দেশ-বিদেশের সন্তানহীন দম্পতিদের ক্রমবর্ধমান চাহিদার কারণে ভারতে গর্ভ ভাড়া দেয়ার ব্যবসা ক্রমশ ফুলেফেঁপে উঠছে৷ ভারতে গর্ভ ভাড়া সহজলভ্য ও খরচ কম হওয়ায় গর্ভ ভাড়া বা সারোগেসি বাণিজ্যের বাজার দাঁড়িয়েছে কয়েক হাজার কোটি টাকার মতো৷
সারোগেসি আসলে একটি সহায়ক প্রজনন-ভিত্তিক পদ্ধতি। যেখানে কাঙ্খিত বাবা-মা অন্য নারীর গর্ভ ভাড়া করেন। ওই গর্ভধারিণী মাকে বলা হয় সারোগেট। ওই নারীরাও অর্থের বিনিময়ে অন্যের শিশু গর্ভে ধারণ করেন।
সারোগেসির অর্থ হলো অন্যের সন্তানকে নিজের গর্ভে ধারণ করা। গর্ভকালীন সময়ে ওই দম্পতি সারোগেট মায়ের গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যের সম্পূর্ণ যত্ন নেয় ও সব ধরনের খরচের দায়িত্ব নেয়।
যে সব দম্পতি সহজে গর্ভধারণ করতে পারেন না কিংবা কেউ যদি সিঙ্গেল প্যারেন্টস হতে চান, তারাই সারোগেসি পদ্ধতি বেছে নেন সন্তানলাভে।
ইনফার্টিলি, স্বাস্থ্য জনিত সমস্যা, সমলিঙ্গের অভিভাবক ও অন্যান্য সমস্যার কারণেই মূলত অন্যের গর্ভ ভাড়া নিয়ে সন্তান লাভ করা হয় এ পদ্ধতি।
সারোগেসির পদ্ধতি কী?
এ বিষয়টি সবারই জানা যে, সন্তান ধারণের জন্য নারী ও পুরুষের মধ্যে যৌনসম্পর্ক থাকা প্রয়োজন। তবে যেসব নারীর সন্তান হয় না কিংবা একক বাবা-মা বা সমলিঙ্গের অভিভাবক যারা সন্তান জন্ম দিতে পারেন না তারাই সারোগেট মাকে ভাড়া করেন।
সারোগেসির জন্য শুধু সারোগেট মাকে প্রয়োজন। প্রথমে শারীরিক ও মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হয়। এরপর যে দম্পতি সন্তানের মা-বাবা হতে চাচ্ছেন, ওই পুরুষের শুক্রাণু নিয়ে আইভিএফ কৌশলের মাধ্যমে সারোগেট নারীর গর্ভে প্রতিস্থাপন করা হয়।
আইভিএফ প্রযুক্তি সারোগেসির অন্যতম এক মাধ্যম। আইভিএফ হলো ‘ইন ভিট্রো ফার্টিলাইজেশন’। ডয়চে ভেলের এক স্বাস্থ্য প্রতিবেদনে ইশা ভাটিয়া স্যানন ব্যাখ্যা করেন, নিষিক্তকরণের অর্থ হলো পুরুষের শুক্রাণু ও নারী ডিম্বাণুর মিলন।
যেখান থেকে ভ্রূণ তৈরি হয়। ইন ভিট্রো অর্থ কাচের ভেতরে। এক্ষেত্রে বলা হয় টেস্টটিউব পদ্ধতি। এ কারণেই কৌশলটি টেস্টটিউব বেবি নামেও পরিচিত।
এ পদ্ধতির মাধ্যমে নারীর শরীরের ভেতরে যে প্রক্রিয়াটি ঘটে, সেটিই টেস্টটিউবের মাধ্যমে ল্যাবে করা হয়। পুরুষের শুক্রাণু গ্রহণের পর নারীর শরীর থেকে ডিম্বাণু বের করে একটি সূচের মাধ্যমে শুক্রাণুতে প্রবেশ করানো হয়।
এরপর কাচের ভেতর ভ্রূণ প্রস্তুত করা হয়। এরপর একটি মেডিকেল টিউবের মাধ্যমে সারোগেট নারীর জরায়ুতে প্রবেশ করানো হয়। এই পুরো ব্যবস্থাটিই হলো সারোগেসি পদ্ধতি। এভাবেই নিঃসন্তান দম্পতি অন্যের গর্ভ ভাড়া নিয়ে সন্তানের জন্ম দেন।
সারোগেসিতে কী স্বাস্থ্যের ঝুঁকিও আছে?
বিশেষজ্ঞদের মতে, সারোগেসি খুব একটা সহজ পদ্ধতি নয়। এর ফলে একাধিক জটিলতা ও ঝুঁকি থাকে। প্রথমত, ভ্রূণের জীবনের প্রিইমপ্ল্যান্টেশন, প্রসবপূর্ব ও নবজাতক সময়কালে ব্যর্থতার সম্ভাবনা থাকে।
ডিম্বাশয় উদ্দীপনা, পরবর্তী আইভিএফ চক্র ও আইভিএফ ও জেনেটিক ল্যাবরেটরির মধ্যে ভ্রূণ, পেরিনেটাল ও নবজাতক সময়ের মধ্যে নিযুক্ত কৌশলগুলোর মতো একাধিক জটিল চিকিৎসা পদ্ধতি আছে।
এক্ষেত্রে কষ্টের বিষয় হলো, সারোগেট মায়েরা যদিও অর্থের বিনিময়ে সন্তানের জন্ম দেন, তবুও তো তারা সন্তানকে পেটে ধরেন।
ওই সন্তানের প্রতি মায়া ও ভালোবাসা তৈরি হয়ে যায় সারোগেট মায়ের। অথচ জন্মের পরপরই ওই শিশুকে তুলে দিতে হয় তার বাবা-মায়ের কাছে। এ করুণ দৃশ্যই দেখানো হয়েছে ‘মিমি’ ছবিতে।
সারোগেসিতে কত খরচ হয়?
আইভিএফ বা টেস্টটিউব বেবির ক্ষেত্রে ভারতের খরচ আনুমানিক ৬০ হাজার থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়াও সারোগেট মায়ের সুস্থতা ও চিকিৎসায় তার পেছনেও অনেকটা খরচ হতে পারে।
সারোগেসির মাধ্যমে সন্তান পেতে অনেক ক্ষেত্রে সারোগেট মায়ের আনুষঙ্গিক খরচের পরিমাণ ৩০-৫০ লাখ টাকাও হতে পারে। যদিও বর্তমানে বিভিন্ন দেশে গর্ভ ভাড়া দেওয়া বা সারোগেসি পদ্ধতি অবলম্বন করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ।
সারোগেসির নতুন আইন কী বলছে?
বাণিজ্যিকভাবে সারোগেসি ভারতে নিষিদ্ধ। অর্থাৎ পয়সার বিনিময়ে সন্তান ধারণের জন্য গর্ভ ভাড়া দেওয়া আইনবিরুদ্ধ।
“এদেশে এবিষয়ে কড়া আইন রয়েছে যার মূল লক্ষ্য হল, বাণিজ্যিক সারোগেসি এবং এ সংক্রান্ত সমস্ত রকমের অনিয়ম বন্ধ করা,” বলছিলেন বন্ধ্যাত্ব ও প্রজনন বিশেষজ্ঞ মাধব চন্দ্র দাস।
বিদেশি দম্পতি, প্রবাসী ভারতীয়, একক বাবা-মা, অবিবাহিত কিন্তু একসঙ্গে থাকেন এমন দম্পতি, সমকামী যুগল – এমন অনেকেই সারোগেসির জন্য এতদিন ভারতকে বেছে নিতেন। সেই চল রুখতে, কড়া আইন পাশ করা হয়েছে এদেশে।
ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ মেডিক্যাল রিসার্চ ২00৫ সালে সারোগেসি সংক্রান্ত বিষয়ে একটি নির্দেশিকা জারি করেছিল। এরপর ২০১0 সালে, সরকার সহায়ক প্রজনন প্রযুক্তি (নিয়ন্ত্রণ) বিলে আরও কিছু নিষেধাজ্ঞার উল্লেখ করে।
‘দি অ্যাসিস্টেড রিপ্রোডাক্টিভ টেকনোলজি অ্যান্ড সারোগেসি অ্যাক্ট’, যা ওই দুটির উপর ভিত্তি করে তৈরি, তা ভারতে কার্যকর হয়েছে ২৫শে জানুয়ারি ২০২২ থেকে।
এই আইন বলছে এ দেশে সারোগেট মা হতে পারেন সন্তানের পিতা-মাতার খুব নিকট কোনও আত্মীয়, যার বয়স ২৫-৩৫ এর মধ্যে। গর্ভদাত্রী মা একবারের বেশি সারোগেট সন্তান ধারণ করতে পারবেন না।
সারোগেট মায়ের চিকিৎসার খরচ বহন করতে পারেন যে নিঃসন্তান দম্পতি পিতা-মাতা হতে চান। তা ছাড়া আর কোনও টাকাপয়সার আদান প্রদান হতে পারবে না।
শুধু তাই নয়, আইন লঙ্ঘন করে, মানে অর্থের বিনিময়ে সারোগাসির ক্ষেত্রে সর্বাধিক ১০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত জরিমানা ও ১০ বছরের জেল পর্যন্ত হতে পারে।
ভারতে সারোগেসি কি একেবারেই বন্ধ?
আইনত নিষিদ্ধ হলেও অর্থের বিনিময়ে সারোগেট মা হয়েছেন, এমন বেশ কিছু ঘটনা কিন্তু ভারতের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উঠে এসেছে।
চলতি বছরের অগাস্ট মাসে কলকাতা পুলিশ অভিযান চালিয়ে একটি শিশুপাচার চক্রের হদিশ পায়, যারা অর্থের বিনিময়ে সারোগেট মা খুঁজে দেয়ার মতো কাজও করত।
সেই চক্রের মূল চাঁই, এজেন্ট, সাব-এজেন্ট সহ প্রায় ১০০ জনকে ওই অভিযানে আটক করে পুলিশ। অভিযান চলাকালীন দক্ষিণ কলকাতার একটি নামকরা আইভিএফ ক্লিনিকের খোঁজও মেলে, যারা ওই চক্রের সঙ্গে যুক্ত।
সে সময় কলকাতা পুলিশ সংবাদ মাধ্যমকে জানিয়েছিল, মমতা পাত্র নামে এক মহিলাকে তাঁরা গ্রেফতার করেছে, যিনি নিজে অর্থের বিনিময়ে সারোগেট মা হয়েছিলেন।
দক্ষিণ কলকাতার ওই আইভিএফ ক্লিনিকের সঙ্গে মিস পাত্রের যোগাযোগ ছিল বলেও পুলিসের তরফে সে সময় সংবাদমাধ্যমকে জানানো হয়েছিল।
শুধু তাই নয়, তিনি এজেন্ট মারফত আর্থিকভাবে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের পয়সার বিনিময়ে গর্ভধারণের জন্য প্রস্তাব দিয়ে যোগাযোগ করতেন বলেও জানানো হয়েছিল।
কলকাতা পুলিশ তখন বলেছিল, ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে এজেন্টরা আর্থিক ভাবে পিছিয়ে পড়া মহিলাদের গর্ভধারণের জন্য রাজি করান।
শিশুর জন্মের পরে, চার বা পাঁচ লক্ষ টাকার বিনিময়ে সদ্যোজাতকে দম্পতিদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। এই টাকার কিছু অংশ গর্ভদাত্রী মা পেলেও বেশির ভাগটা এজেন্ট, সাব এজেন্ট ও এই চক্রের সঙ্গে যুক্ত মূল অপরাধীদের হাতে চলে যায়।
“পুরো বিষয়টিই যারা সন্তান চাইছেন তাঁদের আর্থিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে। অনেক ক্ষেত্রে এই দেওয়া নেওয়ার অঙ্কটা ছয়-সাত লক্ষ বা তার বেশিও হয়,” বলেন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কলকাতার এক চিকিৎসক।
আপনার মতামত জানানঃ