প্রায় ৫,৫০০-এরও বেশি মহিলা গার্ড জার্মান কনসেন্ট্রেশন শিবিরে কাজ করেছিলেন বলে জানা গেছে। এই মহিলারা তাদের পুরুষ সমকক্ষদের মতো সমান হিংস্র ছিল এবং নিছক বর্বরতায় সক্ষম ছিল।
বন্দীদের যখন কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে আনা হতো, তখন থেকে শুরু হতো তাদের অনাহারী জীবনের সূত্রপাত। এরপর থেকে যতদিন তাদের ক্যাম্পগুলোতে থাকা লেগেছে, ততদিন এটাই ছিলো তাদের নিত্যসঙ্গী।
স্বাভাবিকভাবে বেঁচে থাকার জন্য একজন মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় যা যা থাকা প্রয়োজন, তার ছিটেফোঁটাও বরাদ্দ ছিলো না তাদের জন্য। বন্দীদের কাছ থেকে জানা যায় কাঠের মিহি গুড়া থেকে তৈরি পাউরুটি, রোগাক্রান্ত ঘোড়ার মাংস থেকে তৈরি সসেজ আর অত্যন্ত নিম্নমানের চা থাকতো অধিকাংশ বন্দীর খাদ্য তালিকায়।
খাদ্যের এ অপ্রতুলতা তাদের স্বভাবে এনে দিয়েছিল পরিবর্তন। ক্ষুধার জ্বালায় উত্তপ্ত পেটকে শান্ত করতে কখনো কখনো তারা নিজেদের মৃত সঙ্গীদের খাবার চুরি করে খেয়েছে। অবস্থা যখন আরো খারাপ হয়েছে, তখন ডাস্টবিনে ফেলে দেয়া পচা-বাসি খাবারও খেয়েছে অনেকে।
খাবারের এ কষ্ট আরো মারাত্মক হয়ে দেখা দিয়েছে নির্যাতনের সময়। যদি কোনো বন্দীর কোনো দোষ ধরা পড়তো, তাহলে শাস্তি হিসেবে কখনো কখনো তাকে খাদ্য-পানি ব্যতীত একটি ঘরে বন্দী করে রাখা হতো, যতদিন না তার মৃত্যু হচ্ছে ততদিন! এ নির্মমতা একদিকে যেমন বন্দীকে ধুঁকে ধুঁকে মারতো, তেমনি অন্যদের কাছেও বয়ে নিয়ে যেত ভয়ঙ্কর এক বার্তা।
ক্যাম্পগুলোর এক আতঙ্কের নাম ছিলো ‘ডার্ক সেল’। সেখানে থাকতো না কোনোরুপ আলো-বাতাসের চলাচল। একজন বন্দীকে সেখানে রেখে আসার পর খুব বেশিক্ষণ আর পৃথিবীর অক্সিজেন ব্যবহার করতে পারতো না সে। সেলের ভেতরে থাকা অক্সিজেন ফুরিয়ে গেলেই বেজে যেত তার বিদায় ঘন্টা।
কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পগুলোতে আনা বন্দীদের উপর নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলো সেখানকার চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা। এখন চলুন তেমন কিছু পরীক্ষা সম্পর্কেই সংক্ষেপে জানা যাক।
ডাকাউ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীদের উপর রক্ত জমাট বাঁধা সংক্রান্ত পরীক্ষা চালান ডাক্তার সিগমুন্ড র্যাশার। এজন্য গুলি করা হতো বন্দীর বুকে আর ঘাড়ে, জীবন্ত কেটে নেয়া হতো শরীরের নানা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ।
সালফোন্যামাইড পরীক্ষায় বন্দীর পায়ের কিছু অংশ কেটে সেখানে ব্যাক্টেরিয়ার মিশ্রণ ঘষে লাগানো হতো। বার্কন, ডাকাউ আর অসউইৎজ কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীদের উপর চালানো হতো নিম্ন তাপমাত্রা সংক্রান্ত বিভিন্ন পরীক্ষা।
এজন্য বন্দীদেরকে উলঙ্গ করে বরফপূর্ণ চৌবাচ্চা কিংবা হিমশীতল পানিতে ডুবিয়ে রাখা হতো। কখনো আবার বাইরের মারাত্মক ঠান্ডা আবহাওয়ায় সেই অবস্থাতেই ছেড়ে দেয়া হতো। অধিকাংশ বন্দীই এতে মারা যেত। যারা বেঁচে যেত, তারা হয়তো তাদের মৃত সঙ্গীদের সৌভাগ্যবান ভাবতো। কারণ সেই পরিস্থিতিতে কেবলই জ্ঞান হারিয়ে বেঁচে যাওয়াদের উপরই শুরু হতো আসল পরীক্ষা।
পুনরুজ্জীবিত করতে বন্দীদের মারাত্মক উত্তপ্ত সানল্যাম্পের নিচে রাখা হতো যাতে পুড়ে যেত তাদের চামড়া। শরীর উত্তপ্ত করতে তাদেরকে কোনো নারীর সাথে দৈহিক মিলনে বাধ্য করা হতো। এরপর তাদের গরম পানি পান করানো হতো কিংবা চুবানো হতো গরম পানিতে।
আগ্নেয় বোমার পরীক্ষায় বোমা তৈরিতে ব্যবহৃত ফসফরাস দিয়ে বন্দীর শরীর পুড়িয়ে দেয়া হতো। মানবদেহে বিভিন্ন বিষের কার্যকারিতা বোঝার জন্য বুখেনওয়াল্ড কনসেন্ট্রেশন ক্যাম্পের বন্দীদের খাবারে বিষ মেশানো হতো।
ম্যালেরিয়া এক্সপেরিমেন্টে সুস্থ বন্দীদের শরীরে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করানো হতো। এরপর নাৎসি বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবিত বিভিন্ন ওষুধ দিয়ে চলতো রোগীদের উপর নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা। অনেকেই এ সময় মারা যায়। যারা বেঁচে যায়, তাদেরও সহ্য করতে হয় নিদারুণ কষ্ট। অনেকে সেসব ওষুধের প্রভাবে চিরতরে পঙ্গুও হয়ে গিয়েছিলো।
উচ্চতা সংক্রান্ত পরীক্ষায় বন্দীদেরকে নিম্ন-চাপ সম্বলিত এমন একটি কক্ষে রাখা হতো যার অবস্থা হতো অনেকটা ২১,০০০ মিটার (৬৮,০০০ ফুট) উচ্চতার মতো। এ পরীক্ষার মাঝে দিয়ে যাওয়া অধিকাংশ বন্দীই মারা গিয়েছিলো। যারা বেঁচে ছিলো, তাদের শারীরিক অবস্থারও মারাত্মক অবনতি ঘটেছিলো।
এসডব্লিউএসএস/২০০৫
আপনার মতামত জানানঃ