বাংলাদেশে ২০২৩-২০২৪ অর্থবছরের জন্য যে বাজেট পেশ করা হয়েছে সেটির সাথে বাস্তবতার তেমন একটা সম্পর্ক নেই বলে মনে করে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ বা সিপিডি। শুক্রবার ঢাকায় বাজেট সম্পর্কে বিস্তারিত পর্যালোচনা তুলে ধরে সিপিডি। বাজের মাধ্যমে সরকার যেসব লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে সেগুলো অর্জন করা সম্ভব হবে কি না সেটি নিয়ে অনেক সন্দেহ ও সংশয় আছে বলে মনে করে সিপিডি।
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেটে করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর নীতির প্রশংসা করেছে সিপিডি। কিন্তু করযোগ্য আয় না থাকলে দুই হাজার টাকা কর দেবার যে বিধান রাখা হয়েছে সেটির সমালোচনা করেছে সিপিডি। সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বলেন, “যার করযোগ্য আয় নেই তার জন্য কর বাধ্যতামূলক করা বৈষম্যমূলক ও অন্যায্য।”
নীট সম্পদ চার কোটি টাকার বেশি হলে মোট আয়করের উপর ১০ শতাংশ সারচার্জ প্রস্তাব করা হয়েছে। গত বছর এটি ছিল তিন কোটি টাকা। এ বিষয়টির সমালোচনা করে সিপিডি বলেছে, এখানে ছাড়া দেয়া ঠিক হয়নি এবং বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। এছাড়া ভ্রমণ কর আরোপের মাধ্যমে প্রবাসী শ্রমিকদের ওপর চাপ পড়তে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ ফাহমিদা খাতুন।
সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, নির্বাচনের আগে বিভিন্ন স্বার্থ গোষ্ঠীর কথা মাথায় রেখে সরকার কর কাঠামো, ব্যক্তি শ্রেণির জন্য আয়কর, রপ্তানি প্রণোদনার অর্থে হাত দেয়নি। আইএমএফের সাথে সংস্কার কাজগুলো আগামীতে চালিয়ে যেতে চাইলে সরকার সম্ভবত নির্বাচনের পরে এই খাতগুলোতে হাত দেবেন।
বাজেটে সরকার ধরে নিয়েছে যে আগামী বছর ডলার বিপরীতে টাকার মান বাড়বে। টাকা ও ডলারের বিনিময় হার ২০২৪ সালে ১০৪ টাকা ধরা হয়েছে। এ ধারণার সাথে বাস্তবতার সম্পর্ক নেই বলে মনে করেন সিপিডি। সরকার কিসের ভিত্তেতে ধরে নিয়েছে যে আগামী বছর টাকার মান বাড়বে? এমন প্রশ্ন তুলেছে গবেষণা সংস্থাটি।
ফাহমিদা খাতুন বলছিলেন, এই বছরের ৩১শে মে মে পর্যন্ত বিনিময় হার ছিল ১০৮ টাকা। ধারণা করা হচ্ছে যে এটা আরো অবনমন করবে। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রায় ধরা হচ্ছে টাকার মান বাড়বে। বাস্তবে সেটি দেখা যাচ্ছে না এখনো।
এছাড়া গত দেড় বছর যাত দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতিতে মানুষ অনেকটা দিশেহারা। হু হু করে বাড়ছে জিনিসপত্রের দাম। এমন প্রেক্ষাপটে বাজেটে মুল্যস্ফীতির টার্গেট ধরা হয়েছে ছয় শতাংশ। সিপিডির পর্যালোচনায় বলা হচ্ছে যে বাজেটে মূল্যস্ফীতি ‘ব্যাপকভাবে কমে যাবে’ বলে ধারণা করা হচ্ছে, যা আসলে বাস্তবে কতটা সম্ভব তা নিয়ে সংশয়ের অবকাশ রয়েছে।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, “২০২৩ সালে পুরোটা সময়ই মূল্যস্ফীতি চলতি অর্থবছরের বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার উপরে ছিল। এপ্রিলে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.২৪%, কিন্তু গণনার ক্ষেত্রে বেইজ ইয়ার পরিবর্তন করে ২০২১-২২ করার ফলে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৮.৬% এ। সেটাও কিন্তু গতবারের লক্ষ্যমাত্রার ওপরে।”
আগামী বছরে মূল্যস্ফীতির হার কীভাবে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনা হবে, সেই ব্যাখ্যা বাজেটে স্পষ্ট নয় বলে উঠে আসে পর্যালোচনায়। অর্থনীতিবিদ খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেমের মতে এবারের বাজেটের সবচেয়ে দুর্বল দিক ‘মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কার্যকর কোনো উদ্যোগ ঘোষণা করতে না পারা।’
বাজেটে মুদ্রাস্ফীতি ও মূল্যস্ফীতি সংক্রান্ত বিষয়গুলোকে মুদ্রানীতির মাধ্যমে দেখানো হলেও সরকার ‘মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে জনগণের প্রত্যাশা মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।
বাজেটে ‘মধ্যমেয়াদী সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা এবং বক্তব্যে অতিরিক্ত আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে বলে মনে করেন সিপিডির অর্থনীতিবিদ তৌফিক আহমেদ। তিনি বলেন, ধারণা করা হয়েছে যে সবকিছু ভালো থাকবে। বৈশ্বিক পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে, পণ্যের দাম কমে যাবে, দেশের ভেতরে পরিস্থিতি ভালো হয়ে যাবে, রপ্তানিতে নতুন বাজার হবে, রপ্তানি প্রবৃদ্ধি হবে – এরকম ধারণা করা হয়েছে।
তৌফিক আহমেদতুলে ধরেন যে বিদেশি সংস্থার কাছে মূল্য পরিশোধ, এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড, রিজার্ভে কী পরিমাণ অর্থ আছে, বেসরকারি খাতের ঋণের বিষয়ে কোনো উল্লেখ করেননি অর্থমন্ত্রী।
এছাড়া সাম্প্রতিক সময়ের মত বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়া হলেও মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাবে বলে উঠে আসে সিপিডির আলোচনায়। সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন বাজেট পর্যালোচনা পেশ করার সময় বলেন, “সামষ্টিক অর্থনীতির যে কাঠামোটা দেয়া হয়েছে, তার মধ্যে বর্তমান বাস্তবতার প্রতিফলন আমরা দেখতে পাচ্ছি না।”
বাজেটে বিভিন্ন খাতে আগামী অর্থ বছরের জন্য বিভিন্ন ধরণের চলকের যে প্রক্ষেপণ করা হয়েছে, সেগুলোকে উচ্চাকাঙ্খী মন্তব্য করছেন সিপিডি’র অর্থনীতিবিদরা।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, বহির্খাতের যেসব লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে – রপ্তানি প্রবৃদ্ধি, আমদানি প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ – সব ক্ষেত্রেই ২০২৩ অর্থবছরে যেমন পারফরমেন্স দেখা গেছে, তার চেয়ে বেশি প্রক্ষেপণ করা হয়েছে।
মূল্যস্ফীতি, টাকা-ডলারের বিনিময় হার, ব্যক্তিখাতে বিনিয়োগ, সরকারি ঋণ সহ বেশ কয়েকটি ক্ষেত্রে এই অতিরিক্ত প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছে বলে উঠে এসেছে সংস্থাটির পর্যালোচনায়। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ গত বাজেটের তুলনায় কমে যাওয়ায় স্বাস্থ্য সেবা নেয়ার ক্ষেত্রে মানুষের খরচ বাড়বে বলে উঠে আসে পর্যালোচনায়।
ফাহমিদা খাতুন বলেন জিডিপি ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দের অনুপাতের হিসেবে বিশ্বের ৪৪টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। বাংলাদেশের নিচে রয়েছে সোমালিয়া, সাউথ সুদান আর এরিত্রেয়ার মত আফ্রিকার দেশগুলো।
শিক্ষা খাতেও জিডিপির অনুপাতে বরাদ্দের হিসেবে অনুন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান নিচের দিকে। আর কৃষি খাতে বরাদ্দ কমার ফলে খাদ্য নিরাপত্তায় ঝুঁকি তৈরি হওয়ার সম্ভবান রয়েছে বলে উঠে আসে সিপিডি’র পর্যালোচনায়।
এসডব্লিউ/এসএস/১৬২০
আপনার মতামত জানানঃ