এই সৌরমণ্ডলে যে আমরা একা নই, প্রাণ থাকতে পারে অন্যত্রও, সেই সম্ভাবনা আরও জোরালো হল। বিশেষ করে তা আরও জোরালো হয়ে উঠল বৃহস্পতির একটি চাঁদ ‘ইউরোপা’-য়।
একটি সাম্প্রতিক গবেষণা জানাল, পৃথিবীর মহাসাগরগুলিতে যতটা জল আছে তার চেয়ে ঢের বেশি আছে বৃহস্পতির অনেকগুলি চাঁদের একটি ইউরোপায়। তরল জলের সেই মহাসাগরগুলি রয়েছে ইউরোপার পুরু বরফে মোড়া পিঠের নীচে। প্রাণের সৃষ্টি ও বিকাশের জন্য যে রাসায়নিক উপাদানগুলির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি সেগুলিও রয়েছে ইউরোপার অতলান্ত মহাসাগরে।
এমনকি, প্রাণের আর একটি প্রধান উপাদান অক্সিজেনও প্রচুর পরিমাণে রয়েছে ইউরোপার বরফে মোড়া পিঠে। যাকে টেনে বরফের নীচে নিয়ে গিয়ে তরল জলের মহাসাগরে মেশাচ্ছে ইউরোপাই। তার অভিনব কলাকৌশলে। যার ফলে পুরু বরফে মোড়া পিঠের উপরে জমা অক্সিজেনের ৮৬ শতাংশই পৌঁছে যাচ্ছে ইউরোপার অন্তরে থাকা অতলান্ত জলের মহাসাগরগুলিতে।
সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ বৃহস্পতি ও তার চার চাঁদের মধ্যে তিনটিকে নিয়ে অনুসন্ধান চালাতে মহাকাশযান পাঠাতে চলেছে ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি (ইএসএ)। বৃহস্পতির হিমশীতল চাঁদগুলো নিয়ে চালাতে যাওয়া এই উচ্চাভিলাষী অভিযানের সংক্ষিপ্ত নাম দেওয়া হয়েছে জুস মিশন।
সৌরজগতের প্রায় প্রান্তে অবস্থিত বৃহস্পতি গ্রহের কাছে পৌঁছতে ইএসএ যানটির সময় লাগবে আট বছর। এখন রওনা হলে ২০৩১ সালের জুলাই মাসে মহাকাশযানটি বৃহস্পতির কাছে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
পরবর্তী সাড়ে তিন বছর ধরে বৃহস্পতি ঘিরে বহুবার ঘুরবে এটি। এ সময় বৃহস্পতির উপগ্রহ গ্যানিমেড, ক্যালিস্টো ও ইউরোপার পাশ দিয়েও অতিক্রম করবে যানটি।
ধারণা করা হচ্ছে, বৃহস্পতির এই তিনটি বরফাচ্ছাদিত চাঁদের মাটির নিচে গভীরে প্রাণের বিকাশের অনুকূল সমুদ্র থাকতে পারে। জুস মিশনের যানটি গতকাল বৃহস্পতিবারই ফরাসি গায়ানার উৎক্ষপণ কেন্দ্র থেকে মহাকাশে পাঠানোর কথা থাকলেও সেখানকার আবহাওয়া অনুকূল না থাকায় তা এক দিন পেছানো হয়েছে।
বৃহস্পতির তিনটি উপগ্রহে সাগরের অস্তিত্ব ছিল বা আছে কি না; গ্যানিমেডের অনন্যতার কারণ এবং চাঁদগুলো প্রাণ ধারণের উপযোগী কি না তার জবাব খোঁজা এই মিশনের অন্যতম উদ্দেশ্য।
গ্যানিমেড আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় উপগ্রহ, যা বুধ গ্রহের চেয়েও বড়। এটিই একমাত্র উপগ্রহ, যার পৃথিবীর মতো নিজের চৌম্বকক্ষেত্র রয়েছে। মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসাও ইউরোপা উপগ্রহে অভিযান চালাবে।
তাদের মিশনটি আগামী বছর শুরুর কথা রয়েছে। নাসার মহাকাশযান ২০৩০ সালের এপ্রিল নাগাদ বৃহস্পতির কাছে পৌঁছাতে পারে। এর পর ইউরোপা উপগ্রহের পাশ দিয়ে ৫০ বার ঘুরবে। এক পর্যায়ে তা ইউরোপার পৃষ্ঠের মাত্র ২৫ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যেতে পারে। এই দুটি অভিযানের মাধ্যমে বৃহস্পতি ও এর চাঁদের অজানা রহস্য উদঘাটিত হতে পারে বলে আশা করা হচ্ছে।
গবেষণা কী বলছে?
বৃহস্পতি হলো আমাদের সৌরজগতের সবচেয়ে বড় গ্রহ। বৃহস্পতির মতো একটা বিশাল গ্যাসীয় গ্রহের আবহমণ্ডল হাইড্রোজেন, হিলিয়াম, মিথেন, পানি ও অ্যামোনিয়াতে সমৃদ্ধ থাকে। এই ধরনের গ্রহে কোনো উপযুক্ত শক্ত পৃষ্ঠ নেই। বরং একটি ঘনত্বসম্পন্ন, মেঘময় আবহমণ্ডল আছে, যার মধ্যে আকাশ থেকে জৈব অণুগুলো পড়ছে অনেকটা আমাদের পরীক্ষাগারে উত্পন্ন জৈব অণুগুলোর মতো। যেভাবে হোক, এই ধরনের গ্রহে প্রাণের প্রতিকূলে চরিত্রগত বাধা আছে।
এই আবহমণ্ডল খুবই ঝঞ্ঝাপূর্ণ বা টারবুলেন্ট এবং গভীরে প্রচণ্ড উত্তপ্ত। একটা প্রাণীকে অবশ্য নিচে পড়া ও ঝলসানো থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সতর্ক হতে হবে। এই ধরনের খুবই ভিন্ন রকম একটি গ্রহে প্রাণের বিকাশ যে প্রশ্নের বাইরে নয়, এটা দেখানোর জন্য কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ই ই সাল্পটার ও কার্ল সাগান একটা হিসাব করেছিলেন।
অবশ্য ওই ধরনের জায়গায় প্রাণকাঠামো কেমন হবে, নিখুঁতভাবে কিছু বলা সম্ভব নয়। আসলে তারা দেখাতে চাচ্ছিলেন, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের নিয়মকানুন মেনে এই ধরনের একটি গ্রহ বা জগতে প্রাণী–অধ্যুষিত হওয়া সম্ভব হতে পারে।
এ রকম একটা পরিস্থিতিতে একটি জীবন্ত বস্তুকে টিকে থাকতে হলে তাকে ঝলসে যাওয়ার আগেই পুনরুত্পাদনে যেতে হবে। আশা করা যায়, পরিচলন প্রক্রিয়া তাদের বংশধরের কিছু সংখ্যককে আবহমণ্ডলের অপেক্ষাকৃত উঁচু ও শীতল স্তরের দিকে নিয়ে যাবে। ওই ধরনের প্রাণীগুলো খুব ছোট হতে পারে। আমরা তাদেরকে ডাকব সিঙ্কার বলে।
কিছু কিছু ফ্লোটারও হতে পারে, এগুলোর বিশাল হাইড্রোজেন বেলুনগুলোর অভ্যন্তর থেকে হিলিয়াম ও অত্যন্ত ভারী গ্যাসগুলোকে বের করে দিয়ে হাইড্রোজেন ও হালকা গ্যাসগুলোকে ধরে রাখে। অথবা তারা একটা উত্তপ্ত বায়ুভরা বেলুনও হতে পারে, যা তাদের অভ্যন্তরীণ উষ্ণতা ব্যবহার করে প্লাবতাকে স্থির রাখে। যে খাদ্য এরা গ্রহণ করে, তা থেকে অর্জিত তাপশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে কাজটি করে থাকে। পরিচিত পার্থিব বেলুনের মতো, একটা ফ্লোটারকে যত গভীরে নিয়ে যাওয়া হয়, তার ওপর প্রযুক্ত প্লাবতা তত বাড়ে, যা ফ্লোটারকে ঠেলে দেয় আবহমণ্ডলের আরও উঁচু, শীতল, নিরাপদ অঞ্চলের দিকে।
একটি ফ্লোটার পূর্বের তৈরি জৈব অণুগুলোকে খায়, অথবা নিজেকে তৈরি করে সূর্যের আলো ও বায়ুমণ্ডলে থেকে, পৃথিবীর উদ্ভিদেরা যেভাবে শক্তি অর্জন করে। এভাবে একটা অবস্থা পর্যন্ত বড় হবে ফ্লোটাররা, হবে আরও দক্ষ। সাল্পটার ও সাগান কল্পনা করেছিলেন, ফ্লোটাররা কিলোমিটার থেকে কিলোমিটার প্রশস্ত হবে। এত বড় যে পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তিমির চেয়েও বড়, শহরের আকার–আকৃতির মতো।
ফ্লোটারগুলো নিজেদের এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে গ্যাসীয় পদার্থের দমকা আঘাতে, অনেকটা রামজেট অথবা রকেটের মতো। বিজ্ঞানীরা তাদেরকে অলসভাবে বিচরণশীল প্রাণী হিসেবে কল্পনা করেছিলেন, অন্তত চোখে দেখে তা–ই মনে হবে। তবে তাদের চামড়ায় থাকবে কিছু অভিযোজনক্ষম পরিবর্তনশীল বিন্যাস, যা আসলে একধরনের ছদ্মবেশ, সম্ভবত আত্মরক্ষার জন্য ফ্লোটারদের এগুলো প্রয়োজন হয়।
এ রকম পরিবেশে পারস্পরিক পরিবেশগত উপযুক্ত বাস্তুস্থিতি স্থানের কারণে আরেক ধরনের প্রাণীর কথা চিন্তা করা যায়। যেমন হান্টার। এরা হলো দ্রুতগামী ও কৌশলী। ফ্লোটারদের শরীরের থাকা জৈব অণুগুলো এবং জমা করে রাখা বিশুদ্ধ হাইড্রোজেনের জন্য হান্টাররা তাদের ধরে খাবে। স্বচালিত ফ্লোটারদের থেকে প্রথম দিকের হান্টারদের বিকাশ ঘটে থাকতে পারে। সেখানে খুব বেশি হান্টাররা থাকতে পারে না। কারণ, তারা যদি সব ফ্লোটারকে খেয়ে ফুরিয়ে ফেলে, তাহলে খাদ্যের অভাবে তারা ধ্বংস হয়ে যাবে।
পদার্থবিজ্ঞান ও রসায়নশাস্ত্র মেনে নেয় এই ধরনের প্রাণকাঠামো। শিল্পকলা তাদেরকে বিভিন্ন গুণ ও সৌন্দর্য দ্বারা মনোমুগ্ধকর করে তোলে। এই ধরনের অনুমান অনুসরণে প্রকৃতি বাধ্য নয়। যদি শতকোটি প্রাণী–অধ্যুষিত জগৎ থাকে এই মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সিতে, তাহলে সেখানে অন্তত কিছুসংখ্যক জগতে সিঙ্কার, ফ্লোটার, হান্টারদের মতো প্রাণীরা অধ্যুষিত হবে, যা আমাদের কল্পনায় তৈরি হয়েছে পদার্থবিদ্যা ও রসায়নের নিয়ম মেনে।
জীববিজ্ঞান হলো এমন একটা বিজ্ঞান, তা যত না পদার্থবিজ্ঞানের মতো, তার চেয়ে বেশি ইতিহাসের মতো। বর্তমানকে বোঝার জন্য আমাদেরকে জানতে হবে অতীত এবং জানতে হবে সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম বিস্তৃতির মধ্য দিয়ে। জীববিজ্ঞানে ভবিষ্যদ্বাণীমূলক তত্ত্ব নেই, যেমন নেই ইতিহাসে। কারণগুলো একই: উভয় বিষয় এখনো খুবই জটিল আমাদের কাছে। আমরা আমাদের সম্পর্কে ভালোভাবে জানি অন্য ক্ষেত্রগুলো বোঝার দ্বারা।
কার্ল সাগান বলেন, ‘বহির্জাগতিক প্রাণের একটি ঘটনা হয়ত জীববিজ্ঞান সম্পর্কে আমাদেরে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিতে পারে। প্রথমবারের মতো জীববিজ্ঞানীরা বুঝতে পারবেন, আর কী কী ধরনের প্রাণকাঠামো সম্ভব। যখন আমরা বলি বহির্জাগতিক প্রাণের অনুসন্ধান খুবই গুরুত্বপূর্ণ, তার মানে এই নয় যে আমরা নিশ্চয়তা দিচ্ছি বহির্জাগতিক প্রাণের ব্যাপারে। আমরা শুধু এ কথা বলতে চাচ্ছি, এই অনুসন্ধান মহামূল্যবান।
পৃথিবীতে প্রাণের প্রকৃতি এবং আর কোনো জায়গায় প্রাণ আছে কি না, তার অনুসন্ধান হলো একই প্রশ্নের দুটো দিক। তা হলো ‘আমরা কে’—তার অনুসন্ধান, যা প্রাচীন কাল থেকে মানুষ করে আসছে। আমরা এ পর্যন্ত প্রাণের একটি সুর শুনেছি। শুধু একটি ছোট্ট জগতে। কিন্তু অবশেষে আমরা শুনতে আরম্ভ করেছি মহাজাগতিক ঐক্যতানের অন্যান্য সুর, যা আমাদের অস্তিত্ব রক্ষায় সহায়তা করবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১২২০
আপনার মতামত জানানঃ