পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ অ্যান্টার্কটিকা। দক্ষিণ মেরুতে অবস্থিত অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের গড়ে ৯৮ ভাগই প্রায় দুই কিলোমিটার পুরু বরফাবৃত। এক কোটি ৪০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে থাকা এই বরফাবৃত অঞ্চলকে পৃথিবীর শুষ্কতম মরুভূমি হিসেবেও চিহ্নিত করা হয়। মাঝে মধ্যেই বিজ্ঞানীরা অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলে যাওয়া সম্পর্কে সাবধান করছেন পৃথিবীর মানুষকে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের ওরেগন স্টেট ইউনিভার্সিটির ক্লাইমেট সায়েন্স বিভাগের গবেষকরা জানিয়েছেন, গত দেড় থেকে দুই দশক ধরে অত্যন্ত দ্রুত গতিতে গলেছে অ্যান্টার্কটিকার বরফ। সেখানে গত ২৫ বছরে গলেছে ৩ লক্ষ কোটি টন বরফ! এই গতিতে অ্যান্টার্কটিকার বরফ গলতে থাকলে আগামী ৩০ থেকে ৫০ বছরের মধ্যে অ্যান্টার্কটিকার পশ্চিমপ্রান্তের বরফ খণ্ডগুলোর উল্লেখযোগ্য অংশ গলে যাবে। মূলত উষ্ণায়নের কারণেই গলছে অ্যান্টার্কটিকার বরফ। পৃথিবীর উষ্ণায়নের হার এইভাবে চলতে থাকলে আগামী ৪৭৫ বছরের মধ্যে পৃথিবীতে দেখা দিতে পারে মহাপ্লাবন। পৃথিবীর অন্তত ৭০ শতাংশ তলিয়ে যাবে পানির নিচে!
কিন্তু এখন প্রশ্ন হল এই যে, অ্যান্টার্কটিকায় কি সবসময়ই এমন বরফ ছিল? নাকি ইতিহাসের একটা সময়ে এই মহাদেশ ছিল অন্যরকম। ছিল না বরফ। ছিল সবুজ। ছিল বিভিন্ন প্রাণীর চলাচল। আদৌ ছিল কি?
ছিল উষ্ণ এক মহাদেশ
অ্যান্টার্কটিকা নামটা শুনলেই মনে হয় কনকনে ঠান্ডার এক বরফের রাজ্য। মনে হওয়াটা ভুল নয়। কিন্তু অ্যান্টার্কটিকা মোটেও তা ছিলনা। কেউ যদি অ্যান্টার্কটিকায় হাজির হন তাহলে নিশ্চয়ই তিনি সেখানকার অতি ভয়ংকর ঠান্ডার মোকাবিলার জন্য সেই ধরনের বিশেষ গরমের পোশাক নিয়ে যাবেন। ওখানে যাঁরা গবেষণার কাজ করেন তাঁরাও এমনই গরমের পোশাক পরেন।
অ্যান্টার্কটিকায় যে গরম পড়ত, এখন অনেক শহরেই তেমন গরম দেখা যায়। সে সময় অ্যান্টার্কটিকা ছিল সবুজ গাছে ভরা। সেসব গাছের জীবাশ্ম এখনও অ্যান্টার্কটিকায় দেখতে পাওয়া যায়। এমনকি সেখানে ডাইনোসর ঘুরে বেড়াত বলেও জানা যায়। অ্যান্টার্কটিকায় এমন গরম পরিবেশ, এমন সবুজ বনানী এবং নানা অতিকায় জীব ঘুরে বেড়াত এখন থেকে প্রায় ৪০ মিলিয়ন বছর আগে। তেমনই জানাচ্ছেন বিজ্ঞানীরা।
৪ কোটি বছর আগেই অ্যান্টার্কটিকা কোনও বরফের রাজ্য ছিলনা। ক্রমে সেখানে আবহাওয়া বদলায়। সেখানে পরিস্কার জলের অতিকায় বরফের চাদর পড়তে শুরু করে এবং তা পুরু হতে থাকে। তারপর এখন যা দেখা যাচ্ছে সেই রূপে পৌঁছয়। অ্যান্টার্কটিকা বরফের রাজ্য হয়ে যায়। সেখানে সবুজ বলে আর কিছুই থাকেনা।
এমনকি ঘন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানো জীবরাও সেখান থেকে উৎখাত হয়। এখন যে জীব দেখা যায় তারা নেহাতই প্রবল ঠান্ডায় বাস করে অভ্যস্ত প্রাণি। যে তালিকায় পেঙ্গুইন, সিলের মত প্রাণিরা রয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিজ্ঞানী এর চেয়েও বেশি কিছু করে দেখালেন। এই দলে ছিলেন ভূগোলবিদ, প্রত্নতাত্ত্বিক, ভূপদার্থবিজ্ঞানী, ভূরসায়নবিদ এবং একজন জলবায়ু-পদার্থবিজ্ঞানীও। তারা দৃষ্টি ফিরিয়েছিলেন প্রাচীন অ্যান্টার্কটিকায়।
বাস্তবে নয়, তত্ত্বের কাল্পনিক মডেলের ওপর ভর করে তারা পৌঁছে গিয়েছিলেন কয়েক কোটি বছর পেছনের অ্যান্টার্কটিকায়। সেখান থেকে তারা ফিরেও এসেছেন। আর সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন এই খবরটা- ওই দূর অতীতে অ্যান্টার্কটিকা উষ্ণ ছিল!
দূর অতীত বলতে ৪ কোটি থেকে ৫ কোটি বছর আগের কথা। ভূতাত্ত্বিক বর্ষপঞ্জি অনুযায়ী এই সময়টাকে বলা হয় ইওসেন যুগ। সেই যুগে কেমন ছিল অ্যান্টার্কটিকা, সেখানে তাপমাত্রা কতখানি উষ্ণ ছিল- এসবই ছিল জানবার বিষয়।
অ্যান্টার্কটিকা আয়তনে অস্ট্রেলিয়ার দ্বিগুণ। এর ৯৮ ভাগই সমুদ্র। এই সমুদ্র আসলে বরফ-সাগর। এই সাগরের একেকটা বরফ-ফালির পুরুত্ব গড়ে দুই কিলোমিটার। কিন্তু ইওসেন যুগে? যখন পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে কার্বনডাই-অক্সাইডের আধিক্য ছিল, কেমন ছিল এই সাগরের চেহারা? বিজ্ঞানীরা বলছেন, অ্যান্টার্কটিকার এই জলরাশির কিছু অংশের তাপমাত্রা আজকের ক্যালিফোর্নিয়া কিংবা ফ্লোরিডার মতো উষ্ণ ছিল। এই উষ্ণতা বিরাজ করেছে বহু বছর ধরে।
মার্কিন বিজ্ঞানীরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছেন অতীতকালের তাপমাত্রা পরিমাপের নতুন এক পদ্ধতি ব্যবহার করে। যেমন, অ্যান্টার্কটিকার বরফভূমির ভেতর থেকে খুঁজে বের করা হয় ফসিল শেল। এই ধরনের ফসিল শেলে থাকে অতিবিরল কিছু আইসোটোপ (একই মৌলের ভিন্ন ভিন্ন ভর)। এসব তেজস্ক্রিয় আইসোটোপই বলে দেয় অতীতের খবর।
ইয়েলের বিজ্ঞানীরা কার্বন-১৩ ও অক্সিজেন-১৮- এ দুটো তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ নিয়ে গবেষণা করেন। পরে ভূ-থার্মোমিটারের মানের সঙ্গে মিলিয়ে কম্পিউটার সিমুলেশনের মাধ্যমে জানা যায়, ইওসেন যুগে অ্যান্টার্কটিকার কিছু অংশের গড় তাপমাত্রা ছিল ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ক্যালিফোর্নিয়ার উপকূলে আজকাল এরকম তাপমাত্রা বিরাজ করছে।
অ্যান্টার্কটিকার দক্ষিণ প্যাসিফিক সমুদ্রের কিছু অংশের তাপমাত্রা ছিল আরো বেশি, ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। বর্তমানে ফ্লোরিডার সমুদ্রজলের তাপমাত্রা এ রকম।
গবেষণার সঙ্গে জড়িত ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল ও ভূপদার্থবিজ্ঞানের সহযোগী অধ্যাপক হেগিট অ্যাফেক বলেছেন, তাদের এই গবেষণার গুরুত্ব অনেকখানি। ভবিষ্যতে জলবায়ু কেমন হবে তা বোঝার জন্য এই গবেষণা অনুসরণ করেই আবহাওয়া-মডেল তৈরি করা সহজ হবে। অতীতকে পড়ার মধ্য দিয়ে বোঝা যাবে ভবিষ্যতের পৃথিবীকে।
এই গবেষণার বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ২০১৩ সালের ২১ এপ্রিল প্রবন্ধ আকারে ছাপা হয়েছে প্রসেডিংস অব দ্য ন্যাশনাল অ্যাকাডেমি অব সায়েন্সেস সাময়িকীতে।
যেভাবে বিলুপ্ত হল ডাইনোসর
এমনকি একবার ভয়াবহ দাবানলের মুখোমুখি হয়েছিল এই মহাদেশটি। দাবানলে দাউদাউ করে জ্বলে, পুড়ে খাক হয়ে গিয়েছিল। সেই দাবানলের লেলিহান গ্রাস থেকে বাঁচার জন্য পালাতে চেয়েছিল ভয়ঙ্কর ডাইনোসররাও। পারেনি। অ্যান্টার্কটিকার দাবানল নির্বংশ করেছিল ডাইনোসরদের।
ঘটনাটি ঘটেছিল আজ থেকে সাড়ে সাত কোটি বছর আগে। পৃথিবীতে তখন চলছে ক্রেটাসিয়াস যুগ। যে যুগ পৃথিবীতে শুরু হয়েছিল আজ থেকে ১০ কোটি বছর আগে। শেষ হয়েছিল আজ থেকে ৬ কোটি ৬০ লক্ষ বছর আগে। জন্মের পর থেকে এখনও পর্যন্ত যে উষ্ণতম সময়গুলির মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে পৃথিবীকে, ক্রেটাসিয়াস যুগ ছিল তাদের অন্যতম। সেই সময় মাংসাশী ও নিরামিষাশী— দু’ধরনের ডাইনোসরই দাপিয়ে বেড়াত পৃথিবীতে।
সেই সর্বগ্রাসী দাবানলের পরিণতিতে যে অজস্র চারকোল-এ ভরে গিয়েছিল অ্যান্টার্কটিকা, তারই একটির খোঁজ মিলল অবশেষে। গবেষণাপত্রটি প্রকাশিত হয়েছে আন্তর্জাতিক বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘পোলার রিসার্চ’-এ।
গবেষণাপত্রটি জানিয়েছে, সেই উষ্ণতম ক্রেটাসিয়াস যুগেও তখনকার অ্যান্টার্কটিকা ভূখণ্ডের একাংশ ছিল কিছুটা নাতিশীতোষ্ণ। সেই জায়গাটার নাম ‘জেমস রস আইল্যান্ড’। এখন এই ভূখণ্ডটি রয়েছে দক্ষিণ আমেরিকার নীচে। সেই সময় এই দ্বীপটি-সহ গোটা অ্যান্টার্কটিকায় খুব ঘনঘনই হত ভয়াবহ অগ্ন্যুৎপাত। বিশাল বিশাল আগ্নেয়গিরি ছিল বলে।
ক্রেটাসিয়াস যুগে কিন্তু সেখানে ছিল মহারণ্য। যা ভরা ছিল খুব উঁচু উঁচু দেবদারু গাছে। সেখানে ছিল প্রচুর ফার্ন গাছ। ছিল অ্যাঞ্জিওস্পার্মের মতো উদ্ভিদ, যাতে নানা রকমের ফুলও ফোটে। গোটা জেমস রস আইল্যান্ডই ছিল ডাইনোসরদের প্রজনন ও বিচরণ ক্ষেত্র। কিন্তু বেশি দিন সেই জেমস রস আইল্যান্ড থাকতে পারেনি ‘স্বর্গরাজ্য’ হয়ে। দাবানলে একেবারে ছারখার হয়ে গিয়েছিল। সেই মহারণ্য পুরোপুরি জ্বলে-পুড়ে গিয়েই পরিণত হয়েছিল চারকোল-এ। তারই সামান্য কিছু অংশ খুঁজে পান গবেষকরা।
মূল গবেষক ব্রাজিলের ফেডেরাল ইউনিভার্সিটি পারনামবুকো ইন রেসিফ-এর প্যালিয়োবায়োলজিস্ট ফ্ল্যাভিয়ানা জর্জ দ্য লিমা একটি বিবৃতিতে বলেছেন, ‘‘এই আবিষ্কার ক্রেটাসিয়াস যুগে দাবানলের ভয়াবহতা সম্পর্কে আমাদের এত দিনের ধ্যানধারণাকে সজোরে ধাক্কা দিল। জানা গেল, ঘনঘনই হত সেই ভয়াবহ দাবানল। একটা সময় পর সেই ভয়াবহ দাবানল গোটা জেমস রস আইল্যান্ডের মহারণ্যকেই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিয়েছিল।’’
এসডব্লিউএসএস/১২৪৫
আপনার মতামত জানানঃ