আদিকালে ঠিক কখন থেকে গুপ্তচর ব্যবস্থার প্রচলন ঘটেছিল বলা মুশকিল। তবে এটি যে পৃথিবীর প্রাচীনতম একটি পেশা তাতে কোনো সন্দেহ নেই। সভ্যতার প্রাথমিক যুগে মানুষ যখন দলবদ্ধ হয়ে বাস করতে শুরু করে তখন থেকে গোষ্ঠী সংঘাতেরও সূত্রপাত হয়। বিবদমান দলের সর্দাররা একে অন্যের গোপন খবর সংগ্রহের জন্য গুপ্তচর নিয়োগ করত।
প্রাচীন ভারত, গ্রিস, চীন, পারস্য, রোম, মিসর, সিরিয়া, আরব ইত্যাদি ভূখণ্ডের শাসন ব্যবস্থায় গুপ্তচর ছিল অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি অংশ। প্রাকযুদ্ধ, যুদ্ধের সময় ও যুদ্ধশেষে একে অন্যের গোপন তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে গুপ্তচর পাঠাত। উপমহাদেশে সিন্ধু সভ্যতার যুগেও সম্ভবত রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থার একটি অঙ্গ ছিল কূটনীতি, যে কাজে গুপ্তচরদের ভূমিকাও কম গুরুত্বের ছিল না।
বৈদিক সাহিত্যেও গুপ্তচর ব্যবস্থার উল্লেখ পাওয়া যায়। ঋগবেদে দেবাসুরের দ্বন্দ্বে গুপ্তচর ব্যবহার করা হতো। বরুণ, ইন্দ্র, অগ্নি অর্থাৎ সব দেবতাদেরই চর ছিল। বরুণের চরদের বলা হয়েছে stars of the night and the beholders of men.
আদিকালের গুপ্তচরবৃত্তির উত্তরাধিকার পরবর্তী যুগেও এসে পৌঁছেছিল সদর্পে। পরবর্তীকালে রোমান যুগেও গুপ্তচরবৃত্তির দারুণ অগ্রগতি ঘটে। রোমান সাম্রাজ্য বিস্তারে শক্তির পরিচয় দিলেও সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে গুপ্তচরদের ব্যবহার ছিল উল্লেখযোগ। রোমান সম্রাট জাস্টিনিয়ানের আমলে গুপ্তচর হিসেবে নারীদের ব্যবহারে সবচেয়ে কার্যকর কূটনৈতিক দক্ষতার পরিচয় পাওয়া গিয়েছিল।
কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র, বৌদ্ধজাতক ইত্যাদি অনেক প্রাচীন গ্রন্থে আছে গুপ্ত খবর সরবরাহের জন্য পায়রা, ময়না, শুক, তোতা প্রভৃতি পাখি এমনকি কাককেও প্রশিক্ষণ দেয়ার কথা।
আরবের আব্বাসীয় বংশীয় রাজারা এশিয়া মাইনরের অধিকাংশ অঞ্চল, উত্তর আফ্রিকা ও স্পেনের কিছু অংশ মুসলিম সাম্রাজ্যভুক্ত করেন। তাদের গুপ্তচর ব্যবস্থা ছিল অত্যন্ত সুদক্ষ। কোনো রাজ্য আক্রমণের আগে আব্বাসীয় রাজারা সেখানে ছদ্মবেশে চর পাঠাতেন। চররা ওই অঞ্চলের পথঘাট, অভ্যন্তরীণ শাসন ব্যবস্থা, প্রজাদের মনোভাব ও সামরিক শক্তির খবরাখবর সংগ্রহ করত। তাদের সংগৃহীত তথ্যের ওপর ভিত্তি করে শত্রুরাজ্য আক্রমণের পরিকল্পনা এবং মানচিত্র তৈরি করা হতো।
এই যেমন চীনা ইতিহাসে গুপ্তচর ব্যবহারের সবচেয়ে প্রাচীন ঘটনাটি চীনের Spring and Autumn period (770~476 BC) নামে খ্যাত সময়কালে। চীনের উ রাজ্য প্রতিবেশী ইউ রাজ্য জয় করে রাজা গৌ জিয়ানকে বন্দি করেছিল। মুক্তি পাওয়ার পর গৌ জিয়ান প্রতিশোধ নেয়ার উপায় খুঁজতে থাকে। কিন্তু তিনি জানতেন তাঁর সামরিক শক্তি যথেষ্ট নয়। তাই তিনি উ রাজ্যের অভ্যন্তরীণ দুর্বলতার ওপর আঘাত করতে চাইলেন। তিনি তাঁর প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশ দিলেন দশজন সেরা সুন্দরীকে বেছে আনতে। যাদের মধ্য থেকে দুজনকে বেছে নিয়ে তিনি উ রাজ্যের রাজা ফু-চাংকে উপহার দিলেন নজরানার সঙ্গে। সেই দুজন ছিল অতি দক্ষ দুজন গুপ্তচর। মোহনীয় রূপ যৌবন দিয়ে রাজপুরুষদের মনোরঞ্জন করে নিজ নিজ দায়িত্ব থেকে মনোযোগ সরিয়ে দেয়ার পাশাপাশি তাদের অন্য একটি কাজ ছিল। ফু-চাং এবং তার মন্ত্রীকে প্রতিবেশী রাজ্যের বিরুদ্ধে অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধে প্ররোচিত করে সামরিক শক্তি ক্ষয় করা।
তবে চীনের ইতিহাসে গুপ্তচর বিষয়ে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন দার্শনিক-জেনারেল সান-জু (Sun Tzü)। তিনি খ্রিস্টপূর্ব ৪৯০ সালে তাঁর Art of War গ্রন্থের ত্রয়োদশ অধ্যায়টি গুপ্তচরবৃত্তির ওপর লিখেছেন। ‘যেকোনো যুদ্ধের প্রধান উপকরণ হলো ধোঁকাবাজি’—এ যুক্তির ভিত্তিতে তিনি গুপ্তচরবৃত্তি নিয়ে যে নতুন তত্ত্ব দিয়েছিলেন তা এখনো আধুনিক গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে জনপ্রিয়। তিনি যুদ্ধের অর্থনৈতিক ও মানবিক ক্ষতিকে বিবেচনায় নিয়ে এমন পদ্ধতি বেছে নেয়ার সুপারিশ করেন, যাতে অর্থব্যয় ও লোকক্ষয় দুটোই কম হয়। সেই পদ্ধতিটি হলো গুপ্তচরবৃত্তি। যথাযথভাবে গুপ্তচরদের ব্যবহার করে শত্রুর গতিপ্রকৃতি নির্ণয় করে অগ্রসর হলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সৈন্য লাগে না এবং নিরপরাধ লোকক্ষয় কমানো যায়।
তবে তাঁর মতে যেকোনো গুপ্তচরকে সফল হওয়ার জন্য জন্মগত কিছু গুণের অধিকারী হতে হবে। যে গুণাবলি তাকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করতে পারে। তাঁর মতে, Spies cannot be usefully employed without a certain intuitive sagacity. Without subtle ingenuity of mind, one cannot make certain of the truth of their reports.
সম্রাট জেরজেসের আমলের আগে পারস্যের রাজাদের গুপ্তচরবৃত্তির দীর্ঘ ঐতিহ্য ছিল। গ্রিক ঐতিহাসিক হেরোডোটাস লিখেছিলেন রাজা ডিওয়েসেস (খ্রিস্টপূর্ব ৭০১-৬৫৫) গুপ্তচরদের একটি বিস্তৃত নেটওয়ার্ক রেখেছিলেন যারা ‘তাঁর রাজত্বের প্রতিটি কোণে দেখার এবং শোনার জন্য ব্যস্ত’। সাইরাস দ্য গ্রেট (৫৫৯-৫৩০ খ্রিস্টপূর্ব) এ প্রথা অব্যাহত রেখে সাধারণত গুপ্তচরদের একটি নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠিত করেন, যা সাধারণত ‘রাজার চোখ ও কান’ নামে পরিচিত। জেনোফোনের মতে, সাইরাস গুপ্তচরবৃত্তিকে খুব চাতুর্যের সঙ্গে ব্যবহার করতেন। তিনি একবার পারস্য ভ্রমণকারী একদল ভারতীয় দূতকে প্রতিবেশী একটা দেশে গুপ্তচর হিসেবে নিয়োগ করেছিলেন। অভিযানে পাঠানোর আগে তিনি তাদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘কিছু গুপ্তচর আছে যারা দাসদের চেয়ে উন্নত নয়। তারা জানা ব্যাপারের বাইরে নতুন কিছু জেনে আসতে পারে না। তবে অন্য একধরনের লোক আছে যারা এমন কিছু আবিষ্কার করতে পারে, যা এখনো কেউ জানে না।’ সেই গুপ্তচররা ফিরে এসে যেসব খবর দিয়েছিলেন সাইরাস সেটা বিশ্বাস করেছিলেন। কারণ তাঁর হাতে বন্দি সেই দেশের সৈন্যরাও একই তথ্য দিয়েছিল।
পারস্যের গুপ্তচরবৃত্তির আরেকটি উল্লেখযোগ্য উদাহরণ আছে রাজা কেমবিসেসের (খ্রিস্টপূর্ব ৫৩০-৫২২) রাজত্বকালে। যিনি মিসর জয় করেছিলেন এবং ইথিওপিয়ায় গুপ্তচর পাঠিয়েছিলেন উপঢৌকন সহকারে। তখন এটি সর্বজনবিদিত ছিল যে এসব দূতিয়ালি কর্ম আসলে একধরনের প্রকাশ্য গুপ্তচরবৃত্তি। ইথিওপিয়ার রাজাও সেটা বুঝে তার রাজ্যের শক্তিমত্তা প্রদর্শন করেছিলেন দূতের কাছে।
পরবর্তী যুগের সম্রাট জেরজেস গুপ্তচর পন্থায় আস্থা রাখতেন না, তিনি বরং স্বপ্নে পাওয়া নির্দেশের ওপর বিশ্বাস করতেন। একবার তিনি পরপর কয়েকবার স্বপ্নে দেখলেন গ্রিস আক্রমণের দৃশ্য। স্বপ্নটা বাস্তবায়নের খায়েশ হলো তার। তার আগে পূর্বপ্রস্তুতির জন্য তিনি পারস্যে নির্বাসিত স্পার্টার সাবেক রাজা ডেমিরাটাসের কাছে গ্রিস সংক্রান্ত কিছু তত্ত্ব-তালাশ করলেন। ডেমিরাটাস অনুমান করলেন পারস্যের হাতে তাঁর দেশ আক্রান্ত হতে যাচ্ছে। সিংহাসন বঞ্চিত হওয়া সত্ত্বেও এ অভিযানের ব্যাপারে একটি সতর্কবাণী লিখে খুব গোপনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন স্পার্টায়। বার্তা পেয়ে গ্রিকরা পারস্যের আক্রমণ ঠেকানোর জন্য আগাম প্রস্তুতি নিতে পেরেছিল। এটা ছিল দেশপ্রেমসুলভ স্বেচ্ছা গুপ্তচরবৃত্তি। সূত্রঃ সিল্ক রুট।
এসডব্লিউ/এসএস/১৩২৫
আপনার মতামত জানানঃ