১,৩০,০০০ বছর আগে জলবায়ুর দুইটি নির্দিষ্ট পরিবর্তনের প্রভাবে মানুষের তখনকার নিরাপদ বাসস্থান আর বসবাসের উপযোগী রইল না, পরিবর্তে সৃষ্টি হলো একটা ‘সবুজ রাস্তা’ যে রাস্তা ধরে মানুষ তাদের এতদিনের চিরচেনা আপন আবাস ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল। এটাই ছিল আদি মানুষের প্রথম অভিযান যদিও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ মানুষ তখনও মাকগাদিকগাদি (মোটামুটি ২লক্ষ বছর আগে আমরা বিচরণ করছিলাম আফ্রিকার বোতসোয়ানার উত্তর-পূর্বদিকের জাম্বেজি নদীর দক্ষিণতীর ঘেঁষে।) থেকে গিয়েছিল আদিম বাসভূমিতে।
সবুজ রাস্তা মানুষকে সাহায্য করেছিল বৈরি জলবায়ুর কবল থেকে মুক্ত হয়ে ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার দিশা দিতে। তাহলে কেন মানুষ প্রথম আশ্রয় ছেড়ে গেল? নিশ্চিতভাবেই মানুষের আদি নিবাসের জলবায়ু এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রচণ্ড বিপর্যয় দেখা দিয়েছিল।
এক্সেল টিমারম্যান নেচার ম্যাগাজিনে এ সম্পর্কিত প্রকাশিত গবেষণাপত্রের সহলেখক এবং গবেষক ব্যাখ্যা করেন, “জলবায়ুর বড় ধরণের পরিবর্তনের কারণেই মানুষ স্থানান্তরিত হতে বাধ্য হয়েছিল।” ১৩০,০০০ বছর আগে বরফ যুগের শেষ প্রান্তে সৌরজগতে একটা বিশাল পরিবর্তন আসে, ফলে বদলে যায় সূর্যকে ঘিরে পৃথিবীর কক্ষপথ। বদলে যেতে থাকে পৃথিবীর সবকিছু। বিশেষ করে দক্ষিণ গোলার্ধ সূর্যের কাছাকাছি চলে আসে এবং সরাসরি প্রচুর সূর্যালোক পড়তে থাকে একই সাথে অধিক পরিমাণ আর্দ্রতা। জলবায়ুতে দেখা গেল আমূল পরিবর্তন। শুরু হল বছরের পর বছর ধরে অবিশ্রান্ত বৃষ্টিপাত। পৃথিবীর দক্ষিণ গোলার্ধ ছেয়ে গেল সবুজ পত্র-পল্লবে। নিচু এলাকায় সৃষ্টি হলো জলাশয়।
গবেষণায় নিশ্চিত হওয়া গেছে মানুষের প্রকৃত স্থানান্তর ঘটেছিল আরও কিছু পরে, তা প্রায় ১১০,০০০ বছর পূর্বে। বাস্তুচ্যুত হয়ে আরেকটা সবুজ রাস্তা ধরে মানুষ চলে গেল দক্ষিণপশ্চিম দিকে। দুইটা সবুজ রাস্তা গঠন করল বাস্তুহারা মানুষের দীর্ঘ মিছিলের সারি। একটা রাস্তা চলে গেল উত্তরপূর্ব দিকে এবং অন্যটা দক্ষিণপশ্চিমে।
টিমারম্যান যুক্তি দেখাচ্ছেন, এই সবুজ রাস্তা এবং প্রাচীন মানুষ দুজনেই বিরূপ জলবায়ু আর সময়ের প্রয়োজনে সৃষ্টি হয়েছিল এবং সময়ের পাকেচক্রে, বৈরি জলবায়ুর সাথে যুদ্ধ করে টিকতে না পেরে ইতিহাসের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। তবে তারা প্রথম দিকের মানুষের অগ্রযাত্রা শুরু করতে প্রধান ভূমিকা পালন করেছিল। টিমারম্যান আরও বলেন, ২০১৬ সালে নেচার পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে দেখানো হয় সবুজ রাস্তা দিয়ে প্রাচীন মানুষ আফ্রিকা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে।
সবুজ রাস্তা তত্ত্ব মানুষের গণস্থানান্তর সম্পর্কিত আরও কয়েকটি বৈজ্ঞানিক আলোচনায় তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়েছে সেখানে অবধারিতভাবে মানুষের পূর্ব প্রজন্ম, নিয়ান্ডারথালদের আরবে পাড়ি জমানোর ইতিহাস আছে। আদিম মানুষদের যাযাবরের মত চির পরিযায়ী চরিত্র বোঝাতে মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ বিশ্লেষণ এই গবেষণা অভিসন্দর্ভকে দিয়েছে অনন্য স্বতন্ত্রতা।
মূলত সবুজ রাস্তা দিয়ে দলে দলে আদিম মানুষের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ার সময় দেখা দেয় মাইটোকনড্রিয়াল ডিএনএ বিভাজন। আদিম মানুষের ডিএনএ বিভাজন কোন হঠাৎ করে ঘটে যাওয়া কোন অলৌকিক ঘটনা নয়, নয় কোন দুর্ঘটনা, বরং এই বিবর্তন হলো পারষ্পারিক মিথস্ক্রিয়ার ফলাফল। এখানেই এই গবেষণার বিশেষত্ব যে, অতীতের যে কোন গবেষণার তুলনায় আমরা মানুষের স্থানান্তরকে আরও নির্ভুলভাবে দেখাতে সক্ষম হয়েছি।
আমরা জানতে চাই কোথা থেকে আমরা এসেছি। একটা নির্দিষ্ট প্রাচীন আবাসস্থল থেকে আদিম মানুষের জন্ম হয়েছিল তত্ত্বটা অনেক স্বস্তির এবং ব্যাখ্যা করাও সহজ। যদিও এই গবেষণা দলের সবাই মাকগাদিকগাদি জলাশয়ে মানুষের পূর্ব পুরুষের উদ্ভব হয়েছিল বলে তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত করতেই তৎপর। যদিও আদিম মানুষের উদ্ভব নিয়ে বিজ্ঞানের আলোচনা সভায় আরও অনেক তত্ত্ব প্রচলিত আছে। অন্যান্য গবেষকদল দাবী করছে, আদিম মানুষ সম্ভবত একই সাথে একাধিক জায়গায় উদ্ভব ঘটেছিল।
উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ২০১৭ সালে মানুষের উৎপত্তি এবং ক্রমবিকাশ নিয়ে দুইটা গবেষণাপত্রে মরক্কোতে প্রাপ্ত ফসিল নিয়ে প্রকাশিত ধারাবাহিক প্রবন্ধে বলা হয়েছে আধুনিক মানুষের জন্ম হয়েছিল ৩০০,০০০ বছর পূর্বে এবং ধারণা করা হয় একই সময়ে আফ্রিকা জুড়ে মানুষের আবির্ভাব ঘটেছিল।
ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক ইন্সটিটিউটের জীবাশ্ম বিজ্ঞানী পিএইচডি গবেষক এবং এই গবেষণার সহলেখক জ্য জ্যাক হাবলিন ইনভার্স ২০১৭ সালের জুন সংখ্যায় বলেন, “আমাদেরকে আমাদের এতদিনের পাঠ্যবই বদলে ফেলতে হবে। মানুষ প্রজাতি ২০০,০০০ বছর আগে হঠাৎ করে সংরক্ষিত ‘স্বর্গের উদ্যান’ থেকে টুপ করে পূর্ব আফ্রিকার কোন দুর্গম স্থানে পতিত হয়নি। মানুষকে কেউ অভিশাপ দিয়ে পৃথিবীতে নির্বাসন দেয় নি। মানুষ ধীরে ধীরে উদ্ভূত হয়েছে বিভিন্ন ঘাত, প্রতিঘাত, বিবর্তনের মধ্য দিয়ে। যদি কখনো স্বর্গের উদ্যান বলে কিছু থাকত তবে হে মানবজাতি শোনো, সেই উদ্যানের আকার হতো আফ্রিকার মত”।
পক্ষান্তরে এই গবেষণাপত্রটি একটা আলোচনার সূত্রপাত করতে যাচ্ছে মানুষের আদি জন্মস্থান কোথায় এবং কেমন ছিল সেখানের পরিবেশ। মানুষের জন্মস্থানের খোঁজ পাওয়া সব মানুষের জন্যই খুব গুরুত্বপূর্ণ এবং আগ্রহের আলোচ্য বিষয়। মানুষ স্বভাবতই জানতে চায় তারা কোথা থেকে এসেছে, কেমন করে আজকের অবস্থানে এসেছে। বিজ্ঞানীগণ মনে করছেন কাছাকাছি সময়ের ব্যবধানে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন প্রজাতির মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল। আফ্রিকার বোতসোয়ানা মানুষের সেরকম একটা আদি নিবাস। কিন্তু আফ্রিকার বোতসোয়ানা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে, এখানেই আমাদের হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির মানুষ জন্ম নিয়েছিল।
এদিকে, আধুনিক শারীরিক কাঠামো বিশিষ্ট মানুষের উদ্ভব ঘটেছিল ২০০ হাজার বছর আগে আফ্রিকার বোতসোয়ানা অঞ্চলে। যদিও বহু পুরনো কিছু কঙ্কালের বৈশিষ্ট্য দেখে মনে হয় সেগুলোর উৎপত্তিস্থল পূর্ব-আফ্রিকার কোন অঞ্চলে। আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলেও প্রাচীন সমসাময়িক মানুষের বসতি এবং তাদের পদচারণা ছিল তার প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমাণ রয়েছে। এই অঞ্চলে প্রাপ্ত কঙ্কাল সনাক্ত করে দেখা গেছে প্রাচীন মানুষের জীনের পরিবর্তন, বিকাশ এবং বিভিন্ন শাখায় বিভাজনের বিশদ আলেখ্য।
আমাদের বর্তমানের বৈজ্ঞানিক জ্ঞান এবং প্রযুক্তির অভিজ্ঞতা দিয়ে গবেষণাগারে বিপুল পরিমাণ নমুনা (প্রাচীন মানুষের কঙ্কাল) ব্যবহার করে প্রাচীন মানুষের গঠন, আকৃতি, মাথার আকার, দাঁতের প্রকার, হাড়ের প্রকৃতি ইত্যাদি তুলনা করা হয়েছে।
গবেষণার দীর্ঘপথ আমাদের নিয়ে গেছে মানুষের জন্মলগ্নে। আমাদের পূর্ব প্রজন্ম ছিল Haplogroup এর অন্তর্ভুক্ত L0 মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ শাখা।L0 মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ হলো মানুষের জীনের সবথেকে সাদৃশ্যপূর্ণ পূর্ব-প্রজন্ম। ২০১৪ সালের ডিএনএ বিশ্লেষণের এক গবেষণায় দেখা গেছে ২৩৩০ বছর আগেকার যাযাবর মানুষের কঙ্কালের সাথে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের প্রাচীন মানুষের সাথে Haplogroup এর অন্তর্ভুক্ত L0 মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ’র মিল রয়েছে। Haplogroup এর অন্তর্ভুক্ত আছে (L0a, L0b, L0d, L0f, L0k) পাঁচটি প্রধান শাখা। ১২১৭ টি মাইটোজিনমের সাথে ১৯৮ টি মাইটোজিনমের সম্পর্ক হুবহু মিলে যায়।
আফ্রিকার বর্তমান দক্ষিণাঞ্চলের সাথে গবেষণায় ব্যবহৃত কঙ্কালের ভৌগলিক অবস্থান এবং আকারের মধ্যে সাদৃশ্য প্রচণ্ড। বোতসোয়ানার জাম্বেরি নদীর তীরবর্তী স্যান পিপল বা বুশম্যান জনগোষ্ঠীই আদিম মানুষের বংশধর। নির্দিষ্ট সময়ের প্রেক্ষিতে মানুষের মাইটোজিনোমিক বিকাশ, বিস্তার এবং বিভিন্ন গোত্রে ও শ্রেণিতে ছড়িয়ে পড়ার প্রবণতা থেকে বোঝা যায় L0 mitochondrial DNA’র আবির্ভাব ঘটেছে আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলের বোতসোয়ানার মাকগাদিকগাদি-ওকাভাংগো অঞ্চলের আদিম জলাশয়ে।
জীনের বৈচিত্র্যময় বিবিধ বিভাজনের মধ্য দিয়ে ৭০,০০০ বছরের দীর্ঘ পরিক্রমা অতিক্রম করেছে L0 mitochondrial DNA এবং তারপরেই মানুষ তার জন্মস্থান ত্যাগ করে দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে। মানুষের জন্ম লগ্নের অনুরূপ কৃত্রিম আবহাওয়া সৃষ্টি করে এবং তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে আমরা জানতে পারি ক্রমাগত আর্দ্রতা বৃদ্ধি এবং বৃষ্টিপাতের কারণে সবুজ বনানীর একটা বিস্তীর্ণ প্রান্তর সৃষ্টি হয়ে গেল। সবুজ প্রান্তরটি প্রথমে উত্তরপূর্ব দিক থেকে ক্রমশ দক্ষিণপশ্চিম দিকে বিস্তৃত হতে লাগল।
পরবর্তীতে আমাদের পূর্ব-প্রজন্মের বাসভূমি শুকিয়ে গেলে কর্মক্ষম এবং প্রকৃতির বিরুদ্ধে লড়াই করে বেঁচে থাকতে সক্ষম বিশালাকারের জনসংখ্যা গড়ে উঠল।অপরদিকে বৃষ্টিতে ভেজা এবং রোদে শুকানোর এই আবর্তন চলতেই থাকল বছরের পর বছর সেই সাথে সমুদ্রের যাযাবর অধিবাসীদের প্রকৃতির সাথে অভিযোজনের কারণে আদিম মানুষ দক্ষিণপশ্চিমাঞ্চলের সবুজ ভূমিতে পাড়ি জমাতে লাগল দলে দলে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের উপকূলে প্রাপ্ত প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন প্রমাণ করে সবুজ বনানী মানুষের জনসংখ্যা বিস্তারে প্রভূত সাহায্য করেছিল।
সুতরাং সবকিছু বিবেচনা করে এবং গবেষণা এবং তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে বলতে পারি আধুনিক শারীরিক কাঠামোর মানুষের উদ্ভব হয়েছিল আফ্রিকার দক্ষিণাঞ্চলে এবং প্রাকৃতিক পরিবেশের বিরূপ প্রতিক্রিয়া আর বৈরি জলবায়ুর জন্য দল ধরে অজানার উদ্দেশ্যে পাড়ি দেয়ার আগ পর্যন্ত সেখানেই তাদের টেকসই আবাসভূমি ছিল।
এসডব্লিউএসএস/০৭৩৫
আপনার মতামত জানানঃ