রাষ্ট্র ও সমাজে গণতন্ত্র কখনই দ্রুত কোনো পরিবর্তন আনতে পারে না। বিশেষ করে সমাজে ও রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গ ও তার কালচারে যে গতিতে গণতন্ত্রায়ন ঘটে, তার গতি অনেকটা সমাজ বিবর্তনের গতির সমান। যেসব রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক সরকার থাকা সত্ত্বেও তার কাছ থেকে পূর্ণ গণতান্ত্রিক আচরণ পাওয়া যায় না, তার সঠিক পর্যালোচনার জন্যে সব সময়ই দরকার হয় ওই রাষ্ট্রের ইতিহাসের গতিবিধি।
প্রতিবেশী মিয়ানমারের কাছ থেকে গত তিন বছর যাবৎ সব ধরনের আশা করার পরে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক আচরণ পাচ্ছে না। এমনকি গোটা বিশ্ব পাচ্ছে না গণতান্ত্রিক আচরণ মিয়ানমারের কাছ থেকে। বিশেষ করে সবার চিন্তা ও আকাঙ্ক্ষার সঙ্গে মিলছে না তাদের নেতা সু চির আচরণ। সু চির আচরণের সঙ্গে এই না মেলার প্রথম কারণ সু চির প্রতি আকাঙ্ক্ষার স্তর ছিল বাংলাদেশসহ গোটা পৃথিবীর অনেক বেশি।
যেমন ব্যবসায়ী থেকে পরিবর্তিত হয়ে গণতান্ত্রিক নেতা থাইল্যান্ডের থাকসিন সিনাওয়াত্রার কাছ থেকে বা তার বোন ইয়াং লাকের কাছ থেকে গণতান্ত্রিক বিশ্ব যে গণতন্ত্র আশা করে, তার থেকে অনেক বেশি আশা করেছিল সু চির কাছ থেকে। এর পেছনে যুক্তি ছিল সু চির দীর্ঘ গণতান্ত্রিক সংগ্রামের ঐতিহ্য।
পৃথিবীর ইতিহাসে দেখা যায়, গণতান্ত্রিক সংগ্রাম করা, স্বাধীনতার সংগ্রাম করার কাজটি যত দ্রুত করা যায়, বা যে গতিতে করা যায়, রাষ্ট্র ও সমাজের সংস্কৃতিতে গণতন্ত্র ওই গতিতে আনা যায় না। কারণ আন্দোলন ও সংগ্রাম একটা যুদ্ধের মতো। যুদ্ধ যেমন দক্ষ সেনাপতি ও তার বাহিনীর ওপর নির্ভর করে, আন্দোলন ও সংগ্রাম অনেকখানি তেমনি।
কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি ও সার্বিক আচরণ আনার কাজটি সমগ্র সমাজের মানুষের সংস্কৃতির ভেতর দিয়ে ও রাষ্ট্রের দীর্ঘ অভ্যাস পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে হয়। মিয়ানমারের নেতা সু চির কাছ থেকে গণতান্ত্রিক আচরণ না পাবার পেছনে তাই মিয়ানমারের রাষ্ট্রগতির ইতিহাস বেশি কাজ করছে।
মিয়ানমারে ২০১৫ সালে গণতান্ত্রিক সরকার আসার আগের একটু সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে গেলে দেখা যায়, এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাটুকু আসার আগে ৫৪ বছর সেখানে সামরিক শাসন ছিল। তার আগে এক ঝলক একটা সংগ্রামী সরকার এক বছরের মাত্র কিছু বেশি সময়ের জন্যে। এর আগে ১২১ বছর ব্রিটিশ শাসন।
অর্থাৎ একশ একুশ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন ও চুয়ান্ন বছরের সামরিক শাসনের পর সেখানে গণতান্ত্রিক সরকার হয়েছে। এই ঔপনিবেশিক শাসনের সময়ের মিয়ানমারের (বার্মা) সমাজ ও শাসন কেমন ছিল তার একটি চরম প্রকাশ ঘটেছে জর্জ অরওয়েলের এক লেখায়। তিনি যখন পুলিশ অফিসার হিসেবে বার্মায় আসছেন, সে সময়ে তার দাদী বলছেন, তার দাদা যখন বার্মায় পুলিশ অফিসার ছিলেন, সে সময়ের সেই সুখের দিনগুলো তার এখনও মনে পড়ে। বিশ থেকে ত্রিশ জন খালি পায়ের দাস দাসী সব সময়ই তার সামনে হাত জোড় করে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকত।
ব্রিটিশ শাসকেরা তাদের সমাজের মাথা এভাবে নিচু করে দিয়েছিল বলেই স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশকে উৎখাত করার পরেও সে দেশে ৫৪ বছর সামরিক শাসন চালাতে পারল সামরিক সরকারগুলো। এমনকি শেষ অবধি সামরিক শাসনের অবসান হলো অনেকটা সামরিক শাসকদের এবং সামরিক আমলাদের ইচ্ছে মতো, পার্লামেন্ট থেকে রাষ্ট্রের সবখানে তাদের আধিপত্য রেখে। এটা কখনই গণতন্ত্রের কোনো সংজ্ঞার সঙ্গে যায় না।
অথচ সেটাই মেনে নিতে হয়েছে মিয়ানমারের গণতান্ত্রিক সরকারকে। আর তার ভেতর দিয়ে সেখানে ধীর গতিতে গণতান্ত্রিক বির্বতন ঘটছে। সেখানে গত পাঁচ বছরে পার্লামেন্টে বিল এসেছে ১৬৮টি। আইনে পরিণত হয়েছে ১৪২টি।
এখান থেকে দুটি বিষয় লক্ষ্য করা যায়: এক. সবগুলো বিলকে তারা আইনে পরিণত করতে পারেনি। আবার গণতন্ত্রের পথের যাত্রায় পাঁচ বছরে ১৪২টি আইন করতে হয়েছে। পার্লামেন্টের পাশাপাশি রাষ্ট্রেরও পরিবর্তনের গতি কি? গণতন্ত্র আসার পরে সেখানে নৃগোষ্ঠীগত সংঘাতের বলি বেশি হলো রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গা নৃগোষ্ঠী।
তা যেমন সামরিক বাহিনী করল, তেমনি তাকে সমর্থন করে যাচ্ছেন এক সময়ের পৃথিবীর গণতন্ত্রের কন্যা সু চি। অর্থাৎ ঔপনিবেশিক ও সামরিক শাসনের সেই নির্মমতা ও অগণতান্ত্রিক আচরণের থেকে বড় কোনো দাগে সরে আসতে পারেনি মিয়ানমার সরকার। গণতন্ত্রের স্বপক্ষে তারা পার্লামেন্টে যে আইনগুলো করছে, সেগুলোরও সঠিক প্রয়োগ করতে পারছে না।
মিয়ানমারে ১২১ বছর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন ছিল। আমাদের আজকের এই বাংলাদেশে ছিল ১৯৭ বছর। ব্রিটিশদের এই দীর্ঘ ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান হয়েছিল স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ঠিকই, কিন্তু তখনকার পরিণতিগুলো কী কী ছিল? স্বাধীনতা সংগ্রামের শেষ পর্যায়ে এই দেশের মানুষ ও সমাজ ভাগ হয়ে গিয়েছিল ধর্মের নামে। এর ফলে স্বাধীনতাটি তখন জাতির নামে আসেনি।
এসেছিল ধর্মের নামে এবং সেই ধর্মের নামে স্বাধীনতা আসার আগে ঘটেছিল ধর্মের নামে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, যাতে মারা গিয়েছিল লাখ লাখ মানুষ। আর স্বাধীনতা আসার পরে এই ভূখণ্ডে যেমন ভারত থেকে কয়েক লাখ উদ্বাস্তু আসে, তেমনি এই ভূখণ্ড থেকে উদ্বাস্তু হয়ে ভারতে চলে যেতে হয়েছিল এক কোটিরও বেশি মানুষকে। এখানেই শেষ নয়। স্বাধীনতা এনেছিল যে মুসলিম লীগ, স্বাধীনতার পরে তারা ক্ষমতায় এসে কী করেছিল? তারা ঠিকই ব্রিটিশের মতো মানুষের সব দাবি বন্দুকের গুলির মুখে স্তব্দ করতে চেয়েছিল।
অন্যদিকে রাষ্ট্র ও সমাজে যে ঔপনিবেশিক ধারা বজায় ছিল, তার প্রমাণ গণতন্ত্র কখনই সেদিনের পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটিতে দাঁড়াতে পারেনি। বরং সিভিল ও সামরিক আমলারাই সেখানে প্রধান ছিলেন। আর দশ বছর না যেতেই আসে পূর্ণ সামরিক শাসন। তারপরে আবার স্বাধীনতা সংগ্রাম। আর সে সংগ্রামে বিজয়ী হবার মাত্র সাড়ে তিন বছর পরেই আবার সামরিক শাসন। সেই সামরিক শাসনের বিরুদ্ধেও মানুষ লড়েছে ঠিকই। সে সামরিক শাসন অবসানের পরে গণতান্ত্রিক সরকার এসেছে ঠিকই, কিন্তু রাষ্ট্র ও সমাজে গণতান্ত্রায়ন হয়েছে কতটুকু? ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলের সেই বেসামরিক ও সামরিক আমলা কাঠামো ও তাদের নিয়ন্ত্রণই রয়ে গেছে সমাজে ও রাষ্ট্রে। জনপ্রতিনিধিদের কাঠামোগত আধিপত্য যেমন কম রাষ্ট্র ও সমাজে, তেমনি তাদের মানসিক আধিপত্য আরো কম।
অন্যদিকে গণতন্ত্র একটি রাষ্ট্র ও সমাজকে আধুনিক করে। আধুনিকতার পথে নিয়ে যায়। তার পরিবর্তে সমাজে অন্ধত্ব বাড়ছে। এক ধরনের ধর্মান্ধতা আজ রাষ্ট্রদ্রোহী কাজ করছে। অথচ রাষ্ট্র তাদেরকে আইনে আনার সক্ষমতা দেখাচ্ছে না। বরং চেম্বারলেনের নীতি নিয়ে তাদের সঙ্গে সমঝোতার ভেতরই সাফল্য দেখছে।
ব্রিটিশের এই ১৯৭ বছরের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে বের হওয়া ভূখণ্ডের বাকি দুটি অংশের একটি পাকিস্তান ও একটি ভারত। পাকিস্তানেও নির্বাচিত সরকার। তবে সে নির্বাচন হয়েছে সম্পূর্ণ সামরিক বাহিনীর ও সামরিক আমলাতন্ত্রের নিয়ন্ত্রণে। সেখানে নির্বাচিত সরকার চলে সামরিক গোয়েন্দা বাহিনীর নির্দেশে।
একটি গণতান্ত্রিক সরকার ও সামরিক আমলাতন্ত্রের এই আধিপত্য কখনই এক সঙ্গে যায় না। তাছাড়া সেখানে ধর্মান্ধতা বাড়তে বাড়তে এই পর্যায়ে গিয়েছে যে, আজ পৃথিবীর যেখানেই একটি জঙ্গি হামলা হোক না কেন, দেখা যায় সেখানে এক জন হলেও পাকিস্তানি জঙ্গি আছে। স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে সেখানে গণতন্ত্রের এই হাল।
এছাড়া ব্রিটিশ ঔপনিবেশের সব থেকে বড় অংশ ভারত। তারা দারিদ্র্য ও অশিক্ষা নিয়ে গণতন্ত্রের এক ধরনের চর্চা করার চেষ্টা করেছিল দীর্ঘ দিন। কিন্তু মিয়ানমারে যেমন ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীতে বিভক্ত সমাজ, তাদের সমাজও জাতপাতে বিভক্ত। এই জাতপাতে বিভক্ত সমাজে তাই গণতন্ত্রের বদলে ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠেছে ধর্ম। তার ফলে সেখানে আজ গণতন্ত্রের মাথার ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে ধর্ম। বাংলাদেশের মতো সেখানেও ধর্মান্ধতার জোশ একই রকম।
তবে তারপরেও এ সব দেশগুলোকে গণতন্ত্রের চর্চাই করে যেতে হবে। আর যারা রাষ্ট্রনায়ক থাকবেন, তাদের মাথায় রাখতে হবে গণতন্ত্রের বিবর্তনের গতি অনেক ধীর। অবশ্য এটাই শুধু মাথায় রাখলে চলবে না। মিয়ানমারের সরকারকে অবশ্যই স্বীকার করতে হবে, ধর্ম বা গোত্রের নামে তাদের সামরিক বাহিনী যে নরহত্যা ও মানুষকে উদ্বাস্তু করেছে, এটা গণতন্ত্রের বিপরীত কাজ। এর সংশোধন করতে হবে।
বাংলাদেশের সরকারকেও মনে রাখতে হবে ধর্মান্ধতার সঙ্গে আপস করে সমাজকে গণতান্ত্রিক পথে নিয়ে যাওয়া যায় না। আধুনিকতার পথ এটা নয়। পাকিস্তান কি ভাবতে পারবে জঙ্গি উৎপাদন আর গণতন্ত্র এক সঙ্গে চলতে পারে না? ভারতকে গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হতে হলে তাদের সরকাকে মনে রাখতে হবে, রাষ্ট্র ধর্মকে উসকে দিলে সেখানে গণতন্ত্র মারা যাবে।
জীব জগতের বিবর্তনের দীর্ঘ ইতিহাসে মাঝে মাঝে এমন সব ভয়ংকর প্রাণী জীবজগতে এসেছে। গণতন্ত্রের ধীর গতির বিবর্তনেও কি তাই মানুষকে এই নরহত্যা অন্ধত্ব এগুলো নিয়েই চলতে হবে? গণতন্ত্র কি পারে না সঠিক পথে ধীর গতিতে হলেও এগিয়ে যেতে?
এসডব্লিউএসএস/১৬০০
আপনার মতামত জানানঃ