ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ৫টি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে। শুধু এই শহরেই প্রতিদিন ২.৫ কোটিরও বেশি পলিথিন ব্যাগ একবার ব্যবহার করে ফেলে দেওয়া হয় বলে উঠে এসছে সাম্প্রতিক এক গবেষণায়।
রোববার (২৫ জুন) বিশ্ব পরিবেশ দিবস-২০২৩ উদযাপন উপলক্ষে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা)- এর উদ্যোগে আয়োজিত ‘পলিথিন-প্লাস্টিক দূষণে বিপন্ন বাংলাদেশ: করণীয় ও প্রতিকার’ শীর্ষক আলোচনা সভায় জানানো হয়, ঢাকা শহরে একটি পরিবার প্রতিদিন গড়ে ৫টি পলিথিন ব্যাগ ব্যবহার করে।
ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সাগর-রুনি মিলনায়তনে অনুষ্ঠিত এ আলোচনা সভায় বাপা’র সহ-সভাপতি অধ্যাপক এম. ফিরোজ আহমেদ এনভায়রোনমেন্ট অ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন (এসডো)- এর সম্প্রতি করা গবেষণাটি থেকে এসব তথ্য তুলে ধরেন।
মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনে এম. ফিরোজ আহমেদ বলেন, প্লাস্টিক দূষণে অবদান রাখা দেশেগুলোর মধ্যে শীর্ষ ২০টি দেশের তালিকায় বাংলাদেশ রয়েছে। দেশে প্রতিদিন ৩৫ লাখের বেশি টিস্যু ব্যাগ উৎপাদন ও বাজারজাত হচ্ছে। এসব ব্যাগ পলিথিনের হলেও কাপড়ের ব্যাগ হিসেবে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, প্লাস্টিকের ব্যাগ দ্বারা অবরুদ্ধ নিস্কাষণ ব্যবস্থাকে বর্ষা মৌসুমে বাংলাদেশে নগর বন্যার একটি প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
সভায় পরিবেশ অধিদপ্তরের কথা উল্লেখ করে বাপার যুগ্ম সম্পাদক মিহির বিশ্বাস বলেন, প্রতিবছর দেশে ১০ লাখ ৯৫ হাজার টন প্লাস্টিক বর্জ্য উৎপাদিত হয়।
তিনি বলেন, প্রকৃতিতে মিশে প্লাস্টিক খাদ্য চক্রের মাধ্যমে উদ্ভিদ, প্রাণী ও মানুষের দেহে চলে এসেছে। এটি জনস্বাস্থ্যে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। প্লাস্টিক সমস্যার সমাধান না করলে প্রাণী ও মানবসমাজ অস্তিত্ব সংকটে পড়বে।
সভায় বাপা’র যুগ্ম সম্পাদক স্থপতি ইকবাল হাবিব বাপা’র পক্ষ থেকে প্লাস্টিক-পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধে সমন্বয় সেল গঠনসহ ১৫ দফা দাবি উপস্থাপন করেন।
ইকবার হাবিব বলেন, ‘থ্রি আর’ (রিডিউস, রিইউজ ও রিসাইকেল) এর প্রতি জোর দিতে হবে। প্লাস্টিক জাতীয় বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করার জন্য এ সংক্রান্ত অ্যাকশন প্ল্যানের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।
তার অন্যান্য দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে- প্লাস্টিক ও পলিথিনজাত পণ্যের নিয়ন্ত্রণ ও নিষিদ্ধকরণ আইনের সঠিক, দ্রুত, নির্মোহ ও কঠোর বাস্তবায়ন করা; পলিথিন শপিং ব্যাগ নিষিদ্ধ আইনের সফল প্রয়োগের জন্য সরকারি ও বেসরকারি সমন্বয়ে সেল গঠন করা; চকচকে প্যাকেটজাত খাদ্যসহ বিভিন্ন দ্রব্যাদি প্যাকেটজাতকরণে পলিথিন ও প্লাস্টিকের ব্যবহারের ওপরে উচ্চ কর আরোপের বিধান প্রবর্তন করা।
সভায় বাপার ভারপ্রাপ্ত সভাপতি অধ্যাপক নূর মোহাম্মদ তালুকদার সভাপতিত্বে আরও বক্তব্য রাখেন বাপার নির্বাহী সদস্য ও ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবাইলোজি বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুব হোসেন, এসডোর হেড অব প্রোগ্রাম মনোয়ারুল ইসলাম প্রমুখ।
পলিথিনের ব্যবহার কেন বন্ধ করতে হবে?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের প্রধান, অধ্যাপক ডঃ হাফিজা খাতুন বলছেন, প্লাস্টিক এমন একটি পদার্থ যার আয়ুষ্কাল হাজার হাজার বছর।
যা মাটিতে গেলে ক্ষয় হয়না বা মাটির সাথে মিশে যায়না। এটি মাটিতে পানি ও প্রাকৃতিক যে পুষ্টি উপাদান রয়েছ তার চলাচলকে বাধাগ্রস্ত করে। যার ফলে মাটির গুনগত মান হ্রাস পায়।
গাছ তার খাবার পায়না। মাটি ও পানিতে প্লাস্টিক কণা ছড়িয়ে পড়ে। যা হয়ত পানি থেকে মাছের শরীরে যাচ্ছে।
মাটিতে প্লাস্টিকের তৈরি টক্সিক রাসায়নিক পদার্থ গাছে মিশে যাচ্ছে। আর তা শেষমেশ শুধু পশু পাখি নয় মানুষের শরীরেও এসে পৌছায়। প্লাস্টিক মানুষের শরীরে আরো অনেক মরণ ব্যাধির পাশাপাশি ক্যান্সারের জন্য দায়ী।
যে সুবিধার জন্য আপনি প্লাস্টিক ব্যবহার করেন যেমন ফুটো না হলে এতে পানি ঢোকে না বা বের হয়না।
সেই একই কারণে পলিথিন বা প্লাস্টিকের বর্জ্য যেখানে সেখানে ফেলে দিলে তা নর্দমায় আটকে গিয়ে পানির প্রবাহে বাধা দেয়। যার ভুক্তভোগি দেশের কোটি কোটি মানুষ। একটু বৃষ্টি হলেই জমে যায় পানি।
পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা আর্থ ডে নেটওয়ার্ক এক প্রতিবেদনে বলছে বিশ্বে প্লাস্টিক দূষণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ১০ নম্বরে।
ডঃ হাফিজা খাতুন বলছেন, “আমাদের দেশে ব্যবসায়িক ও আর্থিকভাবে লাভজনক না হলে মানুষ কিছু করে না। শুধু সচেতনতা বা সমাজের কল্যাণের জন্য কিছু হয়না। পলিথিন ব্যাগ সাধারণের জন্য অর্থনৈতিক দিক থেকে লাভজনক কারণ এটি সস্তা ও সহজে পাওয়া যায়। যখন আর্থিকভাবে লাভজনক বিকল্প আসবে শুধুমাত্র তখনই এর ব্যবহার আমি ছাড়বো”
এটি হয়ত একটি কারণ। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হল বিশ্বে যে দেশটি সবচেয়ে আগে পলিথিনের ব্যবহার নিষিদ্ধ করেছিলো সেটি হল বাংলাদেশ।
কিন্তু বাজারে গিয়ে দেখা গেলো বিষয়টি মারাত্মকভাবে তার গুরুত্ব হারিয়েছে। ক্রেতা ও বিক্রেতা দু পক্ষের কাছেই। একজন ক্রেতা জানান, “বাজার থেকে ফেরার সময় টপ টপ করে মাছ বা মাংসের রক্ত পড়ছে না। হঠাৎ পথের মধ্যে কাগজের ব্যাগের মতো ছিঁড়ে পড়ে যাচ্ছে না”
পশ্চিমের দেশগুলোতে দোকানে এমন ব্যাগের জন্য পয়সা নেয়া শুরুর পর থেকে অনেকেই সাথে করে ব্যাগ নিয়ে যাওয়া শুরু করেছেন। বাংলাদেশে সেই অভ্যাস চলে গেছে পলিথিনের কারণে।
আপনার মতামত জানানঃ