যে কোনো সুস্থ মস্তিস্কের মানুষ একমত হবেন যে প্রতিটি বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড দেশের আইনের শাসন এবং স্বাধীন বিচার ব্যবস্থার প্রতি আঘাত। সংসদ সদস্যরা যেমন আইন প্রণয়ন করবেন, তেমনি সে আইন যথাযথভাবে প্রয়োগ হচ্ছে কিনা তার নজরদারি করবেন। প্রয়োজনে বিদ্যমান আইন সংশোধন করবেন অথবা নতুন আইন তৈরি করবেন। মোদ্দা কথা আইনের শাসন সমুন্নত রাখার পক্ষে তারা জোরালো ভূমিকা পালন করবেন। কিন্তু আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) ২০২০ সালে ৩০০ বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছে বলে জানিয়েছে। ৩১ ডিসেম্বর ২০২০, সকালে মানবাধিকার পরিস্থিতি-২০২০ নিয়ে আসক আয়োজিত ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে উপস্থাপিত প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানানো হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২০ সালে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ ১৮৮ জন এবং মাদকবিরোধী অভিযানে ১১২ জন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া বছরজুড়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হেফাজতে নিহত হয়েছেন ১১ জন। গ্রেপ্তারের আগে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নির্যাতনে মারা গেছেন ১৩ জন। অসুস্থতাসহ নানা কারণে দেশের কারাগারগুলোতে মারা গেছেন ৭৫ জন। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) গুলি ও নির্যাতনে নিহত হয়েছেন ৪৯ বাংলাদেশি।
প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ২০২০ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, মহামারির মধ্যে অর্থনীতি, সামাজিক, সাংস্কৃতিক অধিকারের ক্ষেত্রে অগ্রগতির ধারা অব্যাহত রয়েছে। তবে এর মাঝেও চিকিৎসা খাতে চরম অনিয়ম, ত্রুটিপূর্ণ করোনা পরীক্ষা, অক্সিজেন সিলিন্ডারসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রীর চরম মূল্য ভুগিয়েছে মানুষকে।
আইন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকদের মনে প্রশ্ন, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায় বাহিনীগুলোর নাকি সরকারের নীতির? বিশ্লেষকদের অনেকে মনে করেন, আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী কোন বাহিনীই বিচার বহির্ভূত হতাকাণ্ডের অভিযোগ থেকে মুক্ত নয়। কিন্তু মূলত সরকারের সদিচ্ছার অভাবে এসব ঘটনা বন্ধ হচ্ছে না। তারা মনে করেন, সরকারগুলো এই ইস্যুতে রাজনৈতিক নানা বক্তব্য দিলেও বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধে কখনও কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি। তারা মনে করেন, সব সময়ই লক্ষ্য করা গেছে যে একই ঘটনা ঘটছে। রাষ্ট্রের তরফ থেকে দৃশ্যমান কোন পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না। প্রচ্ছন্নভাবে রাজনৈতিক সমর্থনের কারণেই কিন্তু বাহিনীগুলো এসব ঘটনা ঘটিয়ে পার পেয়ে যাচ্ছে।
গণতন্ত্র দূর্বল হলে এবং জবাবদিহিতা না থাকলে বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধ করা যায় না বলে মনে করেন তারা। সরকারের ভিতরে জবাবদিহিতার অভাব আছে। সরকারের জবাবদিহিতার অভাব মানে বাহিনীগুলোরও জবাবদিহিতার অভাব আছে। সরকারের জবাবদিহিতা না থাকলে কোন ক্ষেত্রেই জবাবদিহিতা থাকে না। এবং সেটাকেই মুল সমস্যা বলে মনে করেন তারা।
রাজনৈতিক দিক থেকে বা সরকারের পক্ষ থেকে প্রচ্ছন্ন সমর্থন থাকার কারণে বাহিনীগুলোতে সাহস যোগায় এ ধরণের অপরাধ করার ক্ষেত্রে। বিশ্লেষকরা এমনটা মনে করেন। বাহিনীগুলো অনেক সময় বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের প্রতিযোগীতায় নামে। অনেক সময় বাহিনীর অনেক সদস্য চাঁদাবাজি বা অর্থ আদায়ের জন্য বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বা ক্রসফায়ারকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে। সেখানে বিশ্লেষক এবং মানবাধিকার কর্মীরা সরকারের সদিচ্ছার অভাবকেই বড় ঘাটতি হিসাবে দেখেন।
তারা মনে করেন, বিচার পাওয়ার অধিকার যে কোনো নাগরিকের মৌলিক অধিকার, সংবিধান স্বীকৃত অধিকার। কোনো অপরাধীকে বিচার পাওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হলে দেশের সংবিধান এবং বিচার ব্যবস্থা গুরুত্বহীন হয়ে পড়ে। মাথা ব্যথার জন্য মাথা কেটে ফেলা যেমন কোনো সমাধান নয়, তেমনি অপরাধ দমনে বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কোনো সমাধান হতে পারে না বলে মনে করেন তারা।
এসডাব্লিউ/এমএন/কেএইচ/১৬৫৫
আপনার মতামত জানানঃ