আওয়ামী লীগের সাম্প্রতিক সময়টা ঠিক ভালো যাচ্ছে না আমেরিকার সাথে। র্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা ও নির্বাচন নিয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের অযাচিত নাক গলানো ছিল আওয়ামী আওয়ামী লীগের দুর্বলতার উপর বিষফোঁড়ার মত। তবে এবার দলটির গলায় খড়গ হয়ে নেমে এসেছে এক মার্কিন প্রতিবেদন। চলুন জেনে নেয়া যাক সেই মার্কিন প্রতিবেদন সম্পর্কে।
গত সোমবার বাংলাদেশ সময় রাতে প্রকাশিত মার্কিন মানবাধিকার বিষয়ক রিপোর্ট এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। রাজনীতির আলোচনার নয়া খোরাক। প্রতিবেদনের বাংলাদেশ অংশে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, নির্যাতন, কারাগারে নির্যাতন, নির্বিচারে গ্রেপ্তার বা আটক, রাজনৈতিক বন্দি, কোনো ব্যক্তির অপরাধের জন্য পরিবারের সদস্যদের শাস্তির মুখে পড়ার কথা বলা হয়েছে। সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে সহিংসতা বা সহিংসতার হুমকি, সাংবাদিকদের অযৌক্তিকভাবে গ্রেপ্তার, মতপ্রকাশ সীমিত করার জন্য ফৌজদারি মানহানি আইন কার্যকর, স্বাধীন মতপ্রকাশ এবং মিডিয়ার ওপর বিধিনিষেধের বিষয়ও উঠে এসেছে প্রতিবেদনে।
ইন্টারনেট স্বাধীনতার ওপর নিষেধাজ্ঞা, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের মতো বিষয়গুলোও স্থান পেয়েছে স্টেট ডিপার্টমেন্টের রিপোর্টে। রিপোর্ট প্রকাশের পর রাজনৈতিক দলগুলো থেকে এ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রতিক্রিয়া এসেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা রিপোর্টকে পক্ষপাতদুষ্ট বলে মন্তব্য করেছেন।
তারা বলছেন, মার্কিন প্রতিবেদন একপেশে। যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উল্টো প্রশ্ন তুলছেন আওয়ামী লীগ নেতারা।
তবে বিরোধী দলগুলো বলছে যুক্তরাষ্ট্রের এই প্রতিবেদনই প্রমাণ করে দেশে মানবাধিকার বলতে কিছু নেই। নির্বাচন নিয়ে যে আপত্তি তারা জানিয়ে আসছেন মার্কিন রিপোর্টে তা আবারো প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। রিপোর্টে যেসব বিষয় তুলে ধরা হয়েছে তা দেশের এবং দেশের মানুষের জন্য লজ্জার। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নির্বাচনের আগে মার্কিন এই রিপোর্ট রাজনীতির মাঠে নয়া খোরাক যোগাবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে সঠিক তথ্য তুলে ধরা হয়েছে এবং তা দেশের জন্য লজ্জার বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপি’র মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেছেন, মার্কিন মানবাধিকার নিয়ে যে প্রতিবেদন দিয়েছে তাতে লজ্জিত। দেশে এখন গণতন্ত্র, মানবাধিকার, বাকস্বাধীনতা নেই। রিপোর্ট প্রকাশের পরে আওয়ামী লীগের নেতারা নিজেদের মতো বানিয়ে কথা বলছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিজেরা গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই বিশ্বে নেতৃত্ব দিচ্ছে।
উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের বিগত জাতীয় নির্বাচন নিয়ে বড় প্রশ্ন তোলা হয়েছে। বলা হয়েছে, ওই নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু ছিল না। ওই রিপোর্টে বলা হয়, অনেক মানুষকে রাজনৈতিক বন্দি ও আটক হিসেবে রাখা হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীদের গ্রেপ্তার ও বিচার করা হয়েছে।
এই রিপোর্টে আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের বিচারকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে উল্লেখ করা হয়। রিপোর্টে নিরাপত্তা রক্ষাকারী বাহিনীর আইন ও নিয়ম লঙ্ঘনের অভিযোগও আনা হয়। রিপোর্টে বলা হয়, মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিশ্বাসযোগ্য অনেক ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আছে বিচার বহিভূত হত্যাকাণ্ড, জোরপূর্বক গুম, নির্যাতন ও নিষ্ঠুরতা। মুক্ত মতপ্রকাশের ক্ষেত্রে বাধা রয়েছে বলে উল্লেখ করা হয় মার্কিন প্রতিবেদনে।
ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের পাশাপাশি কোনো ব্যক্তি অপরাধ করলে তার পরিবারের সদস্যদের শাস্তি দেয়া হয় বলে উল্লেখ করা হয় প্রতিবেদনে। রিপোর্টে জোরপূর্বক গুম, অপহরণের ঘটনা তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, এসব গুম, অপহরণের শিকার বেশির ভাগই বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মী ও ভিন্ন মতাবলম্বী। এসব অপরাধ প্রতিরোধে, তদন্তে এবং শাস্তি নিশ্চিত করতে সীমিত প্রচেষ্টা নিয়েছে সরকার।
মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বিষয়ে বলা হয়েছে, ঘন ঘন এই অধিকারে হস্তক্ষেপ করে সরকার। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, মানবাধিকার বিষয়ক গ্রুপ এবং মিডিয়ার রিপোর্টে অব্যাহত গুম এবং অপহরণের তথ্য উঠে এসেছে। নিরাপত্তা রক্ষাকারীরা এসব সংঘটিত করেছেন বলে অভিযোগ আছে।
রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, যেসব মিডিয়া সরকারের সমালোচনা করেছে, তাদেরকে চাপ দেয়া হয়েছে। মুক্তভাবে অথবা বিধিনিষেধ না মেনে কোনো নিরপেক্ষ মিডিয়া কাজ করতে পারে না। ইন্টারনেট ফ্রিডম বা ইন্টারনেটে স্বাধীনতা ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ওই রিপোর্টে বলেছে, ইন্টারনেট সুবিধায় বিধিনিষেধ দিয়েছে সরকার বা এই সুবিধায় বিঘ্ন ঘটিয়েছে। বহু ঘটনায় তারা অনলাইন কন্টেন্ট সেন্সর করেছে।
ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট অনেক নেটওয়ার্ক এবং ভিওআইপি ফোন নিষিদ্ধ করা হয়েছে আইন দিয়ে। আইনগত যথাযথ কর্তৃত্ব না থাকা সত্ত্বেও অনলাইনে বেসরকারি পর্যায়ে যোগাযোগ মনিটরিং করছে সরকার। বিরোধী দলগুলো যেসব শহরে র্যালি ডেকেছিল সেখানে সরকার অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন সময়ে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ করে দিয়েছিল অথবা গতি কমিয়ে দিয়েছিল।
রিপোর্টে বলা হয়, শান্তিপূর্ণ সমাবেশের অধিকার সংবিধান দিলেও বিরোধী দলীয় নেতাকর্মীরা পুরো বছরেই বহুবিধ বিধিনিষেধের মুখোমুখি হয়েছেন। বিরোধী বিএনপিকে নিয়মিতভাবে সমাবেশের অধিকার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে অথবা কর্তৃপক্ষ ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা ভীতি প্রদর্শন করেছে।
এসডব্লিউএসএস/১৩৩০
আপনার মতামত জানানঃ