হামাস-ইসরায়েলের যুদ্ধে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে সর্বত্র। সবচেয়ে বড় আতঙ্ক এতে মধ্যপ্রাচ্য অস্থিতিশীল ও অনিরাপদ হয়ে উঠতে পারে। এমনকি মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে ছড়িয়ে পড়তে পারে এই যুদ্ধ। এরই মধ্যে লেবাননের যোদ্ধাগোষ্ঠী হিজবুল্লাহর হামলার জবাব দিয়েছে ইসরায়েল। এতে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের সাংবাদিক ইশাম আবদুল্লাহ নিহত হয়েছেন। আতঙ্ক বিরাজ করছে লেবাননে। এই ইস্যুতে এই দেশটিও যুদ্ধে জড়িয়ে যেতে পারে।
হিজবুল্লাহ হুঙ্কার দিয়েছে। বলেছে, তারা হামাসের সঙ্গে যুদ্ধে যোগ দিতে প্রস্তুত। শুধু সময়ের অপেক্ষায় আছে তারা। সময় হলেই হামাসের সঙ্গে যোগ দিয়ে যুদ্ধ চালাবে। তাদের এ পর্যন্ত আক্রমণের ফলে ইসরায়েলি সেনাদের সামনেও চ্যালেঞ্জ এসে পড়েছে। একদিকে গাজায় হামাসকে সামাল দেয়া। অন্যদিকে পাশের দেশ লেবাননে হিজবুল্লাহকে সামাল দেয়া। হিজবুল্লাহ একটি সুসংগঠিত যোদ্ধাগোষ্ঠী।
তারা এর আগেও ইসরায়েলের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তাছাড়া হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের কথা বলে গাজা উপত্যকায় ইসরায়েল এখন যে হামলা চালাচ্ছে, তাকে যুদ্ধাপরাধ বলে অভিহিত করেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। কারণ, তাদের নির্দেশমতো নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে দক্ষিণ গাজায় যাওয়ার পথে তাদের বাহনের ওপর ইসরায়েল বোমা হামলা চালিয়েছে। তাতে কমপক্ষে ৩০০ মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে আছে শিশু, নারীও।
উপরন্তু গাজার পানি, জ্বালানি, খাদ্য সরবরাহে অবরোধ সৃষ্টি করে মানুষ মারার এক মোক্ষম উপায় বেছে নিয়েছে ইসরায়েল। হামাসের অপরাধের জন্য তারা ‘কালেক্টিভ পানিশমেন্ট’ বা সামষ্টিক শাস্তি দিচ্ছে সাধারণ মানুষকে। এর ওপর আকাশপথে, স্থলপথে এবং নৌপথে সর্বাত্মক হামলার পরিকল্পনা নিয়েছে ইসরায়েল। যেকোনো সময় এই হামলা হতে পারে। এমন হামলা চালানো হলে গাজায় মানুষের বসতি ছিল, এমন নজির মাটির সঙ্গে মিশে যাবে।
ইসরায়েলের এমন উদ্যোগকে ‘গাজার অতল গহ্বরে’ যাত্রা বলে অভিহিত করেছে জাতিসংঘ। তারা জানিয়েছে, গাজার হাসপাতালগুলোতে যেসব রোগী আছেন তাদেরকে স্থানান্তর করা হবে ‘মৃত্যুদণ্ডের’ শামিল। ইউএনআরডব্লিউএ’র যোগাযোগ বিষয়ক পরিচালক জুলিয়েটে তোউমা বলেন, এ যাবৎ আমরা যা দেখেছি পরিস্থিতি তার মধ্যে সবচেয়ে খারাপ। একদম তলানিতে চলে গেছে সবকিছু। গাজাকে অতল গহ্বরের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে। সেখানে এক ট্র্যাজেডির সৃষ্টি হচ্ছে আর বিশ্ব তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এটাই গাজা।
এ পরিস্থিতিতে দৃশ্যত সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান গাজা উপত্যকায় সামরিক অভিযান ও অবরোধ অবিলম্বে বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই’র সঙ্গে টেলিফোন সংলাপে এই আহ্বান জানান।
যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের যে উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, তাতে সৌদি আরবকে পাশে পাচ্ছে না ইসরায়েল। তারা উল্টো ইসরায়েলের আরেক ঘোর শত্রু ইরানের সঙ্গে সম্প্রতি কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করেছে। এতে আবার মধ্যস্থতা করেছে চীন। ইসরায়েল হামাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও তা এখন হয়ে উঠেছে, গাজার সাধারণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। আর মুসলিম বিশ্বের মোড়ল সৌদি আরব যখন ইসরায়েলকে বিরত থাকার আহ্বান জানাচ্ছে, তখন অন্য সমীকরণের দিকে তাকাচ্ছে বিশ্ব। তা হলো, তবে কী সৌদি আরবকে একেবারেই হারিয়ে ফেলছে ইসরায়েল!
এরই মধ্যে খবর বেরিয়েছে ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ককে হিমঘরে পাঠিয়েছে সৌদি আরব। এই যুদ্ধ তাদেরকে আরও ইরানমুখী করেছে। সম্পর্ক স্বাভাবিক করার পর প্রথমবারের মতো টেলিফোনে ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির সঙ্গে কথা বলেছেন ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। এর মধ্যদিয়ে সৌদি আরবের পররাষ্ট্রনীতিতে পরিবর্তনের এক ত্বরিত ইঙ্গিত মিলছে। বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে দুটি সূত্র বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের আলোচনা বিলম্বিত করবে সৌদি আরব।
গত ৭ই অক্টোবর ইসরায়েলে রকেট হামলা চালায় হামাস। এর আগে পর্যন্ত ইসরায়েল এবং সৌদি আরব উভয় দেশই বলছিল, তারা সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের একটি চুক্তির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এর ফলে মধ্যপ্রাচ্য নতুন রূপ নেবে। সৌদি আরব হলো ইসলামের জন্মস্থান এবং পবিত্র দুই মসজিদের অবস্থানস্থল। তারা এই যুদ্ধ শুরুর আগে পর্যন্ত বলেছিল, যদি ফিলিস্তিনিদের রাষ্ট্রের দাবির বিষয়ে ইসরায়েল বড় রকমের কোনো ছাড় না দেয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তিকে নষ্ট হতে দেবে না।
কিন্তু ফিলিস্তিনিদের একপেশে করে রাখায় আরব অঞ্চলে ক্ষোভ বৃদ্ধির ঝুঁকি দেখা দিয়েছে। আরবের সংবাদ মাধ্যমগুলো ইসরায়েলের প্রতিশোধ হামলায় নিহত ফিলিস্তিনিদের ছবি সম্প্রচার বা প্রচার করছে। একটি সূত্রের মতে, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণ নিয়ে আলোচনা এখন অব্যাহত রাখার কথা চিন্তা করছে না রিয়াদ। তার পরিবর্তে ফিলিস্তিনিদের জন্য ছাড় আদায় করে নেয়া তাদের জন্য এখন বৃহত্তর অগ্রাধিকার। বেশির ভাগ আরব দেশে ফিলিস্তিনি ইস্যুটি বড় উদ্বেগের বিষয় হয়ে আছে। এ অবস্থায় ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্কের বিষয়ে সৌদি আরব নতুন করে চিন্তাভাবনা করতে পারে।
সৌদি বিশ্লেষক আজিজ আলগাশিয়ান বলেন, আরব বিশ্বের জন্যও এরই মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণকে নিষিদ্ধ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। এই যুদ্ধ সেই প্রবণতাকে আরও বহুগুণ বৃদ্ধি করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান হোয়াইট হাউসে বলেছেন, সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের প্রচেষ্টা থেমে যায়নি। তবে দৃষ্টি দেয়া হয়েছে তাৎক্ষণিক অন্য চ্যালেঞ্জগুলোর দিকে। সৌদি আরবের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত একটি সূত্র মনে করেন, হামাসের হামলার পর এর নিন্দা জানাতে এ সপ্তাহে রিয়াদকে চাপ দিয়েছে ওয়াশিংটন। কিন্তু তা এড়িয়ে গিয়েছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রিন্স ফয়সাল বিন ফারহান।
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক অন্য একটি সূত্র এ খবর নিশ্চিত করেছেন। এরই মধ্যে ৪৫ মিনিট ফোনে কথা বলেছেন ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসি ও সৌদি আরবের ক্রাউন প্রিন্স মোহাম্মদ বিন সালমান। তারা যেটুকু জানিয়েছেন, তা প্রকাশযোগ্য। কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা কোন কৌশল নিয়েছেন তা শুধু তারাই জানেন।
ওই ফোনে রইসিকে ক্রাউন প্রিন্স বলেছেন, চলমান যুদ্ধ বন্ধে সব আন্তর্জাতিক ও আঞ্চলিক পক্ষগুলোকে যুক্ত করতে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সৌদি আরব। তিনি আরও জানিয়েছেন বেসামরিক স্থাপনাকে টার্গেট এবং নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানির বিরোধী সৌদি আরব। ফিলিস্তিনিদের দাবির প্রতি দ্ব্যর্থহীন অবস্থান রয়েছে রিয়াদের। মধ্যপ্রাচ্য থেকে উত্তেজনা নিরসনে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তারা। এমনকি ইয়েমেন যুদ্ধেরও ইতি টানার পথ খোঁজা হচ্ছে। ইয়েমেনে হুতি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে সামরিক যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে রিয়াদ। প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রইসির সঙ্গে ক্রাউন প্রিন্সের ফোনকলের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, সৌদি নেতাদের সঙ্গে অব্যাহত যোগাযোগ রাখছে ওয়াশিংটন।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন কয়েক দফা কথা বলেছেন সৌদি আরবের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে। ওই কর্মকর্তা আরও বলেছেন, ওয়াশিংটন তার অংশীদারদের মাধ্যমে হামাস, হিজবুল্লাহ অথবা ইরানকে আহ্বান জানাতে বলছে, যাতে হামাস তার হামলা বন্ধ করে। জিম্মিদের মুক্তি দেয়। হিজবুল্লাহকে দূরে রাখে। কিন্তু এই যুদ্ধে ইরান জড়িয়ে পড়তে পারে বলে উপসাগরীয় দেশগুলো উদ্বিগ্ন। যদি তা-ই হয়, তাহলে তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হবে তারাও।
আপনার মতামত জানানঃ