শুরুতে প্রত্নতত্ত্ববিদদের এক আবিষ্কারের কথা বলা যাক। সবচেয়ে প্রাচীন পায়ের ছাপ পাওয়া গেছে সম্প্রতি দক্ষিণ-পূর্ব পোল্যান্ডে। চার পায়ের প্রাণীটির পায়ের যে ছাপ খুঁজে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা তাকে পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন বলে অভিহিত করা হচ্ছে। খুঁজে পাওয়া পায়ের ছাপের প্রাণীটি ৩৯৭ মিলিয়ন বছর আগে পৃথিবীতে বিচরণ করত বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা। এর আগ পর্যন্ত প্রাপ্ত সবচেয়ে পুরনো চতুষ্পদী প্রাণীটি ৩৬০ মিলিয়ন বছর আগের। পরে ৩৭৫ বছরের পুরনো আধা মাছ-আধা উভচর একটি প্রাণীর কঙ্কাল খুঁজে পাওয়া যায়। সম্প্রতি আবিষ্কৃত প্রাণীটির আগে এটাই ছিল প্রাচীনতম প্রাণীর নিদর্শন।
সর্বশেষ আবিষ্কৃত পায়ের ছাপ নিয়ে একটি প্রতিবেদন সম্প্রতি বিজ্ঞান সাময়িকী ‘নেচারে’ প্রকাশিত হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, প্রাণীটি অবশ্যই জলজ প্রাণী থেকে স্থলচর প্রাণীতে পরিণত হয়েছে। গবেষণার ফলাফল দেখে বলা যায়, প্রাণীটির বিবর্তন হয়েছিল খুব ধীরে। পোল্যান্ডের পাহাড়ের গায়ে ছাপ থেকে প্রাণীটিকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। তবে প্রাণীটি যে চারপেয়ে সে বিষয়ে নিশ্চিত বিজ্ঞানীরা। ন্যাচার জার্নালের এক প্রবন্ধে এ পায়ের ছাপের অস্তিত্ত সম্পর্কে বলা হয়, এর মাধ্যমে আমাদের আগের ধারণা পাল্টাতে হবে। কারণ আমাদের ধারণাকৃত সময়ের অনেক আগেই পৃথিবীতে চারপেয়ে প্রাণীর অস্তিত্বের প্রমাণ মিলল। সুইডেনের উপসালা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক পার আলবার্গ বলেন ‘এটা আমাদের এ যাবত কালের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার।
এত পুরনো ফসিল আমরা এর আগে আর খুঁজে পাইনি। এই পায়ের ছাপ আমাদের পূর্বের সব তথ্যকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। এর মাধ্যমে আমরা খুঁজে পাব আগের প্রাণীদের অস্তিত্ত এবং তাদের জীবন সম্পর্কে ’। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন যে, প্রাণীটির পায়ের ছাপের অস্তিত্ব তাঁরা খুঁজে পেয়েছেন, সেটি ছিল চার পা-বিশিষ্ট। আর প্রাণীটি সম্ভবত কুমির গোত্রের। গড়ে ছাপগুলো দু’ মিটার লম্বা। এই ছাপ খুঁজে পাওয়া দলের সদস্য পোল্যান্ড এবং সুইডেনের বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, এর মধ্য দিয়ে তারা প্রাচীন এই প্রাণীটির কাঁধ, কনুই এবং শরীরের পেছনের অংশসহ তাদের চলাফেরা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাবেন। ৩৯৭ মিলিয়ন বছর আগের এই ফসিলটিই এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া ফসিলের মাঝে সবচেয়ে পুরনো।
তবে বিজ্ঞানীদের আলোচনায় আছে আধা জলহস্তী ও আধা গিরগিটির মত দেখতে একটা প্রাণী। অপরিচিত। আমাদের পরিচিত গণ্ডির মধ্যে পড়ে না এই প্রাণীটা। এই প্রাণীটাকে নিয়েই আজকের আয়োজন। এই প্রি-রেপটাইল বা প্রাথমিক সরিসৃপটিকে এখন বিজ্ঞানীরা আমাদের জানা প্রাণিদের মধ্যে চার পায়ের সবকটা ব্যাবহার করে হাঁটা প্রথম প্রাণী বলে মনে করছেন।
এই প্রাণীটার নাম Bunostegos akokanensis। এই প্রাণিটি আজ থেকে প্রায় ২৬০ মিলিয়ন বছর পূর্বে বর্তমান আফ্রিকান দেশ নাইজারে টিকে ছিল।
এই প্রাণিটি প্যারেইয়াসর গ্রুপের অন্তর্ভূক্ত। এই প্রাণিটি থেকেই বিবর্তিত হয়ে কচ্ছপের আবির্ভাব বলে বিজ্ঞানীদের মধ্যে বহুদিনের একটি বিতর্ক চলছে।
বিজ্ঞানীদের মতা, বুনোস্টেগস এর সময়ের অনেক প্রাণীরই এদের মত একই রকম আপরাইট অথবা সেমি আপরাইট হাইন্ড লিম্ব পোসচার (পেছনের পা)। কিন্ত বুনোস্টেগস এর মধ্যে যে জিনিসটি অন্য সবার থেকে আলাদা তা হল এদের ফোরলিম্ব বা সামনের পা। এমনটাই জানিয়েছেন মরগান টার্নার, যিনি ভার্টেব্রাটা প্যালেওন্টোলজি জার্নালে পেপারটি পাবলিশিং এ কোঅথরিং করেন।
তিনি বলেন, “এদের ফোরলিম্ব বা সামনের পায়ের যে স্ট্রাকচার দেখা যাচ্ছে তা এদের হামাগুড়ি দিতে এলাউ করবে না। আর এই ব্যাপারটাই বুনোস্টেগসদের মধ্যে ইউনিক।”
আগে ভাবা হত যে, বুনোস্টেগস সহ অন্যান্য সমস্ত প্যারেইয়াসোররা হামাগুড়ির মাধ্যমে চলত। এইসব প্রাণিদের শরীরে নিচের দিকে তীর্যকভাবে একটি অঙ্গ লাগানো থাকত যা ভূমিকে স্পর্শ করত ঠিক আজকের গিরগিটি ও স্যালাম্যান্ডারদের মত।
প্রাণিরা সম্পূর্ণভাবে দাঁড়ানোর জন্য বিবর্তিত হবার আগে ভূমিতে এক জায়গায় থেকে আরেক জায়গায় যাবার জন্য এটাই ছিল আদীমতম উপায়।
এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, এই হামাগুড়ি দেয়া অবস্থা থেকে পায়ে ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় ট্রাঞ্জিশন হওয়াটা আগের ধারণার সময়ের চেয়ে আরও আগেই হয়ে গিয়েছিল।
বুনোস্টেগসের ফসিল সবার প্রথমে ব্রাউন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যালিওন্টোলজিস্টদের দৃষ্টি কারে ২০০৩ সালে। টার্নার যখন এদের ফসিল দেখছিলেন তখন তিনি ভাবেন, অবশ্যই এদের লিম্বগুলো অবশ্যই শরীরের সরাসরি নিচে অবস্থিত।
শোল্ডার জয়েন্ট বা ঘাড়ের জয়েন্টগুলো এমনভাবে কোণ করে আছে যে এদের হিউমেরাস বা আপার আপ বোন এর দেহের সাইডওয়ে বা পাশাপাশি অবস্থানে আটকে থাকা অসম্ভব। তার উপর বেশিরভাগ হামাগুড়ি দেয়া প্রাণির হিউমেরাস টুইস্টেড বা পাঁকানো অবস্থায় থাকে যাতে পায়ের পাতা ও লোয়ার আর্ম মাটিতে পৌঁঁছাতে পারে আর এই ব্যাপারটা বুনোস্টেগাসদের হাড়ে দেখা যায় না যা নির্ধেশ করে এদের পাগুলোর পজিশন একইরকম উপায়ে ছিল না। আর এখানেই এভিডেন্সের শেষ নয়।
হামাগুড়ি দেয়া প্যারেইয়াসরদের এলবো বা কনুই এর জয়েন্ট খুবই ফ্লেক্সিবল থাকে কিন্তু বুনোস্টেগসদের বেলায় টার্নার এটা পান নি। এদের জয়েন্টগুলো বরং অনেকটা আমাদের হাঁটুর জয়েন্টের সাথেই মিলে যায় যা পায়ের পাতা ও লোয়ার আর্মকে সামনে আর পেছনে নড়তেই এলাউ করে।
আর সবশেষে সমস্ত দাঁড়াতে সক্ষম প্রাণিদের সামনের ও পেছনের পা এর দৈর্ঘ্যের যে অনুপাত থাকে, যেখানে পেছনের পা সামনের পা এর চেয়ে দীর্ঘ হয় তা এদের বেলাতেও দেখা যায়।
টার্নার জানান, “প্রাণীদের অঙ্গের চালচলন ও অবস্থান পরিবর্তনের বিবর্তনে অনেক জটিলতা আছে। আমরা প্রতিদিন এটা ভালভাবে বুঝতেই কাজ করছি। বুনোস্টেগস এর এনাটমি পুরোপুরি আনএক্সপেক্টেড ছিল আর এটা আমাদের বলে যে আমাদের আরও অনেক নতুন কিছুই শেখার আছে।”
হামাগুড়ি বা স্প্রলিং অবস্থা থেকে আপরাইট হবার অবস্থা একেবারে এক ধাপেই হয়ে যায় নি, ধীরে ধীরে হয়েছে। তাই টার্নার আশা করছেন যে পরে একই বৈশিষ্ট্যের বূনোস্টেগস প্রজাতির মত প্যারেইওসরদের আরও দাঁড়াতে সক্ষম প্রজাতির খোঁজ পাওয়া যাবে।
এসডব্লিউ/এসএস/১৯৫৫
আপনার মতামত জানানঃ