দীর্ঘদিন ধরেই ঋণগ্রস্ত আর্জেন্টিনা খবরের শিরোনাম। আর্জেন্টিনার মতো ঋণগ্রস্ত দেশগুলোর জন্য ‘মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে এসেছে করোনা মহামারি। ঋণের ব্যাধিতে জড়িয়ে আর্জেন্টিনা যে ধুঁকছে, তা দেশটির অর্থমন্ত্রী মার্টিন গুজম্যানের কথায় স্পষ্ট। সম্প্রতি গণমাধ্যমে ঋণে জর্জরিত দেশটির অর্থনীতি নিয়ে কথা বলেছেন তিনি।
মার্টিন গুজম্যান লিখেছেন, মহামারি যখন আর্জেন্টিনায় আঘাত হানল তখন তার হাতে কোনো পুঁজি-অর্থ নেই। এ পরিস্থিতিতে প্রথমবারের মতো আমরা একটি সার্বভৌম ঋণ পুনর্গঠন ব্যবস্থা গ্রহণ করলাম, যার মাঝে সামূহিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা ২০১৪ সালে নতুন বাজার আদর্শ হিসেবে স্বীকৃত।
তিনি জানান, পেছন ফিরে ২০১৬ সালের দিকে তাকালে দেখা যাবে আর্জেন্টিনা বহুদিন ধরে ‘ভালচা ফান্ড’-এর সাথে দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ের পর আন্তর্জাতিক ঋণবাজারে প্রবেশ করতে পেরেছিল। যেসব ঋণদাতা ঋণগ্রস্তদের গ্রাস করতে চায় তারা পুনর্গঠন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে পুনর্গঠন পক্ষের ঋণদাতাদের বিরুদ্ধে মামলা করে দেয়। আর্জেন্টিনার এ অবস্থাই সার্বভৌম ঋণ ব্যবস্থা পুনর্গঠনে আন্তর্জাতিক পরিকল্পনার খুঁতগুলো তুলে ধরে সমাধানে সহায়তা করে। আন্তর্জাতিক পুঁজিবাজার সমিতির অনুমোদন অনুসারে ২০১৪ সালের শেষের দিকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ একটি পদ্ধতি সূচনা করে, যার মাধ্যমে এ ব্যবস্থার একটি বিধিবদ্ধ কাঠামো তৈরি হয়। করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কমিশন এভাবে সংখ্যাগুরুর সিদ্ধান্ত দ্বারা সংখ্যালঘুদের বেঁধে ফেলতে পারবে।
এ বিধি অনুসারে আর্জেন্টিনা ৪২ বিলিয়ন ডলার ঋণ নিয়েছিল। কিন্তু ২০১৮ সালে সম্ভাবনা অনুসারে বাজারের প্রত্যাশার ধরন বদলে গেল, যা মুদ্রা সংকটকে গভীর ও দীর্ঘকালের জন্য উসকে দিয়ে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সম্পর্কিত ঋণ ব্যবস্থায় অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আর্জেন্টিনা এ সময় আন্তর্জাতিক আর্থিক তহবিলের দ্বারস্থ হলে তারা ৫৭ বিলিয়ন ডলারের ঋণ দেয়। হয়তো তারা ভেবেছিল দেশটি সাময়িক মুদ্রা সংকটে পড়েছে।
তার মতে, অন্যদের কাছে অবশ্য এটা পরিষ্কার ছিল যে আর্জেন্টিনা অর্থনৈতিক দিক থেকে সামষ্টিকভাবে একটি সংগতিহীন ও ঋণগ্রস্ত অবস্থা মোকাবেলা করছে। পরবর্তী সময়ে বর্তমান সরকার—যেখানে আমি অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছি—২০১৯ সালের ডিসেম্বরে দায়িত্ব নেয়, আমরা সাথে সাথেই সার্বভৌম ঋণ ব্যবস্থা গ্রহণ করে ঋণগ্রস্ততা সহনীয় পর্যায়ে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করি এবং ধীরে ধীরে অর্থনৈতিক অবস্থা একটি সহনীয় পর্যায়ে পুনরায় নিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছি। পরিশেষে জাতীয় কংগ্রেস এ সরকারকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ব্যবহার করে ঋণ পরিশোধের অনুমতি দেয়, যাতে পুনর্গঠন পদ্ধতির মাঝে কোনো বিশৃঙ্খলা না আসে।
এ প্রক্রিয়ার অন্যতম প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে আইএমএফের সঙ্গে কাজ করে ঋণ সহনীয়তা নির্ধারণ করা হয়। অর্থাৎ অতিরিক্ত খরচ বাদ দিয়ে দেশটি কী পরিমাণ ঋণ নিয়ে দারিদ্র্য ও বেকার সমস্যা মোকাবেলা করবে, তা নির্দেশ করা।
মার্টিন আরো বলেন, এরপর আমরা মহামারি-পূর্ব মূল্যায়ন অনুসারে দেশের ঋণদাতাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলাম। কিন্তু অল্পদিনের মধ্যেই আর্জেন্টিনায় কভিড-১৯ আঘাত হানে। ফলে অতিদ্রুত কিছু সংহতি স্থাপনের পাশাপাশি দীর্ঘমেয়াদি কৌশলী অভিযোজন প্রয়োজন হয়। সন্ধি স্থাপনের আলোচনাটির প্রায় পুরোটাই ‘জুম’-এর মাধ্যমে করা হয়। বেশ কয়েক মাস আলোচনার পর আর্জেন্টিনা এবং এর ঋণদাতাদের মাঝে একটি চুক্তি হয়।
দরকষাকষির পর আসা চুক্তি অনুসারে সুদহার ৭ থেকে ৩ শতাংশে কমানোর কারণে আগামী দশকের মধ্যে আর্জেন্টিনা প্রায় ৩৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড় পাবে। উপরন্তু সামষ্টিক কর্মপরিকল্পনা কার্যক্রমের কারণে পুনর্বিন্যস্ত ঋণের অংশ হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা হার ৯৩ দশমিক ৫ থেকে ৯৯ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে যায়।
তার মতে, এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরবর্তী সময়ে সার্বভৌম ঋণ পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার জন্য বেশকিছু করণীয় উঠে এসেছে। প্রথমত, আইএমএফের ভূমিকা—তা ইতিবাচক হবে, না নেতিবাচক—গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্লেষকদের দেয়া একটি অতিপরিচিত তত্ত্ব অনুসারে চার দশক ধরে এ তহবিল প্রায়ই তাদের অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, এবার তাদের সাহায্য ঋণ স্থিতিশীলতা রক্ষায় অবদান রেখছে।
দ্বিতীয়ত, বর্ধিত করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কমিশন ঘুরে দাঁড়াতে যথেষ্ট সহায়ক হয়েছে, কিন্তু তা পর্যাপ্ত ছিল না। ঋণদাতা ও গ্রহীতাদের মধ্যে দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্যের কারণে এ সমাধান প্রক্রিয়া অর্থনৈতিক ও সামাজিক সংকটের মুখে পড়তে পারে। করপোরেট অ্যাফেয়ার্স কমিশনের পরিপূরক হিসেবে আমরা আন্তর্জাতিক সার্বভৌম ঋণ প্রকল্পকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করতে পারি (মহামারির প্রেক্ষাপটে জি-২ এ ধরনের একটি কর্মপরিকল্পনা নিয়েছে)।
তৃতীয়ত, উন্নত কাঠামোও একটি দেশের রাজনৈতিক অর্থনীতির উন্নতি ঘটাতে সক্ষম হয় না। বেসরকারি ঋণদাতারা ক্ষমতাধর এবং তারা সহজেই নিজেদের স্বার্থরক্ষা ও লাভের জন্য তদবির বা চাপ প্রয়োগ করতে পারে। তাদের এ চেষ্টা কেবল সরকার নয়, বরং আইএমএফ কর্তৃক গৃহীত পদক্ষেপও শ্লথ করে দিতে সক্ষম।
এ হিসেবে আর্জেন্টিনার এ পুনর্গঠন বিস্তৃত বৈশ্বিক সাহায্যকে লাভবান করেছে। আইএমএফের সাথে ১৫০ জন আন্তর্জাতিক একাডেমিক ব্যক্তিত্ব (কয়েকজন নোবেল বিজয়ীসহ), জি-২০-এর সদস্যরা এবং পোপ ফ্রান্সিসও যুক্ত হয়েছেন। এমনকি এখানে বিস্তৃত অভ্যন্তরীণ সাহায্যও যুক্ত হয়েছিল, যেমন জাতীয় কংগ্রেস খুব দ্রুত দুটো আইন পাস করেছে, যা অত্যন্ত জরুরি ছিল।
মার্টিন আশঙ্কা করেন, অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় এ মহামারি আরো বেশকিছু দেশকে ঋণের ভারে জর্জরিত করবে, যার সমাধান করে অর্থনীতিকে সুরক্ষিত রাখতে হবে। কিন্তু অনেক দেশই আর্জেন্টাইন সরকারের মতো দরকষাকষি বা আলোচনার জন্য সুষম প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্র প্রস্তুতে সক্ষম হবে না। ক্ষমতার অপ্রতিসাম্যের কারণে এসব দেশকে ঋণদাতাদের দেয়া অপ্রীতিকর শর্ত মেনে নিতে হবে। নিজেদের জনগণের স্বার্থের জন্য তারা নমনীয় অবস্থান গ্রহণে বাধ্য হবে। তাদের একটি সুযোগ দেয়ার জন্য আমাদের একটি আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা বা সংস্থা তৈরি করা প্রয়োজন, যা এ অর্থনৈতিক ভারসাম্যহীনতা—যা কখনো কখনো ঋণগ্রস্ত দেশকে দুর্দশায় ফেলে—প্রশমনে সমর্থ হবে।
/এসডাব্লিউ/বিবি/নাসি/১২৩৫
আপনার মতামত জানানঃ