যমুনা নদীকে ছোট করতে চায় পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো)। আপাতত দেশের দুটি স্থানে পরীক্ষামূলকভাবে গ্রোয়েন বাঁধ দিয়ে নদী ছোট করা হবে।
যমুনা নদীকে ছোট করার পেছনে যুক্তি তুলে ধরে পাউবো বলছে, প্রতিবছর বর্ষা মৌসুমে যমুনা নদী চওড়া হচ্ছে। নদী কোথাও কোথাও ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার প্রশস্ত হচ্ছে। এতে নদীভাঙন বাড়ছে।
পাউবো মনে করে, এত চওড়া নদীর প্রয়োজন নেই। এটি সংকুচিত করে সাড়ে ৬ কিলোমিটারে নামিয়ে আনা হবে। যমুনা নদী ছোট করলে দুটি সুফল পাওয়ার কথা বলছে পাউবো। একটি হলো, নদীর ভাঙন কমবে। অন্যটি বিপুল পরিমাণে ভূমি পুনরুদ্ধার করা যাবে।
তবে বিস্তারিত সমীক্ষা না করে গ্রোয়েন প্রযুক্তির প্রস্তাবে আপত্তি জানিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন। নদী সংকুচিত করার বিরোধিতা করেছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাতও।
নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নদীকে ছোট করার চিন্তা নির্বুদ্ধিতার। যাঁদের মাথা থেকে এসব চিন্তা আসে, তাঁদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে। কোনো যুক্তিতেই যমুনাকে সংকুচিত করা যাবে না। এটি বিশ্বে এক অনন্য নদী। এ নদীকে নিয়ে যেকোনো ধরনের পরীক্ষা যেন সাবধানে করা হয়।
২০১৪ সালে বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে নৌচুক্তি (প্রটোকল অন ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রানজিট অ্যান্ড ট্রেড) সই হয়েছিল, সেখানে যমুনাকে ভারতের ট্রানজিটের কাজে ব্যবহার করার কথা বলা হয়েছে। সিরাজগঞ্জের বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে কুড়িগ্রামের দইখাওয়া নৌপথ ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার করার কথা।
যমুনাকে ছোট করার বিষয় সামনে এসেছে পাউবোর নেওয়া একটি প্রকল্পকে কেন্দ্র করে। ‘যমুনা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা’ শিরোনামের প্রকল্পটি বাস্তবায়নে খরচ হবে ১ হাজার ১০৯ কোটি টাকা। এর মধ্যে বিশ্বব্যাংকের ঋণ ৮৯৬ কোটি টাকা। বাকি ২১৩ কোটি টাকা সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে জোগান দেবে। এ বছর অনুমোদন মিললে ২০২৬ সালে প্রকল্পের কাজ শেষ করতে চায় পাউবো।
কী আছে পরিকল্পনায়?
যমুনা নদী প্রতি বছর বড় হয়ে যাচ্ছে। বর্ষার সময় নদীটি ১৫ থেকে ২০ কিলোমিটার হয়ে যায়। এত বড় নদীর প্রয়োজন নেই। তাই এটির প্রশস্ততা সাড়ে ৬ কিলোমিটার সংকুচিত করা হবে। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এবং প্রাকৃতিক পানি প্রবাহের অন্যতম উৎস যমুনাকে ছোট করার এমন আইডিয়া এসেছে খোদ পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের কর্তাদের মাথা থেকে। এজন্য তারা ১১শ কোটি টাকার একটি প্রকল্পও প্রণয়ন করেছেন।
অর্থনৈতিক সংকটের কারণে যখন বারবার ব্যয় সংকোচনের তাগিদ দেওয়া হচ্ছে, সে সময় মন্ত্রণালয়টি এমন প্রকল্প নিয়েছে কোনো ধরনের গবেষণা ছাড়াই। বিশেষজ্ঞরা বিরল এ প্রকল্পকে অবাস্তব বলছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নদী ছোট করতে যে ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়েছে, তা বাংলাদেশ তো বটেই—পৃথিবীর কোনো দেশেই আগে প্রয়োগের নজির নেই। এ কারণে প্রকল্পটি নিয়ে খোদ সরকারের ভেতরেই প্রশ্ন উঠেছে। সংশ্লিষ্টদের একটি পক্ষ বলছে, কোনো ধরনের জরিপ ছাড়া ঋণের টাকায় এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নের কোনো যৌক্তিকতা নেই।
প্রকল্পের বিরোধিতা করে নদী বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধরনের প্রকল্প নেওয়া ঠিক হবে না, এতে নদীর গতিপথ পরিবর্তনের আশঙ্কা রয়েছে। বাড়তে পারে বন্যা প্লাবনের ঝুঁকি। পাশাপাশি এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দেশের অন্যতম স্থাপনা পদ্মা সেতু এবং যমুনা সেতু ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
যমুনাকে ঘিরে পরিকল্পনার বিষয়ে জানতে চাইলে পাউবোর তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী রবীন কুমার বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, বর্ষা মৌসুমে কোথাও কোথাও নদীর প্রশস্ততা ১০ থেকে ১৫ কিলোমিটার হয়ে যায়। নদীভাঙন রোধে গ্রোয়েন প্রযুক্তি ব্যবহার করতে চান তাঁরা। গাইবান্ধার ফুলছড়ি ও টাঙ্গাইলের কালিহাতীতে পরীক্ষামূলকভাবে এ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হবে।
নদী ছোট করার বিষয়ে প্রশ্নের জবাবে এই কর্মকর্তা বলেন, শতবর্ষী পরিকল্পনায় (ডেলটা প্ল্যান) যমুনাকে সাড়ে ছয় কিলোমিটারে নামিয়ে আনার কথা বলা আছে। এটি নতুন কোনো বিষয় নয়। নদী ছোট করতে কত সময় লাগবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আপাতত পরীক্ষামূলকভাবে দুটি জায়গায় করা হবে। এটি সফল হলে পরে অন্য জায়গায় করা হবে।
যমুনাকে ছোট করার পরিকল্পনাকে কীভাবে দেখছেন জানতে চাইলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক আইনুন নিশাত প্রথম আলোকে বলেন, ‘যমুনার মতো নদী পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এটি একটি অনন্য নদী। এই নদী নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও পানি উন্নয়ন বোর্ড কী নিয়ে সামনে এগোচ্ছে, তার বিস্তারিত আমার জানা নেই। তবে এই নদীকে অন্য কোনো নদীর সঙ্গে তুলনা করা ঠিক হবে না। এই নদীকে নিয়ে নড়াচড়া করার আগে অবশ্যই সংশ্লিষ্টদের সাবধান থাকা উচিত।’
প্রকল্পে অস্বাভাবিক খরচ
যমুনা নদীর টেকসই ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের বিভিন্ন খাতে অস্বাভাবিক খরচের প্রস্তাব করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এটি পর্যালোচনা করে পরিকল্পনা কমিশন বলেছে, এমন অনেক বিষয় দরকার নেই; সেটিও প্রকল্পে ঢোকানো হয়েছে। সেগুলো বাদ দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে কমিশন।
যেমন ফরিদপুরে একটি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট থাকার পরও দেশে আরেকটি আন্তর্জাতিক নদী গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রস্তাব করেছে পাউবো। এটি নির্মাণে খরচ ধরা হয়েছে ৩১ কোটি টাকা। কেন আরেকটি নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট বানানোর প্রয়োজন হলো, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কমিশন। পরে তা বাদ দিতে বলা হয়।
প্রকল্পের আওতায় যমুনা নদীতে প্রতি কিলোমিটার গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণে খরচ ধরা হয় ৭৫ কোটি টাকা। অথচ সমজাতীয় একটি প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি গ্রোয়েন বাঁধ নির্মাণে খরচ হয় ২৮ কোটি টাকা। দুটি কাজে খরচের বিশাল পার্থক্য নিয়ে প্রশ্ন তোলে পরিকল্পনা কমিশন। এখানেও ব্যয় যৌক্তিক পর্যায়ে নামিয়ে আনার নির্দেশ দেওয়া হয়।
এই প্রকল্পের আওতায় শুধু পরামর্শক ফি বাবদ ২৬৯ কোটি টাকা রাখা হয়েছে। পাউবোর এত বিশেষজ্ঞ থাকার পরও কেন পরামর্শকের পেছনে এত টাকা খরচ করতে হবে, তা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কমিশন। এ খাতেও খরচ কমানোর নির্দেশ দেওয়া হয় পানি উন্নয়ন বোর্ডকে। এসব বিষয় সংশোধন করে প্রকল্পটি পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে বলে জানা গেছে।
এসব বিষয়ে রবীন কুমার বিশ্বাস বলেন, ‘এ ধরনের কারিগরি কাজে পরামর্শকের প্রয়োজন হয়। তবু যেহেতু পরিকল্পনা কমিশন থেকে খরচ কমাতে বলা হয়েছে, আমরা তা নিয়ে কাজ করছি। আর আন্তর্জাতিক নদী গবেষণা ইনস্টিটিউট নির্মাণের বিষয়টি বাদ দেওয়া হয়েছে।’
এদিকে যমুনা নদীকে সংকুচিত করা কিছুতেই ঠিক হবে না বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক সাইফুল ইসলাম। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এতে বর্ষা মৌসুমে পানির প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হবে। ভূগর্ভস্থ পানি, কৃষি, মৎস্য সম্পদ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে।
এসডব্লিউএসএস/১৫৩০
আপনার মতামত জানানঃ