গণমাধ্যম কী এবং কেন?- এই প্রশ্নের অনেকগুলো উত্তর আমাদের সামনে আছে। তবে যে উত্তরটা সবথেকে বেশি গুরুত্ব রাখে, তা হল সরকারের সমালোচনা। দেশের প্রকৃত অবস্থার চিত্রায়ন। সারাদেশে উন্নয়নের যে জোয়ার বয়ে চলেছে, সেই জোয়ারের পানিতে ভিজছে দেশের অধিকাংশ গণমাধ্যমই। তবে এই স্রোতের বিপরীতেও হাঁটতে দেখা যাচ্ছে কিছু কিছু সাংবাদিকদের। আর এমনই একজন শামসুজ্জামান শামস।
গোটা দেশেই দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে দিশেহারা নিম্নমধ্যবিত্ত মানুষেরা। রমজান মাসে বাজারে বাড়তি দামের চাপে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ নিজেদের সেহেরী আর ইফতারির তালিকাকে করে নিয়েছে সংক্ষিপ্ত। প্রতিটা চায়ের দোকানে এখন একটাই আলোচনার বিষয়। আর তা হল দ্রব্যমূল্য। প্রতিটা পত্রিকায় প্রথম পাতায় ছাপা হচ্ছে দ্রব্যমূল্য সম্পর্কিত খবর।
এরমধ্যেই এসে যায় স্বাধীনতা দিবস। আর স্বাধীনতার এতগুলো বছর পরেও আমরা কি প্রকৃত অর্থেই অর্থনৈতিকভাবে স্বাধীন?- অতি সাধারণ এই প্রশ্নেই নড়ে গেছে রাজার মুকুট। টলে গেছে রানীর সিংহাসন।
স্বাধীনতা দিবসে দ্রব্যমূল্য নিয়ে করা একটি সংবাদের জের ধরে বাংলাদেশের প্রথম আলো পত্রিকার একজন সাংবাদিককে মধ্যরাতে ধরে নিয়ে গেছে সাদা পোশাকের একদল ব্যক্তি। তারা নিজেদের সিআইডি বলে পরিচয় দিয়েছে।
বুধবার দুপুরে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, মামলার ভিত্তিতে প্রথম আলোর সাংবাদিককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সাংবাদিক শামসুজ্জামান শামস দৈনিক প্রথম আলোর সাভারে নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবে কাজ করেন।
যা ঘটেছে
প্রথম আলোর নির্বাহী সম্পাদক সাজ্জাদ শরীফ এই ঘটনা নিশ্চিত করে বলেছেন, ‘আমাদের সাভার প্রতিনিধিকে গতকাল মধ্যরাতে সিআইডি পরিচয় দিয়ে সাদা পোশাকে ধরে নিয়ে গেছে। এরপর থেকে এখনো আমরা তার কোন খোঁজ পাইনি। এ বিষয়ে আমরা আইনানুগভাবে যেসব পদক্ষেপ নেয়ার সেভাবেই পদক্ষেপ নেবো।’
তবে সিআইডি বা স্থানীয় পুলিশের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এই আটকের বিষয়টি তাদের জানা নেই।
সেই সময় জাহাঙ্গীরনগরের আমবাগান এলাকায় শামসের বাসায় ছিলেন ঢাকার আরেকটি পত্রিকার আরেকজন সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম সাব্বির।
তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেছেন, রাত চারটার দিকে তিনটি মাইক্রোবাস নিয়ে সাদা পোশাকের একদল লোক বাসা থেকে শামসুজ্জামান শামসকে ধরে নিয়ে যায়।
তারা তার ল্যাপটপ, দুটো ফোন, পেন ড্রাইভ, কম্পিউটারের হার্ডডিস্কও নিয়ে যায়। সেই সময় সাব্বিরকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তারা নিজেদের সিআইডির টিম বলে পরিচয় দিয়ে জানিয়েছে তারা ঢাকা থেকে এসেছে।
প্রথম দফায় তাকে নিয়ে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে এই দলটি আবার বাসায় ফিরে আসে। এরপর তারা আবার বাসায় এসে একটি জব্দ তালিকায় সাব্বির এবং বাড়িওয়ালার স্বাক্ষর নিয়ে যায়।
এরপর থেকে শামসুজ্জামান শামসের মোবাইল ফোন বন্ধ রয়েছে। তবে দ্বিতীয়বার বাসায় যাওয়ার সময় আশুলিয়া থানার একজন উপ-পরিদর্শক এই টিমের সঙ্গে ছিলেন বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ভাষ্য
দুপুরে সচিবালয়ে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, ”আইন তার নিজস্ব গতিতে চলে। কেউ যদি সংক্ষুব্ধ হয়, মামলা করে বিচার চায়, থানায় গিয়ে মামলা করে, তাহলে সেই অনুযায়ী পুলিশকে ব্যবস্থা নিতেই হয়। আমি যতটুকু জানি, তার বিরুদ্ধে একটা মামলা রুজু হয়েছে।”
তবে কে বা কারা কীসের মামলা করেছে, সেটি সুনিশ্চিতভভাবে জানাতে আরেকটু সময় লাগবে বলে তিনি জানান। সাভার বা আশুলিয়া থানায় খোঁজ নিয়ে এই বিষয়ে আটক বা মামলার কোন তথ্য পাওয়া যায়নি।
মামলা হলেও রাতের আঁধারে এভাবে কোন ব্যক্তিকে বাসা থেকে তুলে আনা যায় কি না– এমন প্রশ্নে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, “আমার কাছে সব টুকরো টুকরো খবর আসছে। পুরো বিষয়টা বলতে হলে আমাকে আর একটু সময় দিতে হবে।”
তিনি বলেন, “প্রথম কথা হল সাংবাদিক সাহেব যে উদ্ধৃতিটা ব্যবহার করেছেন, তা সঠিক ছিল না। আপনারাই তা প্রচার করেছেন। আপনারা সাংবাদিকরাই ৭১ টিভির মাধ্যমে সংক্ষুব্ধ হয়ে তা প্রচার করেছেন যে এই সংবাদটি ভিত্তিহীন, মিথ্যা এবং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। এটা ৭১ টিভিতে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।”
যে কারণে আটক
সাংবাদিক আরিফুল ইসলাম সাব্বির বিবিসিকে বলেন, আটকের সময় সাদা পোশাকের ব্যক্তিরা বলেছেন, রাষ্ট্রবিরোধী মাছ-ভাতের সংবাদের কারণে তাকে আটক করা হয়েছে।
গত ২৬শে মার্চ দৈনিক প্রথম আলোয় প্রকাশিত একটি সংবাদে একজন দিনমজুরের বক্তব্য প্রকাশিত হয়েছিল, যেখানে উদ্বৃত করা হয়, ‘পেটে ভাত না জুটলে স্বাধীনতা দিয়া কী করুম। বাজারে গেলে ঘাম ছুটে যায়। আমাগো মাছ, মাংস আর চাইলের স্বাধীনতা লাগব’। সেই সংবাদের সঙ্গে একটি শিশুর ছবি ছিল, যে গ্রিলের ফাঁকা দিয়ে স্মৃতিসৌধের দিকে তাকিয়ে রয়েছে।
এ নিয়ে সামাজিক মাধ্যমে আলোচনা শুরু হলে পরবর্তীতে প্রথম আলো ওই খবরটি সংশোধন করে। প্রথম আলোর পক্ষ থেকে একটি বিবৃতিতে বলা হয়, প্রথমে প্রকাশিত এই প্রতিবেদনের শিরোনাম এবং ব্যবহার করা ছবির মধ্যে অসঙ্গতি থাকায় ছবিটি তুলে নেয়া হয়েছে এবং শিরোনাম সংশোধন করা হয়েছে।
যা বলছে পুলিশ
সিআইডির ঢাকা বিভাগের উপ-মহাপরিদর্শক মোঃ ইমাম হোসেন বলেছেন, সিআইডির ঢাকা বিভাগের কেউ শামসুজ্জামানকে আটক করতে যায়নি। তাকে আটক করা হলে আমার জানা থাকতো।
আর আশুলিয়া থানার ওসি এস এম কামরুজ্জামান এবং সাভার থানার ওসি দীপক চন্দ্র সাহা বলেছেন, এই বিষয়ে তাদের কিছু জানা নেই। তারা কাউকে আটক করেননি।
যা বলছেন ওবায়দুল কাদের
সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর নিজস্ব প্রতিবেদক শামসুজ্জামানকে তার বাসা থেকে তুলে নিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানেন না বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
তবে যে প্রতিবেদনের কারণে তাকে আজ বুধবার ভোর চারটায় বাসা থেকে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেই প্রতিবেদন ‘পলিটিক্যালি মোটিভেটেড’ বলে উল্লেখ করেছেন তিনি।
আজ দুপুরে সচিবালয়ে আয়োজিত সমসাময়িক ইস্যুতে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে ওবায়দুল কাদের এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, নবীনগরে একটা বাচ্চার হাতে ১০ টাকা দিয়ে স্বাধীনতা নিয়ে তার মন্তব্য নেওয়া হয়েছে। ছেলের নাম সবুজ। তাকে বানানো হয়েছে জাকির হোসেন।
ছেলে স্কুলের ছাত্র, তাকে বানানো হয়েছে দিনমজুর। এটি কোন সাংবাদিকতা, এই প্রশ্ন তোলেন ওবায়দুল কাদের।
‘সাংবাদিক শামসুজ্জামানের অপরাধটা কোথায়’
সাভারে কর্মরত প্রথম আলোর সাংবাদিক শামসুজ্জামানকে তুলে নেওয়ার ঘটনার নিন্দা জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, সাংবাদিক শামসুজ্জামান একজন মানুষের উক্তি, সত্য ঘটনা তুলে ধরেছেন। এটি করে তিনি কী অপরাধটা করেছেন, সেটা বোধগম্য নয়।
আজ বুধবার দুপুরে ঢাকার গুলশানে দলের চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে মির্জা ফখরুল এ কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘এটা ভয়াবহ ঘটনা। ওই সাংবাদিক কী অপরাধটা করেছেন, আমি তো বুঝলাম না! সত্য যে ঘটনা, সেটা সে তুলে ধরেছে। একজন মানুষের যে উক্তি, সে উক্তিটা তুলে ধরেছে।’
বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘অপরাধটা কী, ২৬ মার্চের দিনেই এটা করাটা? তার মানে স্বাধীনতাকে অপমান করা হয়েছে, মানহানি করা হয়েছে। তো একটা মানুষ যদি স্বাধীনতার দিনে ক্ষুধার্ত বোধ করে, সে যদি বঞ্চিত বোধ করে এবং সে যদি ওই কমেন্টটা দেয় যে দেশ স্বাধীন হয়ে আমার কী লাভ হলো। অপরাধটা কোথায়?’
এসডব্লিউএসএস/১৮৫৫
আপনার মতামত জানানঃ