কুড়ি লাখ বছর বা তার চেয়েও বেশি আগে আদিম মানুষ গুহায় বাস করতো৷ কিন্তু তাদের খাবার দাবার কেমন ছিল? সেই কথা জানতেই একদল বিজ্ঞানী গবেষণা শুরু করেছেন সম্প্রতি৷
২৫ লাখ বছর আগে থেকে প্রায় ১২ হাজার বছর আগে পর্যন্ত, অর্থাৎ প্রস্তরযুগে, আমাদের পূর্বপুরুষদের খাবারের অভ্যাস নিয়ে অনেক ধরনের ধারণা প্রচলিত আছে৷ এ পর্যন্ত মূলত ভাবা হতো যে, সেই সময় আমাদের পূর্বপুরুষরা সব্জি, ফলমুল, বাদাম, নানা রকম শেকড়বাকর এবং মাংস খেয়ে বেঁচে থাকতেন৷
প্রায় ১০ হাজার বছর আগে ছিল কৃষিকাজের একেবারে প্রাথমিক যুগ৷ সেই সময় কিন্তু আলু, রুটি বা দুধ – মানে যেগুলোকে আমরা প্রধান খাবার বলে মনে করি, এই ধরনের খাবার-দাবারের প্রচলন ছিল না৷
ইউনিলিভারের গবেষণার দায়িত্বে রয়েছেন ড. মার্ক বেরী৷ তিনি বলেন, সেই সময় অর্থাৎ প্রস্তরযুগের খাদ্য অভ্যাস থেকে উদ্দিপনা নিয়েই বর্তমান যুগের মানুষের জন্যে একটি স্বাস্থ্যকর খাবার সৃষ্টি করাই, এই গবেষণার লক্ষ্য৷ ড.বেরী বলেন, প্রস্তরযুগের খাদ্যাভ্যাসের মেন্যুতে উল্লেখযোগ্য খাবার ছিল প্রচুর পরিমাণে লতা-গুল্ম বা শাক-সব্জি৷ আমরা চেষ্টা করি দিনে অন্তত পাঁচ ভাগ ফল এবং সব্জি খেতে, কিন্তু প্রস্তরযুগের আদিম মানুষরা খেতেন, দিনে ২০ থেকে ২৫ ভাগ নিরামিষ খাবার৷
তাহলে প্রচলিত ধারণা অনুয়ায়ী, প্রস্তরযুগের মানুষ মাংসাশী ছিলেন না৷ তাঁরা সর্বভুক ছিলেন৷ খেতেন সবকিছু, ভালোবাসতেন সবুজ৷
হ্যাঁ, এটাই সত্য। আমাদের আদি পূর্বপুরুষরা বহুকাল নিয়মিত মাংস খেতেন না৷ বড়জোর কুড়িয়ে পাওয়া মাংস খাওয়ার প্রবণতা ছিল৷ প্রায় ২০ লক্ষ বছর আগে শিকার ও মাংস কাটার সরঞ্জাম মানুষের হাতে আসায় পরিস্থিতি বদলে গেল৷
তার পরেও বহুকাল ধরে মানুষ অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ মাংস খেত৷ তৃতীয় খ্রিষ্টাব্দের সময়ে মানুষ সারা বছরে মাথাপিছু ২০ থেকে ৩০ কিলোগ্রাম মাংস খেত বলে জানা গেছে৷
ধীরে ধীরে মানুষ এমন এক পশু খুঁজে পেল, যার শরীরে অনেক মাংস রয়েছে৷ শূকর পালন করাও অনেক সহজ, তাদের উচ্ছিষ্ট খাবার খাওয়ালেই চলে৷ শূকর কার্যত নিজেরাই নিজেদের খাদ্য সংগ্রহ করে৷ প্রয়োজনে তাদের ধরে জবাই করলেই হলো৷ ফলে মধ্যযুগের সূচনার সময় পর্যন্ত মাংসের চাহিদা প্রায় ৫ গুণ বেড়ে গেল৷
প্রথম খ্রিষ্টাব্দের শেষের দিকে পৃথিবীর জনসংখ্যাও দ্রুত বাড়তে শুরু করে৷ খাদ্যের চাহিদা মেটাতে কৃষিকাজের প্রসার ঘটে৷ মধ্যযুগের তুঙ্গে, অর্থাৎ একাদশ শতাব্দীতে মানুষ বছরে মাথাপিছু ৪০ কিলোগ্রাম মাংস খেতো৷
তারপর প্লেগ এসে গোটা মহাদেশের জনসংখ্যা এক ধাক্কায় কমিয়ে দিলো৷ সে যাত্রায় প্রায় এক-তৃতীয়াংশ মানুষের মৃত্যু ঘটেছিল৷ তার জের ধরে গবাদি পশু প্রজননের প্রবণতা এবং খাদ্য হিসেবে মাংসের প্রচলন বাড়তে লাগলো৷
তারপর পঞ্চদশ শতাব্দীতে আধুনিক যুগের সূচনায় জার্মানির মানুষ বছরে মাথাপিছু ১১০ কিলোগ্রাম মাংস খেতে শুরু করে৷ খাদ্য নিরাপত্তার ফলে জনসংখ্যাও দ্রুত বাড়তে থাকে৷ মাত্র তিনশো বছরের মধ্যে জনসংখ্যা প্রায় তিন গুণ বেড়ে যায়৷
তারপর মাংস খাবার প্রবণতা আবার কমে যায়৷ স্বল্প পর্যায়ের তুষার যুগে এমনকি গ্রীষ্মকালেও শস্য জমাট রাখা সম্ভব হওয়ার ফলেও এমনটা দেখা গিয়েছিল৷
ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনায় বছরে মাথাপিছু ১৪ কিলোগ্রামের বেশি মাংস খাওয়া সম্ভব ছিল না৷ তখন পশুর গোটা দেহ কাজে লাগানো হতো৷ জবাইয়ের পর যা খাওয়া সম্ভব হতো না, তা শুকিয়ে অথবা স্মোক করে রাখা হতো৷
তারপর শিল্পায়ন ও কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়োগ শুরু হলো৷ রেফ্রিজারেশন ব্যবস্থার কল্যাণে বিদেশ থেকে মাংস আমদানি করে মজুত রাখাও সম্ভব হলো৷
দুই বিশ্বযুদ্ধের সময়কাল বাদ দিলে সার্বিকভাবে মাংস খাওয়ার প্রবণতা আবার বাড়তে শুরু করে৷ জার্মানির অর্থনৈতিক বিস্ময়ের যুগে মাথাপিছু মাংসের পরিমাণ প্রায় ৫০ কিলোগ্রাম ছুঁয়েছিল৷
পশুখামারেও স্বয়ংক্রিয় ব্যবস্থা চালু হলো সেইসঙ্গে তার জের ধরে ফ্যাক্টরি ফার্মিং৷ ফলে বেশ সস্তায় বিশাল পরিমাণ মাংস কেনা সম্ভব হলো৷
গত শতাব্দীর সত্তরের দশকে জার্মানিতে কারি সসেজ ও হ্যামবার্গার খুব জনপ্রিয় হয়ে পড়ে৷ অন্যদিকে পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতেও আন্দোলন শুরু হয়৷ প্রতিবাদী মানুষ বিকল্প ধারার জীবনযাত্রা ও খাদ্যগ্রহণের প্রতি আকৃষ্ট হয়৷ তবে মাংস খাবার প্রবণতার উপর তার প্রভাব পড়ে নি৷ এমনকি রোগের প্রসার ও মাংস নিয়ে অসংখ্য কেলেঙ্কারি সত্ত্বেও জার্মানির মানুষ মাংস খাওয়া ছাড়েন নি৷ আজকের পরিস্থিতি কী?
জার্মানিতে প্রায় ৫০ লক্ষ মানুষ অত্যন্ত কম অথবা আদো মাংস খান না৷ জনসংখ্যার প্রায় ১ শতাংশ কট্টর নিরামিষাশী৷ তা সত্ত্বেও বহু বছর ধরে জার্মানিতে বছরে মাথাপিছু ৬০ কিলোগ্রাম মাংস খাবার প্রবণতা চলে আসছে৷
এসডব্লিউ/এসএস/১৮২০
আপনার মতামত জানানঃ