লাগাতার ইসরায়েলি হামলার মুখে আল-আহলি আল-আরাবি হাসপাতালকে নিরাপদ ভেবেছিলেন গাজাবাসী। নানা জায়গায় হামলা হলেও অন্তত হাসপাতালে হামলা হবে না—এমনটাই ভেবেছিলেন তাঁরা। তাই অনেকে সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ছিলেন আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিরা। আরও ছিলেন চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীরা।
কিন্তু শেষরক্ষা হয়নি। গত মঙ্গলবার রাতে এই হাসপাতালেও হামলা চালিয়েছে ইসরায়েলি বাহিনী। প্রাণ গেছে শ পাঁচেক মানুষের।
হাসপাতালে এই হামলা ও হতাহতের পর থেকে ‘যুদ্ধাপরাধ’, ‘চরম নৃশংসতা’, ‘আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের লঙ্ঘন’ বলে প্রতিবাদ ও সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। ইসরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে দেশে দেশে চলছে বিক্ষোভ। তবে ইসরায়েল বলছে, তারা নয়, বরং ‘অন্য পক্ষ’ এই হামলার পেছনে জড়িত। ইসরায়েল সফরকালে একই কথা বলেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।
স্পষ্টতই অভিযোগের তির ফিলিস্তিনের ইসলামিক জিহাদের দিকে। এখন প্রশ্ন হলো, বেসামরিক লোকজন, বিশেষ করে হাসপাতালে হামলা করে কাউকে হত্যা করা কতটা যৌক্তিক? এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক আইন কী বলছে?
গাজার আল-আহলি আল-আরাবি হাসপাতালটি ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত। গাজার সবচেয়ে পুরোনো হাসপাতালগুলোর একটি এটি। এর পাশেই একটি গির্জা রয়েছে। বাসেল সৌরানির মতে, পুরোনো একটি হাসপাতাল ও পাশেই গির্জা রয়েছে, এটা ভেবেই গাজার বাস্তুচ্যুত অনেকে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এখানে অন্তত হামলা হবে না।
জাতিসংঘের মতে, আন্তর্জাতিক আইনের কোনো একক নথি দিয়ে সব ধরনের যুদ্ধাপরাধের ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়। এ জন্য আমাদের আন্তর্জাতিক মানবিক, ফৌজদারি ও প্রথাগত আইনের বিভিন্ন শাখার শরণাপন্ন হতে হবে। সংস্থাটি বলছে, সশস্ত্র সংঘাতের সময় যুদ্ধাপরাধ সংঘটিত হয়। আর যুদ্ধের সময় জেনেভা কনভেনশন ও আন্তর্জাতিক মানবিক আইন কার্যকর থাকে, যা ‘ল অব ওয়ার’ নামে পরিচিত। যুদ্ধাপরাধের ক্ষেত্রে এ দুই আইনের লঙ্ঘন ঘটে।
এসব আইনে যুদ্ধের সময় ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার বিষয়ে নির্দিষ্ট করে বলা হয়েছে। তাই যুদ্ধরত পক্ষগুলো চাইলেই শত্রুপক্ষের যে কারও ওপর হামলা চালাতে ও হত্যা করতে পারে না।
মঙ্গলবার ইসরায়েলের জাতীয় নিরাপত্তামন্ত্রী ইতামার বেন-গিভির হুমকি দেন, ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাস যদি আটক ইসরায়েলিদের অবিলম্বে মুক্তি না দেয়, তাহলে গাজায় নির্বিচার বিস্ফোরক ফেলা হবে।
আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুযায়ী, যদি কোনো হামলায় বেসামরিক মানুষের জীবনের ক্ষতি সামরিক অর্জনের চেয়ে বেশি হয়, তবে সেটাকে আইনের লঙ্ঘন বিবেচনা করা হবে।
মঙ্গলবার গাজায় হাসপাতালে ইসরায়েলি হামলায় ৫০০ জনের প্রাণ গেছে। এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে বলেও ধারণা করা হচ্ছে। তাই আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলো ধ্বংস আর প্রাণহানি বিবেচনায় একে নির্বিচার হত্যাকাণ্ড বলছে।
ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করার জন্য আইসিসির মনোযোগ কাড়তে পিসিএইচআর চেষ্টা করছে। ইউক্রেনে রুশ যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে আইসিসি যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এই ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। এটা হতাশাজনক।
প্রসঙ্গত, যুদ্ধকালে জেনেভা কনভেনশন কার্যকর থাকে। এই আইনে যুদ্ধের নিয়মকানুন বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ইসরায়েল জেনেভা কনভেনশনে সই করা একটি দেশ। তাই আন্তর্জাতিক এই আইন মানতে বাধ্য দেশটি।
১৮৬৪ থেকে ১৯৪৯ সালের মধ্যে চারটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের ধারাবাহিক রূপ জেনেভা কনভেনশন। প্রথমটিতে সামরিক বাহিনীর আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা হয়েছে। ১৯৪৯ সালে চতুর্থ কনভেনশন গৃহীত হয়। এতে যাঁরা সরাসরি যুদ্ধে সম্পৃক্ত নয় এমন মানুষ, বিশেষ করে শিশু, অসুস্থ ব্যক্তি এবং প্রাপ্তবয়স্ক বেসামরিক মানুষের সুরক্ষার কথা বলা হয়।
এই কনভেনশনের ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে হাসপাতালকে নিরাপদ অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। ১৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, বেসামরিক হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। অর্থাৎ, যুদ্ধের সময় হাসপাতালে হামলা করা, স্বাস্থ্যকর্মী ও হাসপাতালে অবস্থানরত বেসামরিক মানুষদের হত্যা করা জেনেভা কনভেনশনের লঙ্ঘন।
প্যালেস্টিনিয়ান সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের (পিসিএইচআর) আন্তর্জাতিকবিষয়ক অ্যাডভোকেসি কর্মকর্তা বাসেল সৌরানি বলেন, ফিলিস্তিনের অন্তত ১০টি হাসপাতাল, অ্যাম্বুলেন্স ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ওপর হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল।
তিনি আরও বলেন, ‘সুরক্ষিত বেসামরিক জায়গাগুলোয় হামলা করা নতুন কিছু নয়। সব প্রমাণ বিবেচনায় ও প্রত্যক্ষদর্শীদের সঙ্গে কথা বলার পর আমরা নিশ্চিত, গাজার হাসপাতালে ইসরায়েল হামলা চালিয়েছে।’
১৯৭৭ সালে আরেকটি চুক্তি বা প্রটোকলে হাসপাতালের সুরক্ষার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়। জেনেভা কনভেনশনের আওতায় গৃহীত তিনটি প্রটোকলের প্রথমটির (অ্যাডিশনাল প্রটোকল ওয়ান) ১২ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, যুদ্ধের সময় স্বাস্থ্যসেবাকেন্দ্রের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। কোনোভাবেই হাসপাতালকে হামলার লক্ষ্যবস্তু বানানো যাবে না।
এ বিষয়ে দিল্লির সাউথ এশিয়ান ইউনিভার্সিটির আন্তর্জাতিক মানবিক আইনের সহযোগী অধ্যাপক শ্রীনিবাস বুররা বলেন, অ্যাডিশনাল প্রটোকল ওয়ান অনুমোদন করেনি ইসরায়েল। তাই প্রটোকল লঙ্ঘনের ঘটনা অনুসন্ধানে একটি আন্তর্জাতিক ফ্যাক্ট–ফাইন্ডিং কমিশন সক্রিয় করা যেতে পারে।
জেনেভা কনভেনশনে যেমন যুদ্ধে ভুক্তভোগীদের সুরক্ষার বিষয়ে বলা হয়েছে, তেমনি হেগ কনভেনশনে যুদ্ধকালীন আচরণ কেমন হবে, শত্রুপক্ষের প্রতি কী করা যাবে, কী করা যাবে না—এসব নিয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে। সেই সঙ্গে এতে যুদ্ধকালীন চিকিৎসাসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিদের সঙ্গে কেমন আচরণ করতে হবে, তা বলে দেওয়া হয়েছে।
কনভেনশনের ২৭ নম্বর অনুচ্ছেদে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে, হাসপাতাল এবং যেসব ভবনে আহত ও অসুস্থ ব্যক্তিরা আশ্রয় নিয়েছেন; অবরোধ ও বোমাবর্ষণের সময় সেসব ভবন এড়িয়ে যেতে হবে, রক্ষা করতে হবে।
তবে ইসরায়েল এই কনভেনশন অনুমোদন করেনি; যদিও আন্তর্জাতিক প্রথাগত আইন অনুযায়ী, অনুমোদন না করার পরও ইসরায়েল হেগ কনভেনশনের এই বিধান মেনে চলতে বাধ্য।
রোম সংবিধি হলো এমন একটি চুক্তি, যার আওতায় আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যেকোনো হাসপাতাল ও ঐতিহাসিক স্থাপনায় হামলা, তথা জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘনের কোনো অভিযোগ উঠলে সেটার তদন্ত ও বিচার করা আইসিসির দায়িত্ব।
গাজার আল-আহলি আল-আরাবি হাসপাতালটি ১৮৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত। গাজার সবচেয়ে পুরোনো হাসপাতালগুলোর একটি এটি। এর পাশেই একটি গির্জা রয়েছে। বাসেল সৌরানির মতে, পুরোনো একটি হাসপাতাল ও পাশেই গির্জা রয়েছে, এটা ভেবেই গাজার বাস্তুচ্যুত অনেকে এখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, এখানে অন্তত হামলা হবে না।
ইসরায়েল রোম সংবিধির আওতায় আইসিসির কার্যক্রমের স্বীকৃতি দেয়নি। ফিলিস্তিন দিয়েছে। যেহেতু হাসপাতালে হামলার ঘটনা ফিলিস্তিনের ভূখণ্ডে ঘটেছে, তাই আইসিসি এ ঘটনার তদন্ত করার এখতিয়ার রয়েছে। দায়ীদের বিচার করার এখতিয়ারও রয়েছে আইসিসির।
বাসেল সৌরানি বলেন, ইসরায়েলের চলমান যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করার জন্য আইসিসির মনোযোগ কাড়তে তাঁর সংগঠন পিসিএইচআর চেষ্টা করছে। ইউক্রেনে রুশ যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে আইসিসি যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, এ ক্ষেত্রে তেমনটা দেখা যাচ্ছে না। এটা হতাশাজনক।
সৌরানি আরও বলেন, ‘আমরা অপরাধীদের জবাবদিহি করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছি। কিন্তু তাদের নীরবতা আমাদের হতাশার দিকে ঠেলে দিয়েছে।’
এ বিষয়ে শ্রীনিবাস বুররা বলেন, ফিলিস্তিনে ইসরায়েলের যুদ্ধের পরিপ্রেক্ষিতে আইসিসি হয়তো ‘অপেক্ষা করি, দেখি কি হয়’—এমন নীতিতে এগোচ্ছে। তাই তদন্তের ঘোষণা দিতে আশ্চর্যজনকভাবে বিলম্ব করছে। এর আগে কোনো ঘটনায় এমনটা দেখা যায়নি।
আপনার মতামত জানানঃ