লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। ইতালিয় রেনেসাঁর অন্যতম পুরোধা তিনি। চিত্রশিল্প, ভাস্কর্য, প্রযুক্তিবিদ্যা থেকে শুরু করে বিজ্ঞান, গণিত— প্রতিটি বিষয়েই ছাপ রেখে গেছেন ভিঞ্চি। তবে ভিঞ্চির ব্যক্তিগত জীবন, তাঁর শিল্পকর্ম, তাঁর নকশা করা যুদ্ধাস্ত্র যেমন রহস্যময় ছিল, তেমনই রহস্যময় তাঁর জন্মবৃত্তান্তও। লিওনার্দোর বাবা পিয়েরো ছিলেন ফ্লোরেন্সের কিংবদন্তি মেদিচি পরিবারের আইনি নোটারি। আর মা?
লিওনার্দোকে নিয়ে সম্প্রতি ৬০০ বছরেরও পুরনো নথিপত্র উদ্ধার হয়েছে। ইতালিরই এক ইতিহাসবিদ সেই সবের আবিষ্কার করেছেন। সেই সব নথিপত্র অনুযায়ী, আসলে ককেশাস পার্বত্য অঞ্চলের তদানীন্তন সার্কেসিয়ার বাসিন্দা ছিলেন লিওনার্দোর মা ক্যাটেরিনা।
ভিঞ্চির মা, ক্যাটেরিনার পরিচয় সম্পর্কে এতদিন সুস্পষ্ট কোনো ধারণা ছিল না গবেষকদের। বরং, তাঁর মাতৃপরিচয় ঘিরে ভেসে রয়েছে একাধিক তত্ত্ব। এতদিন পর্যন্ত যে তত্ত্বটিকে সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য হিসাবে ধরে নেওয়া হত, তা হল, ক্যাটেরিনা ছিলেন ফ্লোরেন্সের একজন দরিদ্র কৃষক। সমাজের নিচুতলার মানুষ। লিওনার্দোর বাবা পিয়েরোর সঙ্গে বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্কে জন্ম তাঁর। তবে এই ধারণা খানিকটা হলেও বদলাল এবার। প্রকাশ্যে এল আরও ভিন্ন এক চাঞ্চল্যকর তথ্য। কৃষক নয়, বরং কালজয়ী শিল্পীর মা ছিলেন নাকি ক্রীতদাসী।
হ্যাঁ, বহুযুগ ধরেই এমনটা বিশ্বাস করে এসেছেন একদল গবেষক। তবে সে-ব্যাপারে স্পষ্ট কোনো প্রমাণ মেলেনি এতদিন। এবার সেই রহস্যের জট খুলে দিল ফ্লোরেন্সের স্টেট আর্কাইভে সংরক্ষিত একটি বিশেষ নথি। গত মাসে খুঁজে পাওয়া আইনি নথিটির লেখক আর কেউ নন, মেদিচি পরিবারের নোটারি তথা লিওনার্দোর বাবা পিয়েরো। সেখানে স্পষ্ট উল্লেখিত রয়েছে, ১৪৫২ সালের নভেম্বর মাসে ফ্লোরেন্সের এক অভিজাত পুরুষের কাছ থেকে ক্যাটেরিনাকে কিনে নেন তিনি। মুক্ত করেন দাসত্ব থেকে।
অথচ এর ছ’মাস আগেই জন্ম লিওনার্দোর। ফলে, হিসেবের গণ্ডগোল রয়েই যায়। এক্ষেত্রে পিয়েরোই যে লিওনার্দোর বাবা, তা প্রমাণ হয় কীভাবে? এই নথির তথ্য যদি সত্যি হয়ে থাকে তবে লিওনার্দোর বাবা হওয়ার কথা ফ্লোরেন্সের সেই অভিজাত ব্যক্তিরই।
এই রহস্যের জট ছাড়াতে এগিয়ে আসেন ভিঞ্চি গবেষক মার্টিন কেম্প। ২০১৬ সালে ভিন্ন একটি পারিবারিক নথি খুঁজে পেয়েছিলেন তিনি। লিওনার্দোর ঠাকুরদা অ্যান্তোনিও দা ভিঞ্চির বার্ষিক কর প্রদানের নথি এটি। সেখানে অ্যান্তোনিও স্বীকার করেছেন, লিওনার্দো তাঁর সন্তান পিয়েরো এবং ক্যাটেরিনার অবৈধ সন্তান। তাঁকে পারিবারিক সদস্যের স্বীকৃতি দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠাবোধ করেননি অ্যান্তোনিও। বরং, পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরসূরি হবেন লিওনার্দো, এ-কথা উল্লেখ করেছিলেন তিনি।
এই নথি যে নির্ভুল, তা নিয়ে সন্দেহ নেই কোনো। তার কারণ, একাধিক সারকামস্ট্যান্সিয়াল এভিডেন্স। লিওনার্দোর কৈশোর কেটেছে তাঁর ঠাকুরদার পরিচর্যাতেই। বাবা থাকতেন আলাদা। এমনকি লিওনার্দো অবৈধ সন্তান হওয়ার কারণেই কৈশোরে তাঁকে আইনের পাঠ দেওয়া হয়নি। বরং তাঁকে শিল্পশিক্ষার জন্য পাঠানো হয়েছিল সে-যুগের কিংবদন্তি স্বর্ণকার ও শিল্পী ভেরচ্চিও-র কাছে। অথচ, নোটারির সন্তান নোটারি হবে— ফ্লোরেন্সের নিয়ম ছিল এমনটাই।
সাম্প্রতিক নথি প্রকাশ্যে আসার পর নতুন করে প্রতিষ্ঠা পেল কেম্পের এই তত্ত্ব। পাশাপাশি নতুন নথি থেকে ধারণা করা হচ্ছে, ক্যাটেরিনা ছিলেন ককেসাস পর্বতে বসবাসকারী সিরকাসিয়ান জনগোষ্ঠীর মহিলা। তাঁকে অপহরণ করে নিয়ে আসা হয়েছিল ফ্লোরেন্সে। তারপর হাতবদল হয়েছিল তাঁর। তবে ফ্লোরেন্সের ওই অভিজাত ব্যক্তির মালিকানায় থাকলেও তাঁর সঙ্গে যৌনসম্পর্ক গড়ে ওঠে পিয়েরোর। জন্ম নেয় লিওনার্দো। পরবর্তীতে সদ্যোজাত সন্তানের জন্য ক্যাটেরিনাকে কিনে নিয়েছিলেন তিনি। মুক্তি দিয়েছিলেন দাসত্ব থেকে। এমনটাই ধারণা গবেষকদের।
মজার বিষয় হল, যে-দিন ইউরোপে সাড়া ফেলে দেয় পিয়েরো দা ভিঞ্চির লেখা এই রহস্যময় নথির আবিষ্কার, সেদিনই প্রকাশ পায় আরেক লিওনার্দো-গবেষক ও ইতালিয় সাহিত্যের অধ্যাপক কার্লো ভেচের লেখা একটি উপন্যাস— ‘ইল সোরিসো ডি ক্যাটেরিনা : লা মাদ্রে দি লিওনার্দো’। বাংলায় যার অর্থ করলে দাঁড়ায়, ‘ক্যাটেরিনার হাসি : লিওনার্দো দা ভিঞ্চির মা’। আপাদমস্তক ফিকশন হলেও, ক্যাটেরিনা যে ক্রীতদাসী ছিলেন— সেই তত্ত্বের ওপর ভিত্তি করেই এই উপন্যাস রচনা করেছেন ভেচে। এও এক অদ্ভুত সমাপতনই বটে।
তবে ভেচের বিশ্বাস, সাম্প্রতিক আবিষ্কার লিওনার্দোর কর্মজীবনের গবেষণায় প্রভাব ফেলবে না তেমন। তবে ইতিহাসের হারিয়ে যাওয়া একাধিক অধ্যায়ের রহস্য খুঁজে দিতে পারে এই নথি। সে-যুগে শুধু কৃষ্ণাঙ্গই নয়, বরং দাসত্বের শিকার হতে হত ককেসিয়ানদেরও— তারও অন্যতম প্রমাণ হল ক্যাটেরিনার গল্প। তবে আশ্চর্যের বিষয় হল, ক্যাটেরিনার সঙ্গে সংসার না করলেও, তাঁর প্রতি পিয়েরো দা ভিঞ্চির ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা ছিল ষোলো আনা। এমনটাই মতামত গবেষকদের। তার কারণ, লিওনার্দোর জন্মের পর নতুন করে বিবাহ করার সুযোগ থাকলেও, আজীবন আর বিয়ে করেননি পিয়েরো। পাশাপাশি দাসত্ব থেকে মুক্ত করার বিষয়টিকেই বা উপেক্ষা করা যায় কীভাবে?
এসডব্লিউ/এসএস/১৮৫০
আপনার মতামত জানানঃ