২০১৪ সালে একটি একতরফা বিতর্কিত নির্বাচনের পর ২০১৮ সালে আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচন। ওই নির্বাচনে যে চিত্র দেখা গেছে, সেটি বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে যে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে তাতে কোন সন্দেহ নেই। নির্বাচনের পর ব্রিটেনের ইকনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট যে রিপোর্ট প্রকাশ করে, সেখানে গণতান্ত্রিক দেশের তালিকায় ছিল না বাংলাদেশ।
১৯৯১ সাল থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত নির্দলীয় সরকারের অধীনে যেসব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে সেখানে পরাজিত দল বরাবরই অভিযোগ তুললেও সাধারণভাবে সেসব নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সবার কাছে।
কিন্তু ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র উল্টো পথে হাঁটা শুরু করেছে কি না সে প্রশ্ন উঠতে শুরু করে। সর্বশেষ নির্বাচনের পর এ প্রশ্ন আরো জোরালো রূপ নিয়েছে। এরপর থেকেই নির্বাচনে আস্থা হারিয়েছে সাধারণ মানুষ। আর তাই প্রতিনিয়ত কমেছে ভোটারদের উপস্থিতি।
ভোটারদের অনুপস্থিতি সরকারকে এই শক্তিশালী বার্তা-ই জানান দিচ্ছে যে, নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি দেশটির নাগরিকদের আস্থা কতোটা কম। গত বৃহস্পতিবার ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টারের একটি সম্পাদকীয়কে উদ্ধৃত করে গত শুক্রবার সিঙ্গাপুর ভিত্তিক ইংরেজি দৈনিক স্ট্রেইট টাইমস এমন খবর প্রকাশ করেছে।
ডেইলি স্টারের সম্পাদকীয়টি হুবহু এবং সম্পূর্ণ প্রকাশ করেছে স্ট্রেইট টাইমস। যাতে বলা হয়, আগামী সাধারণ নির্বাচনকে অন্তর্ভুক্তিমূলক করার জন্য সরকার সর্বাত্মক চেষ্টা চালাচ্ছে বলে জানা গেছে। আমাদের নড়বড়ে গণতন্ত্রকে একটি বড় সংকটে পড়া থেকে বাঁচানোর জন্য এটি অপরিহার্য।
গত এক দশকেরও বেশি সময় ধরে আমাদের জাতিকে জর্জরিত করার চরম মাত্রার প্রতিকূল রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক ঘাটতি আমাদের মূল প্রতিষ্ঠানগুলোর ভিত্তিকে ক্ষয় করেছে। যার ফলে আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের অবনতি হয়েছে, একটি রাজনৈতিকভাবে পরিপক্ক সমাজের বিকাশ হওয়া থেকে আমরা পিছিয়ে গেছি।
আর সে কারণেই, সর্বোপরি, আমরা সুষ্ঠু ও অন্তর্ভুক্তিমূলক নির্বাচন চাই। আমরা বিশ্বাস করি যে, আমাদের জনসংখ্যার সিংহভাগ মানুষও সেটাই চায়।
বিগত দুটি সাধারণ নির্বাচনের এবং বেশ কয়েকটি স্থানীয় পর্যায়ের নির্বাচনের পর নির্বাচনের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে ভোটারদের মধ্যে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে মন্তব্য করে ওই সম্পাদকীয়তে লেখা হয়, সাধারণ জনগণ এবং বিরোধী দল উভয়কেই বোঝানোর দায়িত্ব সরকারের ওপর বর্তায় যে তারা সত্যিকারের ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করার বিষয়ে আন্তরিক।
দুর্ভাগ্যবশত, গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দলের (বিএনপি) কর্মসূচিগুলোর বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ যে ‘লাইনচ্যুত কৌশল’ (মাঝে মাঝে রাষ্ট্রযন্ত্রের সহায়তায়) ব্যবহার করেছে তাতে ক্ষমতাসীন দলের আগের আশ্বাসের প্রতি আস্থা জাগিয়ে তোলা ব্যর্থ হয়েছে।
সম্প্রতি শেষ হওয়া ছয়টি সংসদীয় আসনের উপ-নির্বাচন প্রসঙ্গে সম্পাদকীয়তে লেখা হয়: নির্বাচনগুলো যদিও তুলনামূলকভাবে শান্তিপূর্ণ ছিল কিন্তু সেগুলোতে কাঙ্খিত অনেক কিছুই বাকি ছিল। ভোটার উপস্থিতি কম ছিল, প্রচারণার সময় ব্যাপক ভয়ভীতি দেখানো ও হয়রানি করা হয়েছে, একজন প্রতিযোগীর রহস্যজনক অন্তর্ধান (এবং পুনঃআবির্ভাব) ঘটেছিল।
বর্তমান নির্বাচন কমিশন (বিশেষত তার দুর্বল পূর্বসূরির তুলনায়) শুরুতে কয়েকটি পদক্ষেপের মাধ্যমে কিছু প্রতিশ্রুতি দেখালেও তারা সেই গতি ধরে রাখতে সক্ষম হয়নি এবং মনে হয় ‘পছন্দ না হলেও আদেশ অনুযায়ী কাজ করার’ পুরনো ধারাতেই ফিরে এসেছে।
ভোটারদের অনুপস্থিতি সরকারকে এই শক্তিশালী বার্তা দিচ্ছে যে আমাদের নির্বাচনী ব্যবস্থার প্রতি নাগরিকদের আস্থা কতোটা কম। বাস্তবতা এই যে, প্রকৃত নির্বাচনী সংস্কারই আগামী সাধারণ নির্বাচনের আগে ভোটারদের আগ্রহকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে এবং নির্বাচনে সকল রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাতে পারে।
অন্যদিকে বিএনপিকেও নিজেদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করাতে ক্ষমতাসীন দল ও নির্বাচন কমিশনের সাথে একটি গ্রহণযোগ্য সমঝোতায় পৌঁছুতে হবে। সরকারের পক্ষ থেকে সত্যিকারের যে কোনো উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বিএনপিকেও সময়ের সাথে সাথে বর্তমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধানের জন্য সমঝোতায় পৌঁছার সমান আন্তরিকতা নিয়ে কাজ করতে হবে।
বিশেষ করে ২০১৪ সালের সাধারণ নির্বাচন বয়কটের ফলে দল এবং দেশের সাধারণভাবে কী ক্ষতি হয়েছে তার আলোকে বিএনপির উচিত আরেকটি নির্বাচন (যা তারা কয়েকবার করার হুমকি দিয়েছে) বর্জনের ভালো-মন্দ কী হতে পারে তা বিশ্লেষণ করা।
সবশেষে বিগত দুটি সাধারণ নির্বাচনের তিক্ত অভিজ্ঞতা স্মরণ করে সম্পাদকীয়তে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে: বাংলাদেশ যেমন ২০১৪ সালের মতো আরেকটি বয়কট করা নির্বাচনের পুনরাবৃত্তি সইতে পারে নে, তেমনি ২০১৯ সালের মতো আরেকটি বিতর্কিত নির্বাচনের ভারও বহন করতে পারে না।
ওই দুই নির্বাচনের কারণে আমাদের গণতন্ত্রের অনেক কিছু হারিয়েছে। আমরা আশা করি, জনগণকে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন দেওয়ার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে নির্বাচন কমিশন প্রয়োজনীয় সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করবে- যার একটি পূর্বশর্ত হচ্ছে নির্বাচনে প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা।
এসডব্লিউএসএস/১৪৫০
আপনার মতামত জানানঃ