিলে তার প্রমাণ মিলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতা ও খাদ্যঅভ্যাস পরিবর্তনের মত কিছু জটিল ধাপ ঠেলেটুলে অতিক্রম করে তবেই না হাতি বর্তমান দানব রূপ লাভ করে, আর পেয়েছে হাত রূপি লম্বা শুড়।
প্রাপ্ত ফসিল বিবেচনায় প্রাণী বিজ্ঞানীরা হাতির পূর্ব পুরুষের প্রাথমিক একটি শাখার নাম দেন মোইরিথেরিয়াম। মিলিয়ন বছর প্রাচীণ মিশরের মোইরিস লেকে প্রাপ্ত ফসিল বিবেচনায় বিজ্ঞানীরা লেকের সাথে মিল রেখে হাতির পূর্ব পুরুষ ভাইদের একটি শাখার এইরূপ নাম করণ করেন।
প্রথম ফসিলটি পাওয়া যায় ১৯০৪ সালের দিকে “এল ফাইয়াম” নামে এক ধুধু মরূদ্যানে। যা এক সময় প্রাচীণ মিসরের “মোইরিস লেক” নামে বিশাল জলাভূমি ছিল। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণী বিজ্ঞানী আলেক্সজেন্ড্রা লিউ মতে প্রায় ৩৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে ছিল মোইরিথেরিয়ামের সোনালী যুগ। প্রাণী বিজ্ঞানিরা যুগটির নাম দেন ইওচিনি(Eocene)। এই যুগেই ৬ ফুট উচ্চতার দানব পাখি, বড় বড় তিমি, বাদুর, নানান প্রজাতির ম্যামেলদের(স্তন্যপায়ীদের) দাপট ছড়িতে শুরু করে। আকৃতিতে মোইরিথেরিয়াম অনেকটা শুকরের মত উঁচু তবে কিছুটা লম্বা আর দেখতে ছিল তাপিরের মত।
যদিও এদের সরাসরি হাতির পূর্ব পুরুষ বলে গণ্য করেননি বিজ্ঞানীরা তবে রায় দিয়েছেন হাতির প্রাথিমক বিবর্তন শুরুর প্রাক্কালের হাতি বর্গের আলাদা একটি শাখা হিসাবে। ফসিল হতে প্রাপ্ত দাঁতের গঠন প্রমাণ করে তাদের আবাসস্থিল ছিল পানিতে, নানান প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ ছিল তাদের প্রধান খাবার। জীবণ যাপন করত অনেকটা জলহস্তির মত। মাথার খুলি দেখে বুঝা যায় তাদের কোন শুড় ছিল না। তবে উভয় চোয়ালের দু’পাশেই ছিল দুটো করে চারটি প্রলম্বিত বড় দাঁত। আরো কিছু পরে দক্ষিণ, পশ্চিম আফ্রিকা ও আলজেরিয়াতে মোইরিথিয়ামের আরো বেশ কিছু ফসিল পাওয়া যায়।
প্রায় ৩৫-৩৬ মিলিয়ন বছর আগে ইওচিনি যুগের শেষদিকে এবং ওলিগোচিনি যুগের শুরুতে এই পালাইয়োমাচটোডোনরা ঘুরে বেড়াত পৃথিবীর বুকে। ওলিগোচিনি যুগেই বিভিন্ন প্রকার স্তন্যপায়ী প্রাণীর(ম্যামেলদের) পূর্ণ বিকাশ ঘটতে শুরু করে। যেমনঃ প্রাইমেট বর্গের প্রাণী বানর প্রজাতির বিভিন্ন শাখায় বিবর্তনের লক্ষণ প্রকাশ পেতে থাকে এই যুগে। একি সাথে দানব ও হিংস্র প্রজাতির মাংসাশী বিভিন্ন প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণীদের বিকাশ লাভ ঘটতে থাকে। আফ্রিকা মহাদেশের মিশরে পালাইয়োমাচটোডোনদের প্রথম ফসিল পাওয়া যায়। অনুমান করা হয় এরা ৩-৬ ফুট লম্বা ছিল, ওজন ছিল প্রায় দুই টনের মত।
পানি থেকে জলজ উদ্ভিদ টেনে তুলতে পারার সুবিধার জন্য উপরের চেয়ে নীচের চোয়াল বেশ কিছুটা লম্বা ও চ্যাপ্টা মত শাবল আকৃতির ছিল। উভয় চোয়ালে দুটি করে মোট চারটি প্রলম্বিত দাঁত ছিল বটে তবে খাদ্য অন্বেষণ সহজ করতে নীচের চোয়ালের দাঁত দুটো কিছুটা লম্বা হয়ে যায়। এই পালাইয়োমাচটোডেনকে বিবেচনা করা হয় মোইরিথেরিয়াম প্রজাতি থেকে পৃথক হয়ে বর্তমান হাতির রূপান্তরের প্রাথমিক শাখা হিসাবে। এক কথায় হাতির পূর্ব পুরুষ। এদের নাক খানিকটা লম্বা হয়ে বের হয়ে উঁকি মারতে শুরু করে। পরবর্তীতে এই নাক ধীরে ধীরে নীচের দিকে আরো লম্বা হয়ে কোন একসময় শুড়ের রূপ নেয়।
প্রায় ২৩.০৩ লক্ষ বছর থেকে ৫.৩৩২ লক্ষ বছর পূর্বের যুগটিকে বিজ্ঞানীরা অভিহিত করেছেন মিউচিনি(Miocene) যুগ নামে। এই যুগেই বিভিন্ন প্রজাতির তৃণভোজি প্রাণীর বিকাশ লাভ করে। যেমনঃ উট, ঘোড়া, হরিণ ইত্যাদি। একি সাথে আরো কিছু ছোট খাট প্রাণী যেমনঃ ব্যাঙ, ইঁদুর, সাপ, পাখি, নেকড়ে, কুকুর জাতীয় প্রাণীর দ্রুত বিস্তার ঘটে এই যুগে। ৫.৩৩২ থেকে ২.৫৮৮ লক্ষ বছর আগের যুগটিকে বলা হয়েছে পলিওচিনি(Pliocene)।
এই যুগেই আবহাওয়া ক্রমেই শীতল ও শুষ্ক হয়ে বর্তমান আবহাওয়ার প্রায় সমপর্যায়ে চলে আসে। বৃষ্টি হীনতা ও অতিরিক্ত শুষ্ক আবহাওয়ার কারণে এশিয়া ও আফ্রিকার কিছু কিছু অঞ্চলে মরুভূমির উৎপত্তি হয়। আবার কিছু কিছু অঞ্চলে পর্যাপ্ত বৃষ্টিপাত হওয়ায় তৃণভূমির সবুজ আস্তর গড়ে ওঠে। খোলসে ঢাকা শামুক ঝিনুকের বিস্তার শুরু হয় জলাভূমি গুলোতে। খাদ্য শিকারের মত কঠিন প্রয়োজনে দক্ষতা ও গতি বেড়ে গিয়ে উৎপত্তি হয় দ্রুত গতির শক্তিশালী ভাল্লুকের।
হোমো বর্গের প্রাণীরা গাছে ও স্থলে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরী করে। ১২-১৬ মিলিয়ন বছর পূর্বে মিওচিনি ও পলিওচিনি এই দুই যুগের সন্ধি ক্ষণে উত্তর আমেরিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোশিয়া সহ আরো কিছু দেশে বিশেষ করে খাদ্যসহ উপযুক্ত বাসস্থানের খোঁজে গমফোথেরেস ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। ৫ মিলিয়ন বছর পূর্বে এই গমফোথেরেস প্রজাতিটি ধীরে ধীরে বর্তমান হাতিতে রূপান্তরের দিকে ধাবিত হয়। লম্বায় ছিল এরা ৬-৭ ফুটের মত। এক মিলিয়ন বছর আগেও হাতির বড় ভাই গমফোথেরেস প্রজাতিটিকে পৃথিবীর বুকে চড়ে বেড়াত বলে অনুমান করা হয়।
এই হাতি প্রজাতির অন্যতম বৈশিষ্ট ছিল ধনুকের মত বাকানো বিশাল দন্ত যুগল। যা লম্বায় ছিল প্রায় শুড়ের কাছাকাছি। অবশ্য ম্যামথদের অনুরুপ দাঁত ছিল। তবে মাথার আকৃতি ম্যামথদের তুলনায় মাস্টোডোনের কিছুটা চ্যাপ্টা। ২০০৭ জুলাই গ্রীস রাজ্যের গ্রীভেনা(Grevena) অঞ্চলের নিকটবর্তী গ্রামে ২৫-৩০ বছর বয়সি পুরুষ মাস্টোডোনের একটি দাঁত পাওয়া যায় যার ওজন প্রায় ১ টন আর লম্বায় ৫মিটার। মাস্টোডোনের প্রাপ্ত ফসিল থেকে দেখা যায় এদের পেষন দাঁত গুলোর মাথা স্তন্যের বোটার মত কিছুটা উঁচু যা প্রমাণ করে এরা তৃণভোজী প্রকৃতির ছিল।
৩৩.৯ মিলিয়ন বছর থেকে প্রায় ১১,০০০ বছর পূর্ব পর্যন্ত এশিয়া, আফ্রিকা, ইউরোপ, আমেরিকার সর্বত্রই ছিল এদের বিচরণ। মাস্টোডোনের ১ম ফসিলটি পাওয়া যায় আফ্রিকার কঙ্গোতে। এরপর একে একে ইংল্যান্ড, জার্মানি, নেদারল্যান্ড, উত্তর আমেরিকাকে এদের ফসিল পাওয়া যায়। আকৃতিতে এরা বর্তমান হাতি এবং ম্যামথদের সমপর্যায়ের ছিল। একেবারেই অক্ষত ফসিলটি পাওয়া যায় রুমানিয়ায়। বিশ্বাস করা হয় সর্বশেষে ১০,০০০ বছর আগে এরা ঘুরে বেড়াত আমাদের সবুজ গ্রহে।
প্রাইমেলেফাস(Primelephas) মানে “প্রথম হাতি” স্বাভাবিক ভাবেই তাই এই বর্গের হাতির নাম করণে রয়েছে তার পরিষ্কার আভাস। এই বর্গের হাতি বিবেচিত হয়েছে বর্তমান হাতির সবচেয়ে নিকট পূর্ব পুরুষ হিসাবে। মিউচিনি ও পলিউচিনি যুগে এদের বিকাশ। অনুমান করা হয় আজ থেকে প্রায় ৫-৭ মিলিয়ন বছর পূর্বে এই প্রাইমেলেফাস বর্গের হাতি অতি ধীরে বিবর্তনের নানান জটিল ধাপ পেরিয়ে দুটি ভিন্ন প্রজাতিতে ভাগ হয়ে প্রাইমেলেফাসের স্বকিয়তা বিলুপ্ত করে। যার একটি প্রজাতি এগিয়ে যায় বরফ যুগের অতিরিক্ত ঠান্ডা সহ্য করার ক্ষমতা সম্পন্ন ঘন দীর্ঘ লোমশ ম্যামথ প্রজাতিতে অপর প্রজাতিটি উষ্ণতা সহ্য করার ক্ষমতা সম্পন্ন আফ্রিকান হাতি ও এশিয়ান হাতি প্রজাতিতে। এদের উপর ও নীচের চোয়ালে দু’জোড়া করে মোট চারটি প্রলম্বিত দাঁত ছিল তবে নীচের দাঁত জোড়ার তুলনায় উপরের দাঁত দুটি অপেক্ষাকৃত অধিক লম্বা ছিল।
ইংরেজী শব্দে বিশালত্বের পরিমাপ বোঝাতে “ম্যামথ” শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। যার সোজা বাংলা করলে দাড়ায় “প্রকান্ড” বা “বিশাল”, এক একটি ম্যামথ ১০-১২ ফুট উচ্চতা বিশিষ্ট ছিল। ওজন ছিল প্রায় ৮ টনের মত। ছিল প্রকান্ড লম্বা দুটি দাঁত। সারা শরীর আবৃত ছিল পাটের মত ঘন দীর্ঘ রেশমি লোমে। “ম্যামথ” শব্দটি মূলত এসেছে রাশিয়ার এক আঞ্চলিক ভাষা থেকে। যেখানে ম্যামথের অর্থ করা আছে “ধরিত্রির শিং” (Eearth horn)।
সম্ভবত দাঁত গুলো দেখতে শিং আকৃতি হওয়ায় এই নাম করণ। ম্যামথ বিলুপ্তির প্রকৃত কারণ এখনো নিশ্চিত জানা না গেলেও মোটামুটি ধারণা করা হয় আজ থেকে প্রায় ৭-৮ হাজার বছর আগে বৈশ্বিক উষ্ণতা পরিবর্তনের ফলে অন্যান্য অনেক প্রাণীর মত এরাও পৃথিবী থেকে একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়। আশার কথা প্রাণী বিজ্ঞানীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন ম্যামথকে আবার পৃথিবীর বুকে ফিরিয়ে আনার।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে ক্রমাগত উষ্ণতা পরিবর্তনের মত কঠিন ধাপ পেরিয়ে বর্তমানে টিকে থাকা আমাদের চির চেনা হাতি প্রজাতিটি দু’ভাগে ভাগ হয়ে পড়েছে। একটি ভাগের নাম এশিয়ান হাতি যার বৈজ্ঞানিক নাম দেয়া হয়েছে Elephas maximus।
লক্ষ লক্ষ বছর এশিয়া ও আফ্রিকায় তিথু হয়ে বসবাসের ফলে আবহাওয়া জনিত কারণে মানুষের মত এই হাতি প্রজাতিতে চলে আসে আকার আকৃতি ও গঠন গত কিছু ভিন্নতা। আসুন পার্থক্যগুলো একনজরে দেখে নেয়া যাক।
লম্বায় সাধারণত এশিয়ান হাতি ৬-১১ফুট হয়ে থাকে আর আফিকান হাতি হয় ৬-১৩ ফুট। গড় ওজন এশিয়ান হাতির যেখানে ২-৫ টন, আফ্রিকান হাতির সেখানে ২-৭ টন। এশিয়ান হাতির গায়ের রং বেশ ফর্সা ও মসৃণ তুলনা মূলকভাবে আফ্রিকান হাতির গায়ের রং কালসেটে ও কুচকানো। কানের আকৃতি নিশ্চত প্রমাণ দেয় কোনটা আফ্রিকান আর কোনটা এশিয়ান। আফ্রিকান হাতির আছে প্রকান্ড কান যা দিয়ে প্রচন্ড গরমে বাতাস করে নিজের গা নিজেই জুড়িয়ে নিতে পারে। পক্ষান্তরে এশিয়ান হাতির আছে ছোট কান। ভুরির আকৃতিতেও দেখা যায় ভিন্নতা।
এশিয়ান হাতিদের ভুরি গলা থেকে নীচের দিকে অনেকটা সমান। আর আফ্রিকানদের বেলায় গলা থেকে ভুরি ক্রমান্বয়ে নীচের দিকে ঝুলে আসে। এশিয়ান হাতিদের বুকের পাঁজরের হাড় এক জোড়া কম অর্থাৎ আফ্রিকান হাতির রয়েছে ২১ জোড়া হাড় আর এশিয়ান হাতির ২০ জোড়া। আফ্রিকান স্ত্রী পুরুষ উভয় হাতির প্রলম্বিত দাঁত আছে কিন্তু এশিয়ান হাতিদের ক্ষেত্রে শুধু পুরুষ হাতিদের এই দাঁত দেখা যায়। এশিয়ান হাতির শুড় তুলনামূলক একটু শক্ত ও শুড়ের শেষ প্রান্ত একদিক সামান্য বেড়িয়ে থাকে আঙ্গুলের মত। যা তাকে যে কোন জিনিস শক্ত ভাবে ধরতে সাহায্য করে। আফ্রিকান হাতিদের শুড়ের শেষ প্রান্তে দু’দিক বেড়িয়ে থাকে। খাদ্য পছন্দের তালিয়ায় এশিয়ান হাতিরা বেশি পছন্দ করে ঘাস পক্ষান্তরে আফ্রিকান হাতির পছন্দ পাতা।
আপনার মতামত জানানঃ