বাংলাদেশে নিখোঁজ ব্যক্তিদের সম্পর্কে তদন্তের আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। প্রকাশিত এক নতুন প্রতিবেদনে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিশেষজ্ঞদের বাংলাদেশে গুম হওয়া ব্যক্তিদের বিষয়ে তদন্ত পরিচালনা করার আহ্বান করা হয়।
প্রতিবেদনটি এমন সময় প্রকাশ করলো যখন সারা পৃথিবীতে গুমের শিকার ব্যক্তিদের স্মরণে ‘আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ’ দিবসটি পালিত হচ্ছে আজ।
সদ্য প্রকাশিত এই প্রতিবেদনে বিভিন্ন সময় নিখোঁজ ব্যক্তিরা কোথায়, কী অবস্থায় আছে তা তদন্ত করতে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে। একই সঙ্গে জানানো হয়েছে আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেয়ার ক্ষেত্রে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান।
বাংলাদেশি মানবাধিকার পর্যবেক্ষকদের মতে, ২০০৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত দেশে ৬০০ জনকে জোরপূর্বক গুম করা হয়েছে। আদালতে হাজির করার পাশাপাশি যদিও কিছু লোককে পরে মুক্তি দেওয়া হয়েছিল। সে সময় বলা হয়েছিল যে নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে গোলাগুলিতে অনেকেই মারা গেছেন, এছাড়াও প্রায় ১০০ জন নিখোঁজ রয়েছে।
হিউম্যান রাইটস ওয়াচের (এইচআরডব্লিউ) এশিয়ার সিনিয়র গবেষক জুলিয়া ব্লেকনার বলেন, বাংলাদেশে জোরপূর্বক নিখোঁজে ব্যক্তিদের পরিবারগুলোর কষ্ট শুধু বাড়ছেই। সরকার কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
সরকারের উচিত আটক ব্যক্তিদের মুক্তি দেয়ার ব্যাপারে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া। পাশাপাশি একটি স্বাধীন কমিশন খোলা, যেখানে জাতিসংঘের সাথে এক হয়ে এমন গুমের ঘটনা বিরুদ্ধে কাজ করতে পারবে সরকার।
এদিকে গত মার্চে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর প্রকাশিত বার্ষিক মানবাধিকার প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অধ্যায়ে এ দেশে গুমের অভিযোগকে মানবাধিকারসংক্রান্ত অন্যতম ইস্যু হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।
ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার গোষ্ঠী ও গণমাধ্যমগুলো নিরাপত্তা বাহিনীগুলোর বিরুদ্ধে গুম ও অপহরণের অভিযোগ তুলে ধরেছে। গত বছরের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ১৬ ব্যক্তি গুম হওয়ার তথ্য দিয়েছে একটি বেসরকারি সংগঠন। নাগরিক সমাজ সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ‘গুম’ হওয়া ব্যক্তিদের বেশির ভাগই বিরোধী দলের নেতা-কর্মী ও ভিন্নমতাবলম্বী।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গুম-বিষয়ক জাতিসংঘের ওয়ার্কিং গ্রুপ বাংলাদেশে ৮১টি গুমের অভিযোগ তদন্ত করছে। তারা কোথায় আছে বা তাদের ভাগ্যে কী ঘটেছে, সে বিষয়ে ওয়ার্কিং গ্রুপের কাছে সুস্পষ্ট তথ্য নেই।
বাংলাদেশ সরকার বরাবরই গুমের অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন গুমের অভিযোগ প্রসঙ্গে বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে গুম হওয়ার অভিযোগে ওঠে, তাদের অনেকেই ঋণ বা বিভিন্ন কারণে স্বেচ্ছায় নিখোঁজ হন। পরে আবার তারা ফিরে আসেন।
২০১১ সাল থেকে প্রতি বছর ৩০ আগস্ট গুম হওয়া মানুষগুলোকে স্মরণ এবং সেই সঙ্গে তাদের পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানানোর জন্য দিবসটি পালন করা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী। আর গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে রাজনৈতিক নেতাকর্মীর পাশাপাশি আছেন সাধারণ লোকজনও।
২০১০ সালের ডিসেম্বরে ‘ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন ফর প্রটেকশন অব অল পারসন্স এগেইনস্ট এনফোর্সড ডিসঅ্যাপিয়্যারেন্স’ সম্মেলনে যে আন্তর্জাতিক সনদ কার্যকর হয় তাতে ৩০ আগস্টকে আন্তর্জাতিক গুম প্রতিরোধ দিবস বলে ঘোষণা করা হয়।
যদিও।বাংলাদেশে ২০২২ সালে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সংখ্যা তার আগের বছরের তুলনায় ‘নাটকীয়ভাবে’ কমে এসেছে বলে জানা গেছে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বৈশ্বিক মানবাধিকার প্রতিবেদন থেকে।
ওই প্রতিবেদন অনুযায়ী ২০২১ সালে বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন ৮০ জন, যেখানে গত বছর এই সংখ্যা নেমে আসে ২৫ এ।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কমে আসার কারণ হিসেবে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটেলিয়নের (র্যাব) ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা আরোপকে উল্লেখযোগ্য কারণ বলে এর আগে চিহ্নিত করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা। তবে বাংলাদেশে গুমের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।
বাংলাদেশে গুমের শিকার হওয়া ব্যক্তির পরিবারগুলোর সংগঠন ‘মায়ের ডাক’ এবং কয়েকটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনের গত মে মাসে একটি যৌথ বিবৃতি প্রকাশ করে।
সেই বিবৃতির উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, “যুক্তরাষ্ট্র সরকার র্যাব কর্মকর্তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের পরও গুমের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে।”
“নিখোঁজ ব্যক্তিদের পরিবারগুলো ঘন ঘন হুমকি পেয়েছে। রাজনৈতিক বিরোধীদের অভিযোগ, পুলিশ বাহিনী জোরপূর্বক গুমের শিকার ব্যক্তিদের পরিবারের অভিযোগ নথিভুক্ত করেনি,” উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে।
মানবাধিকার সংগঠন এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনের উদ্ধৃতি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বলেছে, “একটি স্থানীয় মানবাধিকার সংস্থা জানিয়েছে জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৬ জন মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। এই ধরনের কাজ প্রতিরোধ, তদন্ত বা শাস্তি দেওয়ার জন্য সরকারি প্রচেষ্টা সীমিত।”
এতে আরও বলা হয়, “সুশীল সমাজের সংগঠনগুলো জানিয়েছে, গুমের শিকার বেশিরভাগই বিরোধী দলীয় নেতা, কর্মী এবং ভিন্ন মত পোষণকারী।”
প্রতিবেদনে ব্যবহার করা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের ২০২১ সালের তথ্য অনুযায়ী ওই বছরে বিচারবহির্ভূত হত্যার শিকার হয় ৮০ ব্যক্তি। ২০২২ সালে তা কমে ১৯ জনে নেমে আসে। এর কারণ হিসেবে র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপের বিষয়টি তুলে ধরছেন বাংলাদেশের অপরাধ বিশেষজ্ঞরা।
নাম উল্লেখ না করে এতে বলা হয় অন্য একটি মানবাধিকার সংস্থার হিসাব মতে, ২০২২ সালের প্রথম নয় মাসে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন ২৫ জন।
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৬০০’র বেশি মানুষ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হন।
যুক্তরাষ্ট্রের ব্যুরো অব ডেমোক্রেসি, হিউম্যান রাইটস এবং লেবার কর্তৃক প্রকাশিত বিভিন্ন দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি সংক্রান্ত ‘২০২২ কান্ট্রি রিপোর্টস অন হিউম্যান রাইটস প্র্যাকটিসেস’ শিরোনামে প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বাংলাদেশ অংশে বলা হয়েছে, “সরকার কর্তৃক বিচারবহির্ভূত হত্যা, বেআইনি বা নির্বিচারে হত্যা, গুম, নির্যাতন বা নিষ্ঠুর, অমানবিক বা অবমাননাকর আচরণ বা শাস্তির মতো মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদন রয়েছে।”
প্রতিবেদনে বাংলাদেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অন্যান্য বিষয়ের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে—নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক, রাজনৈতিক কারণে গ্রেপ্তার, অন্য দেশে অবস্থিত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক দমন, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার ওপর স্বেচ্ছাচারী বা বেআইনি হস্তক্ষেপ, কোনো অভিযুক্ত ব্যক্তির অপরাধের জন্য তার স্বজন ও পরিবারের সদস্যদের শাস্তি দেওয়া, মতপ্রকাশ সীমিত করার জন্য সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি; সাংবাদিকদের অযৌক্তিক গ্রেপ্তার বা বিচার, ফৌজদারি মানহানি আইন বলবৎকরণ বা হুমকিসহ স্বাধীন মতপ্রকাশের এবং মিডিয়ার ওপর গুরুতর বিধি-নিষেধ।
এতে আরও বলা হয় “ইন্টারনেট স্বাধীনতার ওপর গুরুতর নিষেধাজ্ঞা; সংগঠন করা বা সংগঠিত হওয়া এবং শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে গুরুতর হস্তক্ষেপ; বেসরকারি সংস্থা এবং সুশীল সমাজ সংস্থাগুলোর পরিচালনা ও তহবিল সংগ্রহের ওপর অত্যধিক আইনগত সীমাবদ্ধতা আরোপ; শরণার্থীদের চলাফেরার স্বাধীনতার ওপর বিধি-নিষেধ; রাজনৈতিক অংশগ্রহণের ওপর গুরুতর এবং অযৌক্তিক বিধি-নিষেধ; গুরুতর সরকারি দুর্নীতি; অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোর ওপর গুরুতর সরকারি বিধি-নিষেধ বা হয়রানি; যৌন সহিংসতা, কর্মক্ষেত্রে সহিংসতা, জোরপূর্বক বিয়েসহ বিভিন্ন রকম লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার ক্ষেত্রে যথাযথ তদন্ত ও জবাবদিহিতার অভাব রয়েছে।”
“জাতিগত সংখ্যালঘু গোষ্ঠী বা আদিবাসীদের ওপর সন্ত্রাস, সহিংসতা ও হুমকি; সমকামী ও উভকামী মানুষদের বিরুদ্ধে সহিংসতা এবং তাদের পারস্পরিক সম্মতিপূর্ণ যৌন আচরণকে অপরাধী সাব্যস্ত করে আইন; স্বাধীন ট্রেড ইউনিয়ন এবং শ্রমিকদের সংগঠনের স্বাধীনতার ওপর উল্লেখযোগ্য বিধি-নিষেধ এবং শিশু শ্রমের সবচেয়ে খারাপ রূপের অস্তিত্ব রয়েছে,” প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে।
এসডব্লিউএসএস১৫৫০
আপনার মতামত জানানঃ