যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর গত বুধবার বাংলাদেশের নাগরিকদের ভিসার ব্যাপারে যে ‘নতুন ভিসা নীতি’ ঘোষণা করেছে, তার লক্ষ্য বিষয়ে কোনো রাখঢাক করা হয়নি, এর লক্ষ্য হচ্ছে বাংলাদেশে একটি সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য এবং অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য সরকারের ওপর চাপ প্রয়োগ করা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেনের বিবৃতিতে বলা হয়েছে যে ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে’ এই নতুন নীতি ঘোষণা করা হয়েছে এবং এর লক্ষ্য হচ্ছে ‘যারা বাংলাদেশে গণতন্ত্রকে এগিয়ে নিতে চায়, তাদের সবাইকে সমর্থন’ দেওয়া।
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে যদি সরকারের দাবি অনুযায়ী দেশে ইতিমধ্যে সুষ্ঠু নির্বাচনব্যবস্থা চালু এবং অনুকূল পরিস্থিতি বজায় থাকত, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র এই ধরনের নতুন নীতি ঘোষণা করার প্রয়োজন বোধ করত না, এ নিয়ে আলোচনারও দরকার হতো না।
বর্তমান সরকার যে নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ক্ষমতায় আছে, তা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি প্রমাণ করে। তবে কোনো দেশ এসে উদ্ধার করবে না। জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ গঠন করতে হবে। গতকাল শুক্রবার রাজধানীতে ‘রাজনৈতিক সংকট ও রাষ্ট্রের গতিপথ’ শিরোনামে এক আলোচনা সভায় বক্তারা এসব কথা বলেছেন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রথম নির্বাহী সমন্বয়কারী আবদুস সালামের ষষ্ঠ মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে দুপুরে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবে এই আলোচনা সভা হয়।
সেখানে বক্তব্যে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি প্রমাণ করেছে, আপনার (সরকারপ্রধান) যে গণতন্ত্রের কথা, ভোটের কথা প্রচার করছেন, তা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় গ্রহণ করেনি। আপনি যেটা জবরদস্তি করে, ভোট ডাকাতি করে, গোটা নির্বাচনব্যবস্থাকে ধ্বংস করে ক্ষমতায় আছেন, ভিসা নীতি তা প্রমাণ করেছে।’
নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার এক রাতের মধ্যে হম্বিতম্বি বন্ধ হয়ে গেছে মন্তব্য করে সাইফুল হক বলেন, এখন মার্কিনরা দিয়েছে, তারপর হয়তো ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড একই ধরনের ব্যবস্থার দিকে যাবে। পুরো শাসকশ্রেণির মধ্যে একটা আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। দখলদারি থাকবে, নাকি গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা প্রতিষ্ঠিত হবে, সে জন্য আগামী কয়েক মাস দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় বলেও মনে করেন তিনি।
যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ভিসা নীতি ঘোষণার পর দেশে একটা হুলুস্থুল লেগে গেছে বলে মন্তব্য করেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান (মান্না)। এই ভিসা নীতি ঘোষণার পর গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় মার্কিন রাষ্ট্রদূতের বাসায় গিয়ে রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের সঙ্গে বৈঠক করেন আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টির নেতারা।
ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টির নেতাদের সঙ্গে যাওয়ায় বিএনপির সমালোচনা করেন মাহমুদুর রহমান। তিনি বলেন, ‘এটা তো ঠিক, মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডাকলে আমরা যাব না কেন? কিন্তু কারণই নাই, অ্যাজেন্ডাই নাই ডাকছেন এবং এমন তিন-চারজন মিলে যাচ্ছেন—এগুলো কী? যারা রাজপথে মিলে না, কথায় মিলে না, লড়াইয়ে একজন আরেকজনের দিকে চোখে চোখ রেখে দরকারে গুলি করছে, তারা মিলে যায় কী করে?’
সরকার দেশের স্বার্থ নয়, গদি রক্ষার জন্য পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করছে বলে মন্তব্য করেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, দেশে নির্বাচন ঠিকমতো হয় না। বিষয়টি বর্তমান সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনের মধ্য দিয়ে। এ কারণে দেশের নাগরিকেরা ভিসা বিধিনিষেধের মুখোমুখি হবে, এ রকম একটি সিদ্ধান্ত যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসছে।
আওয়ামী লীগ নিজেদের স্বার্থে এই পরিস্থিতি তৈরি করেছে এবং তা থেকে বের হওয়ার ন্যূনতম তাগিদ অনুভব করছে না বলে মন্তব্য করেন জোনায়েদ সাকি। তিনি বলেন, জনগণের সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ভবিষ্যৎ গঠন করতে হবে। কোনো দেশ এসে উদ্ধার করে দিয়ে যাবে না।
বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বলেন, সরকারের সময় ঘনিয়ে আসছে। এখন দরকার হচ্ছে মাঠে ঐক্য। দেনদরবার করে ক্ষমতা পরিবর্তন করে লাভ হবে না। রাজপথে ফয়সালা করতে হবে।
রাজপথের রাজনৈতিক মিত্রদের সঙ্গে পরামর্শ না করে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে বিএনপি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠক করায় সমালোচনা করেন ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক রফিকুল ইসলামও। তিনি বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে বাঁশি হুইসেল দিয়েছে। দেখা গেল, তিনটি দল একত্র হয়ে গেলেন। কিন্তু আমরা যাঁদের সঙ্গে মাঠে লড়াই করছি, আমাদের একবার জিজ্ঞেস করার সময় তাঁরা পাননি। এত ব্যস্ত হয়ে গেল, কখন হুজুরের সামনে হাজিরা দেওয়া যাবে।’
বিএনপির সঙ্গে যুগপৎভাবে সরকারবিরোধী আন্দোলনে রয়েছে গণতন্ত্র মঞ্চ। এই মঞ্চে নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদসহ ছয়টি দল সক্রিয়। বিএনপি নেতাদের সমালোচনা করে রফিকুল ইসলাম আরও বলেন, ‘পিটার হাস (মার্কিন রাষ্ট্রদূত) কি ক্ষমতায় বসাবেন বিএনপিকে? ক্ষমতায় বসাবে এ দেশের জনগণ। তাই জনগণের কাছে যেতে হবে।’
এ সময় আরও বক্তব্য দেন জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সম্পাদক ফয়জুল হাকিম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, গণফোরামের (মন্টু, সাইয়িদ ও সুব্রত) সাধারণ সম্পাদক সুব্রত চৌধুরী ও গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান।
আপনার মতামত জানানঃ