দীর্ঘ ছয় বছর অতিক্রান্ত হয়ে গেলেও বিজ্ঞানবাদী লেখক ও মুক্তমনা ব্লগের প্রতিষ্ঠাতা অভিজিৎ হত্যার মামলার তেমন কোনো অগ্রগতি হয়নি। মামলা চলছে কচ্ছপ গতিতে। আজ বুধবার(০৬ জানু) ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মজিবুর রহমানের আদালতে মামলার ২৭তম সাক্ষীর সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য দিন ধার্য ছিল। সাক্ষী দেওয়ার কথা ছিল সহকারী পুলিশ কমিশনার ফজলুর রহমানের। কিন্তু এদিন কোনো সাক্ষী আদালতে উপস্থিত না হওয়ায় সময়ের আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। আদালত সময়ের আবেদন মঞ্জুর করে নতুন দিন ধার্য করেন। আগামী ১৩ জানুয়ারি সাক্ষগ্রহণের নতুন দিন ধার্য করেন আদালত।
২০১৯ সালের ২৮ অক্টোবর অভিজিৎ রায়ের বাবা অধ্যাপক অজয় রায়ের সাক্ষ্যগ্রহণের মধ্যে দিয়ে এই মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়। মামলাটিতে চার্জশিটভুক্ত ৩৪ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
২০১৯ সালের ১ আগস্ট মাসে পলাতক বরখাস্তকৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক জিয়াসহ ছয় আসামির বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করে আজ সাক্ষ্যগ্রহণের তারিখ ধার্য করেন ট্রাইব্যুনাল।
অভিযুক্ত ছয় আসামীরা হলেন— আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান সাবেক মেজর সৈয়দ মোহাম্মদ জিয়াউল হক, মোজাম্মেল হুসাইন ওরফে সায়মন (সাংগঠনিক নাম শাহরিয়ার), আবু সিদ্দিক সোহেল (সাংগঠনিক নাম সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাব, আরাফাত রহমান (সাংগঠনিক নাম সিয়াম ওরফে সাজ্জাদ ওরফে শামস), শফিউর রহমান ফারাবি ও আকরাম হোসেন ওরফে আবির ওরফে আদনান ওরফে হাসিবুল ওরফে আব্দুল্লাহ।
ছয় আসামীর মধ্যে মেজর জিয়াউল হক ও আকরাম হোসেন পলাতক। বাকি চার আসামীকে এদিন কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়।
২০১৫ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত সোয়া ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের পাশে ব্লগার ও লেখক অভিজিৎ রায়কে সন্ত্রাসীরা কুপিয়ে জখম করে। আহত অবস্থায় তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নেয়া হলে রাত সাড়ে ১০টার দিকে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান।
পরের দিন ২৭ ফেব্রুয়ারি অভিজিতের বাবা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ অজয় রায় শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা করেন। ২০১৯ সালের ১৩ মার্চ ঢাকা মহানগর হাকিম সরাফুজ্জামান আনসারীর আদালতে ছয়জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের পরিদর্শক মনিরুল ইসলাম।
২০১৯ সালের ১১ এপ্রিল ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান ছয় আসামীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন। এরপর একই বছরের ১ আগস্ট আসামীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করে বিচার শুরুর আদেশ দেন আদালত।
এদিকে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপন হত্যা মামলাও চলছে ঢিমেঢালাভাবে। ২০১৫ সালের ৩১ অক্টোবর রাজধানীর শাহবাগে আজিজ সুপার মার্কেটের নিজ অফিসে জাগৃতি প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ফয়সল আরেফিন দীপনকে কুপিয়ে হত্যা করে দুর্বৃত্তরা। সেদিন বিকেলে তার স্ত্রী শাহবাগ থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন।
২০১৮ সালের ১৫ নভেম্বর সন্ত্রাসবিরোধী আইনে চার্জশিট দাখিল করেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবি ঢাকা দক্ষিণের সহকারী পুলিশ কমিশনার ফজলুর রহমান। চার্জশিটে আটজনকে অভিযুক্ত ও ১১ জনকে অব্যাহতির সুপারিশ করা হয়। দীর্ঘ ছয় বছরে মামলাটিতে ২৬ জন সাক্ষীর মধ্যে ২৩ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ শেষ হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট মহল অভিযোগ তোলেন, সরকারের সদিচ্ছার অভাবে ব্লগার ও লেখক হত্যার মামলা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এগোচ্ছে না। রাজনৈতিক কারণেই হোক অথবা স্বার্থের প্রয়োজনেই হোক, মামলাগুলো স্বাভাবিক প্রক্রিয়া পাচ্ছে না। তারা অভিযোগ করে বলেন, সরকার স্বার্থের প্রয়োজনে মামলা মন্থর করে রেখেছেন এবং স্বার্থের প্রয়োজনেই গতি দিচ্ছেন। এতে দুর্বৃত্তরা পরবর্তী কাউকে টার্গেট করে হত্যার পরিকল্পনায় সাহস পাচ্ছেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেন তারা। মুক্তচিন্তার মানুষ অভিজিৎ রায়ের খুনিরা অচেনা নয়। যেই অন্ধকারের শক্তি আলোকে ভয় পায়, ভিন্নমতকে সহ্য করে না, তারাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী এই মেধাবী প্রকৌশলীকে হত্যা করেছে। অভিজিৎ পেশায় একজন প্রকৌশলী হলেও মুক্তচিন্তার চর্চা করে আসছিলেন। মুক্তমনা ব্লগটির প্রতিষ্ঠাতা তিনি। নানা কুসংস্কার ও ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে লেখালেখির কারণে জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী আগেই তাকে হত্যার হুমকি দিয়ে আসছিল। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের টিকিটিও খুঁজে পায়নি। আর এদিকে আদালতে মামলা চলছে না চলার মতো গতিতে। এসবের জন্য সরকারের সদিচ্ছার অভাবকে দায়ি করেন বিশেষজ্ঞ মহল।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৮৩০
আপনার মতামত জানানঃ