ইতিহাস তৈরি করল ফিদেল কাস্ত্রোর দেশ কিউবা। কয়েক দশকের সমকামীদের ওপর ব্যাপক নিপীড়নের পর সমলিঙ্গ বিয়ে ও সারোগেসিকে (সন্তান জন্ম দিতে গর্ভ ভাড়া নেয়া) বৈধতা দেওয়ার পক্ষে রায় দিয়েছে দেশটির জনগণ। ফলে এবার থেকে এই কমিউনিস্ট দেশের সমকামীদের আর কোনও বাধার মুখে পড়তে হবে না। খবর রয়টার্স, বিবিসি।
কিউবা সরকার সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে নতুন ‘ফ্যামিলি কোড’ বা পরিবার পরিকল্পনা আইন প্রণয়নের উদ্যোগ নেয়। সেখানে সমলিঙ্গ বিয়ের, পাশাপাশি সমকামী দম্পতিদের সন্তান দত্তক নেয়ার অধিকার, সারোগেসিকে বৈধ করার মতো সব বৈপ্লবিক পরিবর্তনের কথা বলা হয়। যদিও এই বিপুল পরিবর্তন দেশের মানুষের উপর চাপিয়ে দিতে চায়নি মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেলের কমিউনিস্ট সরকার। তারা সংবিধান মেনে গণভোটের সিদ্ধান্ত নেয়। সোমবার সেই গণভোটের ফল প্রকাশিত হয়েছে।
১০০ পাতার ‘ফ্যামিলি কোড’ বিলের উপর আয়োজিত গণভোটে প্রায় ৫০ লক্ষ ৮৫ হাজার কিউবান ভোট দেন। তারমধ্যে বিলের স্বপক্ষে, মানে সমলিঙ্গ বিয়ে, সারোগেসির অধিকার ইত্যাদির পক্ষ ভোট দেন ৩৯ লক্ষ মানুষ (৬৬.৯ শতাংশ)। আর বিপক্ষে ভোট দেন ১৯ লক্ষ ৫০ হাজার মানুষ (৩৩ শতাংশ)।
সোমবার সে দেশের সরকারি টেলিভিশনে ভোটের এই ফল ঘোষণা করেন নির্বাচন কমিশনের প্রধান অ্যালিনা বালসেইরো গুতিরেজ। এই ঐতিহাসিক এই ফল ঘোষণার পরই প্রেসিডেন্ট মিগুয়েল দিয়াজ ক্যানেল ট্যুইট করেন, ন্যায় হয়ে গিয়েছে।
এই নতুন আইন পাশ হয়ে যাওয়ার ফলে কিউবার সমকামীরা যেমন বিয়ে করতে পারবেন, তেমনই বিনা ঝঞ্ঝাটে সন্তান দত্তক নিতে পারবেন। সেক্ষেত্রে পরিবারে সমকামী দম্পতিদের সমান অংশিদার থাকবে। তবে সারোগেসি আইনসিদ্ধ হলেও তার জন্য বেশকিছু নিয়ম মানতে হবে।
১৯৬০ এবং ১৯৭০ এর দশকে সমকামীদের ওপর ব্যাপক নিপীড়ন চালানো, তাদেরকে শ্রম শিবিরে পাঠানো কিউবার জন্য এই গণভোট ‘বড় ধরনের বাঁক বদল’ হিসেবে গণ্য হচ্ছে।
দেশটির সিংহভাগ মানুষ এখন সমকামী বিয়ের পক্ষে রায় জানালেও বিপুল সংখ্যক মানুষ এর বিরোধিতাও করছে।
নতুন পারিবারিক আইনের জন্য হওয়া ওই গণভোট যে ১০০ পৃষ্ঠার নথির ওপর হয়েছে, তা ঠিক করতে দুই ডজনের বেশি খসড়া লিখতে হয়েছে, কমিউনিটি পর্যায়ে বৈঠক হয়েছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
কিউবার ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টি আইন পরিবর্তনের পক্ষে অবস্থান নেয় এবং জনগণের সম্মতি আদায়ে দেশজুড়ে ব্যাপক প্রচারও চালায়।
রোববার ভোট দেওয়ার সময় দেশটির প্রেসিডেন্ট মিগেল দিয়াজ-কানেল বলেন, নতুন পারিবারিক আইনে মানুষ, পরিবার ও বিশ্বাসের বৈচিত্রের প্রতিফলন আছে এবং দেশের সিংহভাগ নাগরিকই এর পক্ষে রায় দেবে বলে তিনি প্রত্যাশা করছেন।
সোমবার প্রকাশিত প্রাথমিক ফলে তার কথার প্রতিফলন দেখা গেছে। তখন পর্যন্ত গণনাকৃত ভোটের ৬৬ শতাংশের রায়ই সংস্কারের পক্ষে পড়েছে বলে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে জানিয়েছেন নির্বাচনী কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট আলিনা বালসেইরো।
সংস্কার অনুমোদিত হতে এর পক্ষে ৫০ শতাংশ ভোটারের সমর্থন থাকলেই হতো।
নতুন আইন পাশ হয়ে যাওয়ার ফলে কিউবার সমকামীরা যেমন বিয়ে করতে পারবেন, তেমনই বিনা ঝঞ্ঝাটে সন্তান দত্তক নিতে পারবেন।
কমিউনিস্ট পার্টিশাসিত দ্বীপদেশটিতে সমকামিতার পক্ষে দৃষ্টিভঙ্গি গত কয়েক দশক ধরে বদলাচ্ছে; দেশটির সাবেক নেতা রাউল কাস্ত্রোর মেয়ে মারিয়েলার প্রচেষ্টাও এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রেখেছে।
১৯৫৯ সালের বিপ্লবের পর দেশটির ক্ষমতায় আসা ফিদেল কাস্ত্রোর শাসনামলের প্রথম দিকে সমকামী পুরুষ ও নারীদের ‘আচরণ ও দৃষ্টিভঙ্গি বদলানোর দীক্ষা নিতে’ শ্রম শিবিরে পাঠানো হতো।
তবে এখনও অনেক কিউবানই, বিশেষ করে কট্টর খ্রিস্টান, এমনকী ধর্মবিশ্বাসী নন এমন অনেক রক্ষণশীলও সমকামিতাকে বৈধতা দেওয়ার পক্ষে নন।
কমিউনিস্ট পার্টির বিরোধী অনেক গ্রুপও ‘না’ ভোট দেওয়ার প্রচার চালিয়েছিল; কমিউনিস্ট সরকারকে একহাত নিতে গণভোটে তাদেরকে পরাজিত করার আহ্বান ছিল তাদের।
সরকারবিরোধী অনেক কর্মীই মনে করছেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ভিন্নমতাবলম্বীদের ওপর ব্যাপক দমনপীড়ন চালানো কিউবার কমিউনিস্টরা মানবাধিকার বিষয়ে নিজেদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করার প্রচেষ্টায় এই গণভোট করেছে।
এমন একটা সময়ে কিউবায় এ গণভোট হয়েছে, যখন দেশটি তীব্র জ্বালানি সংকটে ভুগছে।
জ্বালানি ঘাটতির কারণে দ্বীপদেশটির লাখ লাখ মানুষকে প্রতিদিন দীর্ঘ সময় বিদ্যুৎহীন থাকতে হচ্ছে।
এসডব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮২৩
আপনার মতামত জানানঃ