ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে ডেঙ্গু। রোগীর চাপে রাজধানীর অনেক হাসপাতালেই বিছানা ফাঁকা নেই। ঢাকার বাইরেও সব জেলায় দাপট দেখাচ্ছে এডিস মশাবাহী এই রোগ। আবার বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা ব্যয়বহুল।
ফলে চিকিৎসা নিতে হিমশিম খাচ্ছে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো। প্রতিদিন প্লাটিলেট পরীক্ষা, ডেঙ্গু শনাক্তের টেস্ট, সিভিসিসহ অন্যান্য পরীক্ষায় যাচ্ছে অনেক টাকা।
অনেক ক্ষেত্রে একই পরিবারের একাধিক সদস্য ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়ায় সবার খরচ মেটাতে নিঃস্ব হচ্ছে বহু পরিবার। ওদিকে ডেঙ্গু চিকিৎসায় সরকার ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় করেছে বলে জানিয়েছে স্বাস্থ্যমন্ত্রী। রোগী প্রতি সরকারি কোষাগার থেকে গিয়েছে ৫০ হাজার টাকা।
এবার ধনী-গরিব নির্বিশেষে ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়েছে। রাজধানীর সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে ভর্তিকৃত ডেঙ্গু রোগীদের বেশির ভাগ নিম্নবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্তের।
ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত হয়ে এসব খেটে খাওয়া মানুষ পড়েছেন বিপাকে। ডেঙ্গু রোগের চিকিৎসা করতে গিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়ছেন রোগীর স্বজনরা। ভুক্তভোগীরা বলছেন, ক্রিটিক্যাল ডেঙ্গু রোগে আক্রান্ত রোগীর চিকিৎসায় সরকারি হাসপাতালেও ১ লাখ টাকার উপরে ব্যয় হচ্ছে। বেসরকারি হাসপাতালে ব্যয় আরও কয়েকগুণ বেশি। ডেঙ্গুতে শিশুদের চিকিৎসা ব্যয় আরও বেশি।
এ বছর ডেঙ্গুতে মৃত্যু ও শনাক্ত আগের সব রেকর্ড ছাড়িয়েছে। এ পর্যন্ত ৫৪৮ জনের মৃত্যু হয়েছে। আক্রান্তের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়েছে। জেলা, এমনকি উপজেলা পর্যায়ের সরকারি হাসপাতালগুলোতেও প্রচুর রোগী। এসব রোগীর বেশির ভাগই দরিদ্র ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির। ওষুধ, স্যালাইন, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও রোগীর পথ্য জোগাতে গিয়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন।
কিছু দিন সরকারিভাবে স্যালাইনের সরবরাহ বন্ধ থাকায় রোগীদের দেয়া যাচ্ছিল না। এ অবস্থায় রোগীর স্বজনদের বাইরে থেকে স্যালাইন কিনে আনতে হয়। সুযোগ বুঝে বাইরের ফার্মেসিগুলো দুই থেকে তিন গুণ দাম নেয় স্যালাইনের।
স্যালাইনের প্যাকেটের গায়ে ১০১ টাকা লেখা থাকলেও দাম নিয়েছে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকা পর্যন্ত। এমনকি অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষাও বাইরে থেকে করতে হয় বলে জানিয়েছেন রোগীর স্বজনরা। বরিশালের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিয়েছেন এমন কয়েকজন রোগী সম্প্রতি গণমাধ্যমকে জানান, চিকিৎসা বাবদ তাদের ১০ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত খরচ হয়েছে।
২৮ বছর বয়সী মো. শাকিব গুরুতর একজন ডেঙ্গু রোগী। দশ দিন ধরে তিনি ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিচ্ছিলেন। মাদারীপুর থেকে ঢাকায় এসেছেন চিকিৎসা নিতে। গত ২১শে আগস্ট ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হয়ে মেডিসিন বিভাগের বারান্দায় চিকিৎসা নিচ্ছিলেন শাকিব।
নতুন ভবনের ৬ তলায় ৬০১ নম্বর ওয়ার্ডের সামনে সিট না পেয়ে ফ্লোরে সিঁড়ির কাছে কোনো রকম ঠাঁই হয় তার। রোগীর স্ত্রী এই প্রতিবেদককে জানান, ১৮ই আগস্ট ডেঙ্গু জ¦রে আক্রান্ত হন তার স্বামী। ডেঙ্গুর রোগের চিকিৎসা করাতে গিয়ে তারা হিমশিম খাচ্ছেন। এ পর্যন্ত ৪০ হাজার টাকার উপরে খরচ হয়েছে। প্রতিদিনই পরীক্ষা-নিরীক্ষায় অনেক ব্যয় হয়।
ডেঙ্গু আক্রান্ত দুই বছর বয়সী এক শিশুর বাবা বললেন, তাদের বাসা মুগদা এলাকায়। এই এলাকায় ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাদের পরিবারের চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছেন। একসঙ্গে চারজন ডেঙ্গু আক্রান্ত হওয়া চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে হিমশিম খেতে হচ্ছিল তার। কারণ ডেঙ্গু জ্বর হলে অনেকদিন হাসপাতালে থাকতে হয়। প্রায় প্রতিদিন প্লাটিলেট পরীক্ষা, ডেঙ্গু শনাক্তের টেস্ট, সিভিসিসহ অন্যান্য পরীক্ষা করাতে হয়।
ডেঙ্গু রোগীর রক্তের প্লাটিলেট পরীক্ষা দিনে ৩ থেকে ৪ বারও করতে হচ্ছে। এর সঙ্গে আরও নানা ধরনের পরীক্ষা করতে হচ্ছে রোগীর। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা করা গেলেও বিভিন্ন পরীক্ষা করাতে হচ্ছে বেসরকারি ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে। এতে ব্যয় বাড়ছে চিকিৎসার। এই ব্যয় সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছেন তারা। বেশির ভাগ হাসপাতালে শয্যা খালি নেই।
সরকারি হাসপাতালে ফ্লোরে রেখেই রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিচ্ছেন চিকিৎসকরা। অন্যদিকে বেসরকারি হাসপাতালে ডেঙ্গুর চিকিৎসা ব্যয় অনেক বেশি। সেখানে শয্যা ভাড়া, চিকিৎসকের ভিজিট, ওষুধসহ নানা খরচে অনেক পরিবার সর্বস্বান্ত হয়ে পড়ছেন। ডেঙ্গু রোগীর পথ্যের দামও বেড়ে গেছে বলে রোগীর স্বজনরা জানান। তারা বলেন, ডাবের দাম এখন আকাশচুম্বী। একটি ডাব কিনতে ১শ’ টাকা লাগছে। এ ছাড়া পেঁপে, মাল্টাসহ বিভিন্ন ফলও বেশি দামে কিনতে হচ্ছে বলে জানান তারা।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ বছর ডেঙ্গুর প্রকোপ অক্টোবর পর্যন্ত অনেক বেশি থাকবে। চিকিৎসকদের মতে, এ বছর ডেঙ্গু অনেক বেশি জটিলতা নিয়ে হাজির হয়েছে। ডেঙ্গুর অন্যান্য উপসর্গের পাশাপাশি অন্ত্রের সমস্যাও বাড়ছে। তাই ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনায় আরও বেশি জোর দিতে হবে।
সরকারি হাসপাতালগুলোর প্রস্তুতি আরও বাড়াতে হবে। অনেক হাসপাতালে স্যালাইন সরবরাহে ঘাটতি রয়েছে। বেসরকারি পর্যায়ে স্যালাইনের বাজার নিয়ন্ত্রণহীন। এ অবস্থায় দরিদ্র রোগীরা কোথায় যাবে? সরকারি হাসপাতালে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুবিধা বাড়াতে হবে।
ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসা ব্যয় এবং হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা নিয়ে কথা হয় দেশের বিশিষ্ট ভাইরোলজিস্ট, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ)-এর সাবেক ভিসি অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলামের সঙ্গে। তিনি বলেন, হাসপাতাল ব্যবস্থাপনায় যথেষ্ট ঘাটতি রয়েছে। সব জায়গায় দুর্নীতি। গরিবরা আর গরিব হচ্ছে হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে গিয়ে।
সরকারি হাসপাতালেও স্যালাইন পায় না। সিট না পেয়ে ফ্লোরে চিকিৎসা নিতে হয় রোগীদের। তিনি বলেন, আমরা অপরিচ্ছন্ন এক জাতি। ড্রেন পরিষ্কার রাখি না। এখানে সেখানে ময়লা আবর্জনা ফেলে রাখি। ফলে ডেঙ্গু মশা আমাদের কামড়ায়। মশাকে আগে প্রতিরোধ করলে তো রোগী হাসপাতালে আসবে না। তখন চিকিৎসা ব্যয়ও লাগবে না। এই বিশেষজ্ঞ বলেন, রোগীর পেছনে সরকার কতো টাকা খরচ করেছে, এটা বড় কথা নয়। মশা নির্মূলে সরকার কী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে, এটাই জনগণ দেখতে চায়।
ডেঙ্গু চিকিৎসায় ব্যয় ৪০০ কোটি টাকা
চলতি বছর ডেঙ্গু রোগীদের চিকিৎসায় সরকারের ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্বাস্থ্য ও ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক। এ ছাড়া এখন পর্যন্ত হাসপাতালে সেবা নেয়া মোট রোগীর ৭০ শতাংশ সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন বলেও জানান তিনি। গতকাল রাজধানীর বনানীস্থ শেরাটন হোটেলে ডেঙ্গু ব্যবস্থাপনা বিষয়ক এক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন।
স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সরকার করোনার মতো ডেঙ্গু চিকিৎসাও বিনামূল্যে দিচ্ছে। ডেঙ্গু চিকিৎসায় খরচ দুই ধরনের হয়। যাদের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ) চিকিৎসা বা প্লাটিলেট নিতে হচ্ছে তাদের চিকিৎসা ব্যয় এবং যাদের লাগছে না তাদের খরচ ভিন্ন। এর চিকিৎসায় সরকারিভাবে ৪০০ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। রোগী প্রতি সরকারের গড়ে ব্যয় ৫০ হাজার টাকা।
এসডব্লিউএসএস১০০০
আপনার মতামত জানানঃ