গ্রামবাসী দীর্ঘ ৫০ বছর এমপি-চেয়ারম্যানের পেছনে ঘুরেও যখন রাস্তা নির্মাণে ব্যর্থ হয়েছেন। তা নিয়ে জনগণ এমনিতেই ক্ষুব্ধ। এমনই অবস্থায় বেহাল এই রাস্তায় পড়ে মৃত্যু হয় প্রসবকালীন এক নবজাতকের।
এবার ঘুরে দাঁড়ালেন এলাকাবাসী। নবীন ও প্রবীণেরা মিলে নিজেরাই রাস্তাটি করার উদ্যোগ নেন। শুরু হয় নিজেদের অর্থে রাস্তার নির্মাণ কাজ। এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ মিটার রাস্তা নির্মাণ করেছেন তারা। বাকি কাজ চলমান। তবে দীর্ঘ এই রাস্তা নির্মাণে তাদের নিজেদের অর্থটুকুই যথেষ্ট নয়। প্রয়োজন সরকারের সহযোগিতা।
উল্লেখ্য, সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর উপজেলার বেলতলী ইউনিয়নে নির্মাণ হচ্ছে এই সড়ক। গ্রামবাসী শ্রম আর কষ্টার্জিত অর্থ দিয়ে দীর্ঘ দেড় কিলোমিটার রাস্তা বানিয়ে নিচ্ছেন। এতে টাকার যোগান দিতে গিয়ে অনেকে সুদে টাকার ব্যবস্থা করেছেন। তাতে অনেকে দেনার দায়েও পড়েছেন। তবু প্রয়োজনের তাগিদে তারা সড়ক নির্মাণে পিছপা হননি।
যে সমস্যায় পড়েছে গ্রামবাসী
নিউজবাংলার সূত্র মতে জানা যায়, শাহজাদপুর উপজেলায় বেলতৈল ও জালালপুর ইউনিয়নের ৬টি গ্রামের দশ হাজার মানুষ চলাচলের জন্য প্রায় দেড় কিলোমিটার দীর্ঘ রাস্তা হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন এক থেকে দেড় হাত প্রশস্ত এবরোখেবরো ও খানাখন্দে ভরা আইল। এই দুই ইউনিয়নের বেলতৈল পূর্বপাড়া, মূলকান্দি, মোল্লাপাড়া, টোপপাড়া, গাবেরপাড়া ও চৌবারিয়া গ্রামের মানুষের জীবিকার একমাত্র মাধ্যম কৃষি কাজ।
রাস্তা না থাকায় কৃষকরা তাদের উৎপাদিত ফসল অন্য এলাকার তুলনায় অনেকটা কম দামে বিক্রি করতে বাধ্য হন। কারণ উৎপাদিত পণ্য বাজারে নেয়ার মতো কোনো সড়ক নেই। রিকশা-ভ্যান চলাচলেরও সুযোগ নেই। আর বৃষ্টির সময় তো এই আইল ধরে হাঁটাও দুঃসাধ্য। পিচ্ছিল পথে হাঁটতে গিয়েও দুর্ঘটনায় পড়তে হয়।
এমনকি এসব গ্রামের কারও মৃত্যুর পর মরদেহ কবরস্থান পর্যন্ত নিতে খাটিয়া ব্যবহারের সুযোগ ছিল না। একইরকম দুর্ভোগে পড়তে হতো কোনো অসুস্থ মানুষকে হাসপাতাল পর্যন্ত নেয়ার ক্ষেত্রে।
রাস্তা বানাচ্ছে গ্রামবাসী
এমন অবস্থায় গ্রামের সাধারণ মানুষ বারবার স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের কাছে রাস্তা নির্মাণের জন্য ধরনা দিলেও কোনো ফল আসেনি। অবশেষে চলতি বছর বেলতৈল পূর্ব পাড়ার খবির মোল্লার ছেলের অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হাসপাতালে নেয়ার পথে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। মারা যায় নবজাতক।
এ ঘটনার পর এলাকার নারী-পুরুষ, ছোট-বড় সবাই মিলে নিজেদের রাস্তা নিজেরাই নির্মাণের উদ্যোগ নেন। প্রতিটি পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়ে শুরু করা হয় রাস্তার কাজ। ১২ ফুট চওড়া ও উঁচু করে শুরু হয় রাস্তার নির্মাণ কাজ। এলাকাবাসীর অনেকের সাধ্য না থাকার পরও তারা ঋণ করে এমনকি অনেকে সুদের ওপর টাকা নিয়ে রাস্তার জন্য বিশ থেকে ত্রিশ হাজার টাকা করে চাঁদা দেন।
সংশ্লিষ্টদের মতামত
রাস্তা নির্মাণে সড়ক নির্মাণে সম্পৃক্তদের একজন কর মূলকান্দি গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম বলেন, ‘দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে রাস্তার জন্য কষ্ট করছি। কেউ পাশে আসেনি। তাই নিজেরাই পরিশ্রম করে নিজেদের রাস্তা করছি। প্রতিটি বাড়ির সদস্যরা এখানে স্বেচ্ছায় কাজ করছে।’
বেলতোল পূর্ব পাড়ার মোজম মোল্লার স্ত্রী রাবেয়া খাতুন বলেন, ‘আমার বাড়িতে আটজন সদস্য। আমাদের কোনোমতে সংসার চালাতেই কষ্ট হয়। কিন্তু কী করবো! আমাদের রাস্তাটা খুবই দরকার। তাই সুদের ওপর ৩০ হাজার টাকা তুলে রাস্তার কাজের জন্য দিয়েছি। এখন থেকে মাসে মাসে সুদের টাকা দিতে হবে।’
একই অবস্থা ওষুধের ছোট্ট দোকানি আশরাফুল ইসলামের। তিনি বলেন, ‘সরকারের কোনো উন্নয়ন বাজেট আমাদের এখানে আসে না। এমপি-চেয়ারম্যান কেউ খোঁজ নেন না। তাই বাধ্য হয়ে প্রয়োজনের তাগিদেই ঋণ করে টাকা দিয়েছি। তাও আমাদের চলাচলের জন্য একমাত্র রাস্তাটা হোক। এত কষ্ট আর ভালো লাগে না।’
রাস্তা নির্মাণের এই কাজে শ্রম দিচ্ছে গ্রামের শিশুরাও। শিশু আবেদ, জাফর, নেহাল ও সুমন বলে, ‘রোজার জন্য স্কুল বন্ধ। আমাদের এলাকার সবাই রাস্তার কাজ করছে। তাই আমরাও লেখাপড়ার ফাঁকে এসে এখানে রাস্তার কাজ করছি।’
এই রাস্তা নির্মাণে প্রথম থেকেই সহযোগিতা ও পরামর্শ দিয়ে আসছেন সমাজসেবক আব্দুলাহ আল মামুন। তিনি জানান, রাস্তা নির্মানের জন্য পাশে থেকে পানি উন্নয়ন বোর্ড থেকে অনুমতি নিয়ে দুপাশ থেকে মাটি কেটে রাস্তা নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া বেসরকারিভাবে ইঞ্জিনিয়ার দিয়ে রাস্তার লে-আউট করা হয়েছে। গ্রামবাসীর নিজেদের জায়গার ওপর দিয়ে তাদেরই শ্রম আর অর্থে রাস্তাটি নির্মাণ করা হচ্ছে।’
চেয়ারম্যানের বক্তব্য
এ বিষয়ে ৮ নম্বর বেলতৈল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রফিকুল ইসলাম রফিক বলেন, ‘গ্রামবাসীর এমন উদ্যোগ দেখে আমি তাদের পাশে এগিয়ে এসেছি। আমি আমার নিজের অর্থায়নে তাদের ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি।’
তিনি বলেন, ‘এই এলাকার উন্নয়নের জন্য এমপি মহোদয় আমাদের সাথে কোনো সমন্বয় করেন না। কোন প্রকার সরকারি অনুদানও দেন না। যে কারণে আমার ব্যক্তি ইচ্ছা থাকলেও পরিষদের পক্ষ থেকে করার কিছু ছিলো না।’
একইসঙ্গে তিনি প্রতিশ্রুতি দেন, আগামীতে এ বিষয়ে তিনি তার সর্বোচ্চ চেষ্টা দিয়ে একটি ফান্ড যোগাড় করবেন।
স্থানীয় সংসদ সদস্য প্রফেসর মেরিনা জাহান কবিতা বলেন, ‘আমি মাত্র দুই বছর ধরে এমপি হয়েছি। আমার সময়কার সব বরাদ্দ বণ্টন করা হয়ে গেছে। এই রাস্তা সম্পর্কে আমি জানতাম না। তবে আগামীতে বরাদ্দ এলে এখানে আগে কাজ করা হবে।’
এসডব্লিউএসএস/১৯২৫
আপনার মতামত জানানঃ