প্রাচীন মিশরের যে কাহিনিগুলো ইতিহাসে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, তাতে মূলত ফারাও, মমি, বা পিরামিডের আধিক্য চোখে পড়ে। ক্যালেন্ডার ধরে হিসেব কষলে সেটা হবে চার-পাঁচ হাজার বছর আগের। কিন্তু মিশরের ধুলো-বালি সাক্ষী হয়ে আছে পিরামিডের বহু আগেকার সভ্যতারও। প্রাগৈতিহাসিক মিশরে সভ্যতার এক উৎকৃষ্ট উদাহরণ হতে পারে ‘নাবতা প্লায়া’।
বর্তমানে এটি দক্ষিণ মিশরের আবু সিম্বেল থেকে প্রায় শত কিলোমিটার পশ্চিমে নুবিয়ান মরুর বুকে অবস্থিত।
নাবতা প্লায়া আর দশটা স্থান থেকে আলাদা হবার কারণ হলো, এটি শত শত প্রাগৈতিহাসিক টুমুলি (মাটির বৃহৎ টিলা এবং কবরের উপর স্থাপিত উঁচু পাথর), স্টেলা, ও মেগালিথিক কাঠামো ধারণ করে আছে।
‘মেগালিথিক’ শব্দটা বুঝতে হলে আগে ‘মেগালিথ’ শব্দের মানে বোঝা লাগবে। প্রাগৈতিহাসিক কোনো স্থাপত্য, মিনার কিংবা সৌধ নির্মাণে যে পাথর ব্যবহার করা হত, সেই পাথরই মেগালিথ নামে পরিচিত। আর এই স্থাপত্য বা মিনার কোনো কংক্রিটের ব্যবহার ছাড়া শুধুমাত্র মেগালিথ (বিশেষ প্রাচীন পাথর) দিয়ে তৈরি হয়ে থাকলে সেই নির্মাণশিল্পকে বলা হয় ‘মেগালিথিক’। পৃথিবীর জনপ্রিয় এক মেগালিথিক হলো স্টোনহেঞ্জ।
১৯৬০-এর দশকে, গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোকে প্লাবনের হাত থেকে রক্ষা করতে মিশর নীল নদীর তীরে একটি বড় বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা করেছিল। সেই কাজে সরকারকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয় ইউনেস্কো।
ঐসময় ফ্রেড ওয়েনডর্ফ নামে একজন আমেরিকান প্রত্নতত্ত্ববিদ নীল নদ থেকে দূরে ফারাওদের প্রাচীন উৎস উন্মোচনে ব্যাপক আগ্রহী ছিলেন। ১৯৭৩ সালে, বেদুইন- আরব গাইড ইদে মারিফ সাহারা অতিক্রম করার সময় বিশাল পাথুরে স্থাপত্যের মতো কিছু একটা দেখতে পান। ওয়েনডর্ফের সাথে আগে থেকে পরিচয় থাকায়, মারিফ তাকে সেই স্থানে নিয়ে যান।
প্রথমে ওয়েনডর্ফ ভেবেছিলেন এগুলো প্রাকৃতিকভাবেই গড়ে উঠেছে। তাই বিষয়টাকে প্রথমে তিনি আমলে নেননি। কিন্তু কিছুদিন পর বিষয়টা তার মনে সন্দেহের দোলা দিতে লাগল। কয়েক দশক ধরে তিনি বহুবার আসা-যাওয়া করলেন জায়গাটিতে।
‘৯০ দশকের গোড়ার দিকে ওয়েনডর্ফ এবং পোলিশ প্রত্নতাত্ত্বিক রোমুয়াল্ড শিল্ডসহ খননকারীদের একটি দল পাথরের একটি বৃত্ত উন্মোচন করতে সক্ষম হন। কিন্তু এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারল না কেউ। দীর্ঘ সাত বছরেও রহস্যের কোনো কূলকিনারা করতে না পেরে পর ওয়েনডর্ফ আমেরিকান প্রত্নতাত্ত্বিক-জ্যোতির্বিদ ম্যালভিলের শরণাপন্ন হন।
স্থানটির জ্যামিতিক গঠন দেখে দারুণ বিস্মিত হন ম্যালভিল। তিনি প্রথম দেখাতেই বুঝতে পেরেছিলেন, এটি প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার সাথে যেকোনোভাবে সম্পৃক্ত। তিনি আবিষ্কার করেছিলেন, পাথরের বৃত্তটি আকাশের আর্কটারাস, লুব্ধক এবং আলফা সেন্টোরি নক্ষত্রের সাথে সংযুক্ত ছিল।
এ নিয়ে বিস্তর গবেষণার পর ১৯৯৮ সালে নেচার জার্নালে ‘সাহারায় স্টোনহেঞ্জ’ নামে এক গবেষণাপত্র প্রকাশ করেন।
নাবতা প্লায়ার পাথরের কাঠামোগুলো কয়েক বছরে গড়ে উঠেনি। এর পেছনে রয়েছে সুদীর্ঘ কয়েক হাজার বছরের ইতিহাস। হাজার বছর ধরে এখানকার বাসিন্দারা অগণিত ভূগর্ভস্থ সমাধি, বিশাল পাথরের স্ল্যাব, পাথরের বৃত্তের মতো দৃষ্টিনন্দন মেগালিথিক স্থাপনা নির্মাণ করেছে।
তবে এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ছিল ২,৫০০ মিটার জুড়ে বিস্তৃত স্টেলার সারি। এই স্থাপনাগুলো বিশ্বের প্রাচীনতম কাঠামো হিসেবে বিবেচিত। আবার কিছু কিছু স্থাপনা তো জনপ্রিয় মেগালিথিক স্টোনহেঞ্জের চেয়েও প্রাচীন।
পাথরের একটি বৃত্তকে নাবতা প্লায়ার সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ কাঠামো হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চার মিটার ব্যাসবিশিষ্ট এই পাথুরে গড়ন চার জোড়া বড় পাথর এবং বহু সারি সারি ক্ষুদ্র পাথর দিয়ে গঠিত। বৃত্তের মধ্যে আবার তিনটি পাথরের দুটি সারি বিদ্যমান।
প্রত্নতত্ত্ববিদ ওয়েনডর্ফ এবং কলোরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ম্যালভিলে প্রমাণ করেন, দুই জোড়া পাথর ছিল উত্তর-দক্ষিণ বরাবর, আর বাকি দুই জোড়া পাথর ছিল পূর্ব-পশ্চিম বরাবর। এজন্য তারা স্যাটেলাইট প্রযুক্তির সাহায্য নিয়েছিলেন।
অনুমান সাপেক্ষে তারা জানান, পাথরের এই বৃত্ত নাবতা প্লায়াবাসীরা ব্যবহার করত নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ এবং গ্রীষ্মকালে সৌর বিন্দুর অবস্থান নির্ণয়ে। প্রাচীন সমাজ নক্ষত্রপুঞ্জ অধ্যয়ন করে রাতের আকাশের গতিবিধি বুঝতে পারত।
খানিকটা ভিন্ন ধাঁচের সুর দিয়েছেন নাসার সাবেক পদার্থবিদ টমাস জি. ব্রোফি। তিনি বলেছেন, বৃত্তের ভেতরের দক্ষিণ সারির তিনটি পাথর কালপুরুষ বেল্টের তিনটি নক্ষত্র এবং বাকি তিনটি পাথর কালপুরুষের মাথা এবং কাঁধের প্রতিনিধিত্ব করত।
কালপুরুষ বেল্টের সাথে ক্যালেন্ডার সার্কেলের সম্পর্ক ৬৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৯০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দের মধ্যে ঘটেছিল। এই এলাকার কিছু ক্যাম্প ফায়ারের রেডিও কার্বন টেস্ট করেও এই তারিখের সাথে মিল পাওয়া গেছে।
দক্ষিণে গেলে দুটি সমতল-শীর্ষ ঢিবি পাওয়া যায়। সেখানে ভাঙা পাথরের গুচ্ছ দ্বারা অসংখ্য এবড়োখেবড়ো মেগালিথিক কাঠামো গঠিত হয়ে আছে। উত্তরের অংশে বেলে পাথরের তৈরি প্রায় দশটি টুমুলি এবং গবাদিপশুর দেহাবশেষের সন্ধান মিলেছে। এর থেকে প্রমাণিত হয় যে, ওই যুগে পশু উৎসর্গ বা পশুবলির রীতি চালু ছিল। হয়তো সেই বলির আয়োজন করা হতো কোনো দেব-দেবীর সন্তুষ্টি অর্জনের চেষ্টায়।
খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ অব্দের দিকে এখানে একটি প্রাগৈতিহাসিক ধর্ম পালনের প্রমাণ পাওয়া যায়। উত্তরের পাহাড় বরাবর আবার এমন এক মেগালিথের নিদর্শন মেলে, যেটা ওজনে ছিল কয়েক টনের মতো, আর লম্বায় ছিল ৬০০ মিটারের মতো উঁচু।
অনুসন্ধিৎসু মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, পাথরগুলো কীভাবে এসেছিল নাবতা প্লায়াতে? ঐসময় তো আশেপাশে কোনো পাথরের পাওয়া যেত না। এটার উত্তরে গবেষকরা বলেছেন, পানির জন্য কূপ খনন করলে ঐখানে হয়তো পাথরের সন্ধান পায় তারা। তারপর ওই সময়কার বিভিন্ন ধারালো যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে পাথরকে বিভিন্ন আকৃতি দিয়েছিল নাবতার বাসিন্দারা। তবে এটি নিশ্চিত করে বলা যায় না, স্রেফ একটি ধারণা।
পাথরের বৃত্ত এবং নক্ষত্রের সাথে মিল রেখে মেগালিথকে একই সরলরেখায় সুবিন্যস্তকরণের প্রক্রিয়া থেকে ধারণা হয়, এই অঞ্চলটি সম্ভবত আঞ্চলিক আনুষ্ঠানিক কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হতো। ওই আমলের তুলনায় আফ্রিকায় এমন জিনিস প্রায় নজিরবিহীন। তবে অন্যান্য এলাকায় মেগালিথিকের অস্তিত্ব মিললেও, তা নির্মিত হয়েছে নাবতা প্লায়ার মেগালিথের অনেক পর।
বেশিরভাগ প্রাচীন সভ্যতার মতো একই দুর্দশা বরণ করে নিতে হয়েছিল নাবতা প্লায়াকেও। তার আয়ুষ্কাল ফুরিয়ে আসে ৫০০০ বছর আগে ঘটা এক জলবায়ু পরিবর্তনের মাধ্যমে। এই পরিবর্তনে ভেঙে পড়ে মেগালিথ নির্মাতাদের নাবতা প্লায়ার সভ্যতা। এলাকাটি গ্রাস করে মরুর তপ্ত বালি। বাঁচার তাগিদে এই অঞ্চলের বাসিন্দারা বাসযোগ্য কোনো স্থানে বসতি গড়তে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু কোথায় স্থানান্তরিত হয়েছিল তারা?
কিছু কিছু প্রত্নতত্ত্ববিদ এবং ঐতিহাসিকের মতে, নাবতার জনগণ এসে আস্তানা গেড়েছিল নীল নদের উপত্যকার উর্বর ভূমিতে। বলা যায়, তারাই নীল নদকেন্দ্রিক মিশরীয় সভ্যতা নির্মাণের সব্যসাচী রূপকার।
প্রত্নতত্ত্ববিদ ম্যালভিলের ভাষায়, নাবতার বাসিন্দারা ওখান থেকে সরে আসার ৫০০ বছরের মধ্যেই সাক্কারার ধাপ পিরামিড নির্মাণ করেছিল। এর থেকে ইঙ্গিত পাওয়া যায়, আগে থেকেই তাদের একটি প্রাক-সাংস্কৃতিক ভিত্তি বিদ্যমান ছিল, যা তাদেরকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রাচীন সভ্যতা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে।
এসডব্লিউ এসএস /২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ