প্রাণীজগতের সবচেয়ে বড় পর্ব আর্থ্রোপোডার মাছি বর্গের অন্তর্ভুক্ত প্রাণী হচ্ছে মশা। মশা, যাকে ইংরেজিতে বলা হয়-Mosquito, শব্দটি এসেছে স্প্যানিশ শব্দ mosca এবং diminutive নামক দুটি শব্দ থেকে, যেগুলোর অর্থ হল যথাক্রমে ক্ষুদ্র এবং মাছি। অর্থাৎ Mosquito শব্দটির অর্থ হল- ছোট মাছি বা উড়তে সক্ষম এমন ক্ষুদ্র পতঙ্গ।
মশাজাতীয় পতঙ্গের প্রথম ফসিল পাওয়া যায় কানাডায় এক টুকরো অ্যাম্বরের (অ্যাম্বর হল একধরনের ছোট গাছ, যার গা থেকে একধরনের কেলাসিত আঠালো পদার্থ নিঃসৃত হয় এবং এই কেলাসিত আঠালো পদার্থ লক্ষ লক্ষ বছর অক্ষত থাকে) ভেতর।
অ্যাম্বরের ওই টুকরোর ভেতর আটকে মরে যাবার পর সেই মশাজাতীয় পতঙ্গটি অক্ষত থেকে যায় প্রায় ৭৯ মিলিয়ন বা ৭.৯ কোটি বছর। বার্মিজ এক টুকরো অ্যাম্বরে পাওয়া একটি প্রাগৈতিহাসিক মশার ফসিলের বয়স বিজ্ঞানীরা হিসেব কষে দেখেছেন প্রায় ৯০-১০০ মিলিয়ন বছরের মতো।
তবে গবেষকদের মতে, মশার পূর্বপুরুষদের উৎপত্তি হয়তো আরও আগে হয়েছিল। ফসিল ছাড়াই বিজ্ঞানীরা অনুমান করেছেন, আজ থেকে প্রায় ২২৬ মিলিয়ন বছর আগে মশার পূর্বপুরুষদের উদ্ভব ঘটেছিল।
পৃথিবীতে এখন পর্যন্ত প্রায় ৩,৫০০ প্রজাতির মশা আবিষ্কৃত হয়েছে, যাদের দেহের মূল গঠন মোটামুটি একই হলেও স্বভাব ও বৈশিষ্ট্যে এদের ভিন্নতা রয়েছে। তবে বেশিরভাগ প্রজাতির মশারাই কিন্তু প্রাণিদের রক্ত পান করে।
স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে কেবল এরা যে মানুষের রক্ত পান করে এমন নয়। কিছু প্রজাতি স্তন্যপায়ী প্রাণীর রক্ত, কিছু প্রজাতি সরীসৃপ কিংবা উভচর, কিছু প্রজাতি আবার পাখির রক্ত পান করে। এমনকি মাছের রক্ত পান করে বেঁচে থাকে এমন প্রজাতির মশাও আছে!
তবে জেনে রাখা উচিত, রক্তচোষা মশাদের মধ্যে শুধুমাত্র স্ত্রী-মশারাই জীবের শরীর থেকে রক্ত পান করে। এর কারণ হচ্ছে, ডিম পাড়া কিংবা বংশবিস্তারের জন্য স্ত্রী মশাদের বাড়তি প্রোটিনের প্রয়োজন হয়, যা মানুষ কিংবা অন্যান্য প্রাণীর রক্তে থাকে। যে সমস্ত প্রজাতিরা রক্ত পান করে না, এরা আবার উদ্ভিদের ওপর নির্ভরশীল। এরা ফুলের রস, মধু কিংবা গাছের কাণ্ড থেকে বিভিন্ন প্রকারের রস শোষণের মাধ্যমে নিজেদের খাদ্য সরবরাহ করে।
অনেকগুলো পা বা উপাঙ্গবিশিষ্ট মশাদের মাথায় থাকে একটি লম্বা শুঁড়, যা দিয়ে এরা প্রাণীর শরীর থেকে রক্ত শোষণ করে। মাথায় থাকে একজোড়া এন্টেনা, যা সংবেদী তথ্যের রিসেপ্টর হিসেবে কাজ করে। পুরুষ-মশাদের মাথা স্ত্রী-মশাদের থেকে অধিক লোমশ হয়। মশারা বংশবিস্তারের জন্য বেছে নেয় বদ্ধ পানি, ড্রেন, ডোবা, হ্রদ, জলাশয়, পানির কাছাকাছি জায়গা এবং জলজ উদ্ভিদকে।
একটি স্ত্রী-মশা তার জীবনচক্রে প্রায় ১০০ থেকে ২০০টি পর্যন্ত ডিম পাড়তে পারে। এসমস্ত জায়গায় ডিম পাড়ার পর ডিম থেকে পূর্ণাঙ্গ মশায় পরিণত হতে প্রায় ৪০ দিনের মত সময় অতিবাহিত হয়। একটি পুরুষ মশার আয়ু সাধারণত ৫-৭ দিন পর্যন্ত হয়ে থাকে। বিপরীতে একটি স্ত্রী মশা ডিম দেবার পরও প্রায় এক মাসের মতো বাঁচতে পারে। তবে বেশীরভাগ স্ত্রী-মশারাই এক থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত বাঁচে।
সব মশার কামড়ে যে মানুষ রোগে আক্রান্ত হবে এমন নয়। যে সমস্ত মশা রোগজীবাণু সংক্রামক, এদের কামড়েই মানুষ রোগে আক্রান্ত হয়। যেমন-এডিস মশা। জীবাণুবাহী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া, ডেঙ্গু, চিকুনগুনিয়া, ফাইলেরিয়া, জিকা ভাইরাস, পীতজ্বর ইত্যাদি রোগ হতে পারে।
সাধারণত মশার কামড়ে ত্বকে লাল দাগ দেখা দেয় এবং চুলকানির উদ্রেক হয়। এর কারণ হচ্ছে, মশা যখন ত্বকে শুঁড় ঢুকায় তখন শুঁড়ের মধ্যে লেগে থাকা লালা ত্বকে লেগে যায়, যা চুলকানির উদ্রেক ঘটায়।
সব মশারা কিন্তু জীবাণু বহন করে না। কিছু পরিচিত জীবাণুবাহী মশা প্রায়ই মানুষের দেহে রোগের সংক্রমণ ঘটায়। যেমন- এডিস মশার কামড়ে ডেঙ্গু জ্বর হয়। কিন্তু হঠাৎ নতুন করে মশার দ্বারা কোনও রোগের আবির্ভাব ঘটে থাকে কেন?
জীবাণুবাহী বেশীরভাগ মশার আবাসস্থলই হচ্ছে বনজঙ্গল। এদের দেহে অনেক অজানা ভাইরাস থাকে। এ ধরণের মশাদের বলা হয় চলক মশা। যদি কোনও কারণে এদের আবাসস্থল ধ্বংস হয়ে যায়, মানে বনজঙ্গল, ঝোপঝাড় কেটে উজাড় করে ফেলা হয়, তখন এইসব চলক মশারা এসে হাজির হয় লোকালয়ে। এদের কামড়েই মানুষ অজানা ভাইরাসঘটিত রোগে আক্রান্ত হয় এবং একজন রোগী থেকে আরেকজনের দেহে রোগটি সংক্রমিত হতে থাকে।
এসডব্লিউএসএস/১৪২৫
আপনার মতামত জানানঃ