বাংলার নবাবি আমলের ইতিহাসের বেশ খানিকটা অংশজুড়ে রয়েছে ভালোবাসা, লোভ-লালসা, বিশ্বাসঘাতকতা আর যুদ্ধের ঝনঝনানি। ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লিপিবদ্ধ রয়েছে অজস্র প্রাচীন কাহিনি। সেখানে ইতিহাসকে বারবার সামনে এনেছে ভালোবাসা আর ত্যাগের মহিমা। অন্যদিকে কলঙ্কিত আর রঞ্জিত করেছে বিশ্বাসঘাতকতা।
এমনই একজনের মর্মান্তিক পরিণতির কথাই জানাবো আজ। যিনি চিরকালই বাংলা ছাড়াও বিশ্বজুড়ে বিশ্বাসঘাতকের সেরা উদাহরণ। তিনি নিজেও এক বিশ্বাসঘাতকের পুত্র হিসেবে বেশি পরিচিতি পেয়েছেন। অবলীলায় হত্যা করতেন তিনি।
কথিত আছে, বাংলার স্বাধীন ও শেষ নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যার পর এক বিরাট তালিকা তৈরি করেছিলেন মীর মিরন। সেখানে ছিল নবাব সিরাজউদ্দৌলার আত্মীয় স্বজনদের নাম। তার ইচ্ছা ছিল সিরাজউদ্দৌলার বংশের কাউকে তিনি বাঁচিয়ে রাখবেন না। ইতিহাসখ্যাত সেই দুর্ধর্ষ যুবকই হলেন বিশ্বাসঘাতক মীরজাফরের পুত্র মিরন।
তার পুরো নাম মীর সাদিক আলী খান বাহাদুর। তবে মীর মিরন নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন তিনি। ক্লাইভের প্রতিনিধি ওয়াটসনের সঙ্গে গোপন ষড়যন্ত্রে মীর জাফরের সার্বক্ষণিক সঙ্গী ছিলেন তার পুত্র মীর মিরন। রহস্যময় মৃত্যু কাহিনীর মতোই তার সমাধি নিয়ে রয়েছে নানা মত।
অনেকেই বলেন, প্রাচীন বাংলার রাজধানীর রাজমহলেই রয়েছে মিরনের সমাধি। আবার অনেকের ধারণা, তার সমাধি এটা নয়। মিরন ছিলেন খুবই অমানবিক এবং নৃশংস। তার চির প্রতিদ্বন্দ্বী সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করতে নানা ছক কষতে থাকেন। সিরাজউদ্দৌলা ব্রিটিশদের কাছে ধরা পড়েন ১৭৫৭ সালের ৩ জুলাই। বন্দী করে রাখা হয় তাকে।
এর পরের দিন ৪ জুলাই মীর জাফরের আদেশে তার পুত্র মিরনের তত্ত্বাবধানে মুহম্মদিবেগ সিরাজউদ্দৌলাকে হত্যা করে। কথিত আছে, সিরাজের মৃত্যুর পর তার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। এরপর সিরাজউদ্দৌলার ছোট ভাইসহ পরিবারের অনেক সদস্যকে হত্যা করেন মিরন।
সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের নারী সদস্যদের বন্দী রাখা হয় ঢাকার জিঞ্জিরা প্রাসাদে। সেখানকার লোকদের বারবার নির্দেশ দেয়া হয় সবাইকে মেরে ফেলতে। তবে তারা তা না করায় নিজেই বুদ্ধি বের করেন মিরন। মুর্শিদাবাদে ফিরিয়ে আনার কথা বলে তাদের নৌকায় চড়ানো হয়। এরপর মাঝ নদীতে নৌকা ডুবিয়ে হত্যা করা হয় সিরাজের মা আমেনা, খালা ঘষেটি বেগমকে। ক্লাইভের হস্তক্ষেপের ফলে শরফুন্নেসা, সিরাজের স্ত্রী লুৎফুন্নেসা এবং তার শিশুকন্যা উম্মে জোহরা রক্ষা পান এবং পরবর্তীতে তাদেরকে মুর্শিদাবাদে আনা হয়।
ইংরেজ কোম্পানি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত সামান্য বৃত্তির ওপর নির্ভর করে তাদেরকে জীবন ধারণ করতে হয়। সে সময় মৃত্যুর পূর্বে সিরাজের মা আমেনা মিরনকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, সে যেন বজ্রাঘাতে মারা যায়। তার কথাই সত্যি হয়েছিল।
নিজ প্রাসাদে ওয়াটসনের সামনে মীর জাফর মাথায় পবিত্র কোরআন নিয়ে যখন ব্রিটিশদের পক্ষে কাজ করার প্রতিজ্ঞা করেন, তখন মীর জাফরের আরেক হাত ছিল তারই পুত্র মীর মিরনের মাথায়। নিজ মাথায় পবিত্র কোরআন আর নিজ পুত্র মিরনের মাথায় হাত রেখে জঘন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার পরিণতি দেখতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হয়নি বাবা মীর জাফরকে।
পলাশীর যুদ্ধের তৃতীয় বর্ষ পার হয়েছে মাত্র। এর মধ্যেই নবাবেরর সৈন্য মিরনের নির্দেশে এবং ব্রিটিশদের সহায়তায় রাজমহলের কাছাকাছি আজিমাবাদে যুদ্ধে চলে যায়। দিল্লির বাদশাহ শাহ আলম ও পুর্নিয়ের শাসক খাদেম হোসেনের যৌথ বাহিনীর মোকাবিলা করতে। এই যুদ্ধে মিরন বেশ বুদ্ধিমত্তা আর সাহসের পরিচয় দেয়।
এই যুদ্ধেই তার জীবনের কাল ঘনিয়ে এলো। দিনটি ছিল ১৭৬০ সালের ৩ জুলাই। ঘোর বর্ষাকাল। আজিমাবাদে যুদ্ধে আছেন মীর মিরন। এতোটাই ঝড়-বৃষ্টি শুরু হয় যে সৈন্যরা সবাই তাবুতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়। মিরন তার জন্য তৈরি বড় তাবুতে ছিলেন। তবে অনেক বেশি ঝড় হওয়ায় তার তাঁবু ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এরপর ছোট একটি তাবুতে আশ্রয় নেন মিরন।
সেসময় তার সঙ্গে তার বিশ্বস্ত দুই চাকর ছিল। যাদের একজনের কাজ ছিল মিরনের শরীর ম্যাসাজ করা আর অন্যজন মিরনকে কাহিনি শুনিয়ে ঘুম পারাতেন। ঘটনার দিন মিরন ঘুমিয়ে গেলে তারাও সেই তাবুতেই ঘুমিয়ে পড়ে। এরপরই প্রচণ্ড শব্দে শুরু হয় বজ্রপাত। হঠাৎই বজ্রপাতে মিরনের তাবুতে আগুন লেগে যায়। মিরনের সঙ্গে থাকা চাকর দুটিও মারা যায় সেদিন।
পুত্রের যে মাথায় হাত রেখে বাবা অপকর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন, সেই মাথায়ই অর্থাৎ মীর মিরনের মাথায় বজ্রাঘাত পড়ে। মিরনের বয়স তখন মাত্র ২১ বছর। বৃষ্টি থেমে গেলে অন্যরা সেখানে গিয়ে দেখতে পায় মিরনের পুড়ে যাওয়া দেহ। এমনকি তার তরবারিও গলে গিয়েছিল আগুনের তাপে। মিরনের শোয়ার খাটও পুড়ে ছাই হয়ে যায় আগুনে।
এভাবেই মাত্র ২১ বছর বয়সে মারা যান ইতিহাসের কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক মীর মিরন। সেদিন সিরাজের মা আমেনার অভিশাপও যেন ফলে যায়। তবে মিরনের মৃত্যু নিয়ে অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেছেন। কেননা ইংরেজদের সঙ্গে মিরনের তেমন বনিবনা হয়নি। তারাও বেশ ভয় পেত মিরনকে। তাই অনেকে মনে করেন ইংরেজরা মিরনের তাবুতে আগুন দিয়ে তাকে হত্যা করেছে।
সেনাপতির মৃত্যুতে সৈন্যরা রেগে গিয়ে যদি কিছু করে বসে। তাই মিরনের মৃত্যু সংবাদও গোপন করা হয়। মিরনের মৃতদেহ হাতির পিঠে উঠিয়ে নিয়ে আসা হয় রাজধানীতে। যেভাবে সিরাজউদ্দৌলার মৃতদেহ হাতির পিঠে চড়িয়ে সারা শহর ঘোরানো হয়। মিরনকে এমনভাবে আনা হয় যেন সে অসুস্থ। তবে মিরনের মৃতদেহ থেকে দুইদিন পরেই দুর্গন্ধ ছড়াতে থাকে। তাই মুর্শিদাবাদে নিয়ে আসা সম্ভব হয়নি।
নৌকায় করে পানিপথে মিরনের মৃতদেহ আনার ব্যবস্থা করা হয়। অবশেষে মিরনের গলিত মৃতদেহ এসে পৌঁছায় রাজমহলে। শরিফাবাজারে গলিত দুর্গন্ধযুক্ত মিরনকে সমাধি দেয়া হয়। এজন্যই মুর্শিদাবাদের জাফরাগঞ্জে মীর জাফরের বংশের নিজস্ব কবরস্থানে মীর মিরনের সমাধি নেই। শেষবারের মতো পুত্রের মুখ দেখার সৌভাগ্য হয়নি মীর জাফরের।
বর্তমানে ঝোপ আর জঙ্গলে প্রায় হারাতে বসেছে মিরনের সমাধি। একসময়ের হবু নবাবের করুণ পরিণতি ইতিহাস বেশ উজ্জ্বল করেই রেখেছে। অন্যান্য ষড়যন্ত্রকারীদেরও হয়েছিল ভয়ংকর পরিণতি। কেউই নিজেদের পাপের ফল থেকে রক্ষা পায়নি।
আপনার মতামত জানানঃ