বরিশাল শহরের বাসিন্দা মুজিবুর রহমান চলতি মাসে এমটিএফই নামের একটি মুঠোফোন অ্যাপে প্রায় ৭৫ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন। কথা ছিল, বিনিয়োগের বিপরীতে তিনি নিয়মিত মুনাফা পাবেন। নতুন বিনিয়োগকারী এনে দিলে সেখান থেকেও টাকা পাবেন।
মুজিবুর রহমানের পুরো টাকাটিই খোয়া গেছে। কারণ, যে অ্যাপে তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন, সেই অ্যাপ কাজ করছে না।
এভাবে মুঠোফোনের অ্যাপে নিবন্ধন, ডলার কিনে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকার হাতছানি, এক কান, দুই কান থেকে শত শত মানুষের কানে এই লোভের বার্তা; এরপর একদিন দেখা গেল, কোম্পানি উধাও।
মানুষের সঙ্গে এই প্রতারণা করেছে মেটাভার্স ফরেন এক্সচেঞ্জ (এমটিএফই) গ্রুপ ইনকরপোরেটেড নামের একটি প্রতিষ্ঠান, যা সংক্ষেপে এমটিএফই নামে পরিচিত। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে এই প্রতিষ্ঠানের প্রতারণার শিকার হওয়ার খবর আসছে। অন্তত ছয়টি জেলা থেকে প্রথম আলোর প্রতিবেদক ও প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন, হাজার হাজার মানুষের কোটি কোটি টাকা নিয়ে ‘পালিয়েছে’ এমটিএফই।
প্রতারণার ঘটনাটি ঘটেছে সবার সামনে। কিন্তু কেউ বাধা দেয়নি। ইন্টারনেটের সার্চ ইঞ্জিন গুগলের প্লে স্টোরে গতকাল সোমবারও এমটিএফইর অ্যাপ খুঁজে পাওয়া যায়। সেটি নামিয়ে মুঠোফোনে স্থাপনও (ইনস্টল) করা যাচ্ছিল। অ্যাপটি ২০২২ সালের জানুয়ারিতে প্লে স্টোরে আসে। এটি ১০ লাখের বেশিবার ডাউনলোড হয়েছে।
অবশ্য টাকা খোয়ানো ব্যক্তিরা বলছেন, তাঁরা যেভাবে লেনদেন করতেন, অ্যাপটি ব্যবহার করতেন, সেটি আর করা যাচ্ছে না। আর এমটিএফই এখন তাদের টাকাও দিচ্ছে না।
অ্যাপটি বন্ধের উদ্যোগ নেওয়া হবে কি না, জানতে চাইলে ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার মুঠোফোনে বলেন, বন্ধের জন্য এখন পর্যন্ত কেউ তাঁদের বলেনি। কোনো অভিযোগ তাঁরা পাননি। তিনি আরও বলেন, বিষয়গুলো দেখার জন্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও বাংলাদেশ ব্যাংক রয়েছে।
পুলিশের বক্তব্য জানতে গতকাল রাতেই যোগাযোগ করা হয় পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শকের (গণমাধ্যম) দায়িত্বে থাকা অতিরিক্ত পুলিশ সুপার এনামুল হকের সঙ্গে। তিনি তাৎক্ষণিকভাবে বিষয়টি নিয়ে কিছু জানাতে পারেননি।
এমটিএফই মূলত একটি বহুস্তর বিপণন বা মাল্টিলেভেল মার্কেটিং (এমএলএম) কোম্পানি। এর আগে ডেসটিনিসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ব্যবসা করে মানুষের কাছ থেকে বিপুল টাকা নিয়েছিল। পাশাপাশি ই-কমার্স নাম দিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান সব নিয়ন্ত্রক সংস্থার সামনে মানুষের কাছ থেকে টাকা নেয়। পরে অনেকেই টাকা আত্মসাৎ করে।
এমটিএফই কারা চালায়
এমটিএফইর নামে একটি ওয়েবসাইট ও একটি অ্যাপ পাওয়া যায়। সেখানে বলা হয়েছে, তারা কানাডায় নিবন্ধিত। প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা কারা, কারা চালায়, সে–সম্পর্কিত সঠিক তথ্য পাওয়া যায়নি।
অবশ্য ভুক্তভোগীরা বলছেন, তাঁদের বলা হতো এমটিএফই অনলাইন বা ভার্চ্যুয়াল দুনিয়ায় শেয়ার, ডলার, ক্রিপ্টোকারেন্সি (ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা, যেমন বিটকয়েন) কেনাবেচা করে। তারা নিজেদের আফ্রিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে জনপ্রিয় বলে দাবি করত।
বিনিয়োগকারীরা জানান, এমটিএফই এবং বাইন্যান্স নামের দুটি অ্যাপে বিনিয়োগ করতে হতো। সেখানে জাতীয় পরিচয়পত্র ও মুঠোফোন নম্বর এবং ই–মেইল আইডি দিয়ে নিজের নামে একটি প্রোফাইল খুলতে হতো। প্রথমে বিনিয়োগের বিপরীতে ভুক্তভোগীরা পেতেন ভার্চ্যুয়াল মুদ্রা, যাকে ডলার বলা হতো।
বিনিয়োগের বিপরীতে যে ডলার মুনাফা হিসেবে পাওয়া যেত, তা বাইন্যান্স অ্যাপের কাছে আবার বিক্রি করা যেত। টাকা চলে আসত মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা (এমএফএস) প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে।
বিনিয়োগ করতে টাকা জমা দিতে হতো এমটিএফইর প্রতিনিধির স্থানীয় ব্যাংক হিসাবে অথবা মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতার মাধ্যমে। এমটিএফইতে কারও মাধ্যমে ১০০ জন বা দেড় কোটি টাকা বিনিয়োগ করা হলে তাঁকে কান্ট্রি অব অপারেশন সার্ভিস (সিওও) পদমর্যাদা দেওয়া হতো। দেশের বিভিন্ন জেলায় এ রকম শত শত সিওও বানানো হয়েছে বলে জানিয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
জেলায় জেলায় ভুক্তভোগী
বরিশালেই শত শত মানুষ এই এমটিএফইর ফাঁদে পড়েছেন। প্রতারণার শিকার অন্তত ১১ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেখানে অন্তত ১০ কোটি টাকা খুইয়েছেন ভুক্তভোগীরা।
বরিশালের বানারীপাড়ার একজন বিনিয়োগকারী বলেন, গত ফেব্রুয়ারিতে তিনি এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত হয়েছিলেন। সিওও হওয়ার শ্রেণিতে পৌঁছে গিয়েছিলেন তিনি। তাঁর অধীনে ১০০ জনের বেশি যুক্ত হয়েছিলেন। তাঁর বিনিয়োগ ছিল ছয় লাখ টাকা। ১৮ আগস্ট শুক্রবার রাতে হঠাৎ দেখেন প্রতিষ্ঠানটির সার্ভার উধাও।
প্রতারণার শিকার হওয়ার খবর পাওয়া গেছে কুষ্টিয়া, বরিশাল, রাজশাহী, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কুমিল্লা ও সাতক্ষীরা জেলা থেকে। কুষ্টিয়ায় একটি বেসরকারি বিদ্যালয়ের পরিচালক এবং এক সাবেক পুলিশ সদস্য মিলে এমটিএফইর কার্যক্রম চালাতেন। কুমারখালী বাসস্ট্যান্ডসংলগ্ন সিঙ্গার প্লাজার দোতলায় তাদের কার্যালয় ছিল।
বিনিয়োগকারীরা জানিয়েছেন, এই দুজনের কথা ও প্রলোভনে পড়ে জেলার অন্তত পাঁচ হাজার মানুষ এমটিএফইতে শতকোটি টাকা বিনিয়োগ করেছেন। তাঁরা দুজন বর্তমানে সৌদি আরবে আছেন।
এমটিএফইর কুমিল্লা জেলার একজন সিওও কাজী আরিফুল ইসলাম বলেন, কোম্পানি তাঁকে বলেছিল ৩০ হাজার ডলার বিনিয়োগ করলে আরও বড় পদে বসাবে। তাই নিয়মিত টাকা বিনিয়োগ করে আসছিলেন। এখন সবই হারিয়েছেন।
এমটিএফই নিয়ে কোনো জেলার পুলিশ জানত না, তা নয়। বরং আদালত তদন্তের নির্দেশও দিয়েছিলেন।
রাজশাহীতে প্রতারণার অভিযোগে গত ২৩ জুলাই আইনজীবী জহুরুল ইসলাম জেলার সাইবার ট্রাইব্যুনালে মামলার আবেদন করেন। আদালতের বিচারক জিয়াউর রহমান আরজিটি মামলা হিসেবে রেকর্ড করার জন্য নগরের রাজপাড়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) তদন্তের নির্দেশ দেন। একই সঙ্গে তিনটি সংস্থার তিনজন কর্মকর্তাকে যৌথভাবে এই মামলা তদন্তের নির্দেশ দিয়েছিলেন আদালত। পরদিন মামলাটি থানায় রেকর্ড করা হয়। মামলার তদন্তে অগ্রগতি নেই বললেই চলে।
টেলিযোগাযোগ গবেষণা প্রতিষ্ঠান লার্ন এশিয়ার জ্যেষ্ঠ পলিসি ফেলো আবু সাঈদ খান প্রথম আলোকে বলেন, সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে সর্বত্রভাবে মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করা। নাকের ডগা দিয়ে এগুলো হয়ে যাচ্ছে কিন্তু সরকার অপেক্ষা করছে তাদের কাছে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে গিয়ে অভিযোগ জানাবে। তারপর ব্যবস্থা নেবে। এটা তো সুশাসন হতে পারে না।
এসডব্লিউএসএস/১২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ