পৃথিবীর বয়স প্রায় ৪৫৪ কোটি বছর। আর সম্ভবত ৪২৮ কোটি বছর আগে এই পৃথিবীতে এসেছিল সরল প্রাণের চিহ্ন। অথচ পৃথিবীতে মানুষ এসেছে এই সেদিন। মানুষের সর্বপ্রাচীন ফসিল পাওয়া গেছে আফ্রিকার মরক্কোতে। যা মাত্র ৩ লক্ষ ৩০ হাজার বছর পুরনো। এই সময়ের ব্যবধানেই প্রমাণ করে দেয় যে এই পৃথিবী আসলে মানুষের জন্য সৃষ্টি হয়নি। মানুষ মূলত বাইপ্রোডাক্ট। চলুন জানা যাক, বিস্তারিত।
‘বিগ ব্যাং’ থেকে মহাবিশ্বের সূচনা; মহাবিশ্বের সব কিছুর উৎপত্তি। এই যেমন আজ থেকে ৪৫৪ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবী গ্রহের আকার ধারণ করে যার ভর ছিল বর্তমান ভরের ৮০%। এ অবস্থায় পৃথিবী ছিল সম্পূর্ণ অর্ধ-তরল গলিত লাভার একটি গোলাকার খণ্ড। তখন পৃথিবীর ঘূর্ণন ছিল বর্তমানের চেয়ে অনেক বেশি। তখন পৃথিবীর নিজ অক্ষের উপর একবার ঘুরতে সময় লাগত মাত্র ৬ ঘণ্টা।
দিন অতিবাহিত হতে থাকলো, পৃথিবী সূর্যের চারদিকে একটি নির্দিষ্ট কক্ষপথ নির্ধারণ করে নিলো। গলিত পৃথিবী ঠাণ্ডা হতে থাকলো। হালকা পদার্থ তরলের উপরে উঠে এসে ভূপৃষ্ঠের আবরণের তৈরি করতে থাকল আর ভারী পদার্থ ডুবে গিয়ে পৃথিবীর কেন্দ্রে ভারী লোহা ও নিকেলের মিশ্রিত একটি ‘কোর’ তৈরি করলো। এই ধাতব কেন্দ্র থেকে একটি চৌম্বক ক্ষেত্রের সৃষ্টি হল যা সূর্য থেকে ধেয়ে আশা আয়নিত কণা থেকে পৃথিবীর জীবজগৎকে এখনো রক্ষা করে চলে প্রতিনিয়ত। তখনো পৃথিবীর উপগ্রহ চাঁদ তৈরি হয়নি।
৪৫৩ কোটি বছর পূর্বে প্রায় মঙ্গল গ্রহের সমান একটি বস্তুখণ্ড ঘণ্টায় প্রায় ২৫ হাজার কিঃমিঃ বেগে এসে পৃথিবীতে আছড়ে পড়ে। এই সংঘর্ষের ফলে আগন্তুকের কিছু অংশ পৃথিবীতে থেকে যায় আর বাকি অংশ ছড়িয়ে পরে মহাকাশে। ছড়িয়ে পরা এই বস্তুর কিছু অংশ মহাকর্ষের টানে একত্রিত হয়ে পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরতে শুরু করে। সৃষ্টি হয় পৃথিবীর একমাত্র উপগ্রহ চাঁদ।
চাঁদ সৃষ্টি হওয়া পৃথিবীর জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। এই সংঘর্ষের ফলেই পৃথিবীর উলম্ব অক্ষ খানিকটা বেঁকে যায়। যার ফলে আজ আমরা পাচ্ছি ঋতুবৈচিত্র্য। যেটি প্রাণের উদ্ভব ও জীবন ধারণের জন্য প্রয়োজনীয়। পৃথিবীর আহ্নিক গতি হ্রাস প্রাপ্ত হয়ে ৬ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টায় আসতে চাঁদের আকর্ষণের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এছাড়া বর্তমানেও পৃথিবীর জলবায়ুর উপর ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করে চাঁদ। তার চাক্ষুষ উদাহরণ জোয়ার-ভাটা।
৪৫০ কোটি বছর পূর্ব থেকে ৩৮০ কোটি বছর পূর্ব পর্যন্ত পৃথিবী প্রাণের উদ্ভব ঘটার জন্য পর্যাপ্ত স্থিতিশীল অবস্থায় আসে। পৃথিবীর কক্ষপথ সুনির্দিষ্ট হয়, পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি স্থিতিশীল হয়, পৃথিবীর চারদিকে চাঁদের গতি নির্দিষ্ট হারে এসে পৌঁছায়, চাঁদ অর্ধ-তরল লাভা থেকে ঠাণ্ডা হয়ে কঠিন অবস্থায় আসে।
৪৫০ কোটি বছর পূর্বে, পৃথিবী কিছুটা শীতল হয়ে ভূপৃষ্ঠ কঠিন আকার ধারণ করে। তবে তখনো ভূপৃষ্ঠে চলছে প্রচণ্ড অগ্ন্যুৎপাত। সেসময় পৃথিবীতে তাপমাত্রা এতই বেশি ছিল যে কোন তরল পানি ছিল না, ছিল ‘অত্যন্ত উত্তপ্ত বাষ্প’।
ধীরে ধীরে পৃথিবী ঠাণ্ডা হতে থাকে, জলীয়বাষ্পের দরুণ বৃষ্টিপাত হয়। প্রথমে খুবই অল্প পরিমাণে ও পরে বেশি। ভূপৃষ্ঠ পানি তরল অবস্থায় থাকার মত তাপমাত্রায় আসে। বৃষ্টিপাতের ফলে সৃষ্টি হয় জলাধার এবং সমুদ্র।
আজ থেকে প্রায় ৩৮০ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে প্রথম স্থায়ী সমুদ্রের সৃষ্টি হয়। স্থায়ী সমুদ্র সৃষ্টির প্রায় ৭ লক্ষ বছর পর সমুদ্রের তলদেশে কয়েকটি প্রাথমিক উপাদান; বিগ ব্যাং এর পর সৃষ্ট প্রথম মৌল হাইড্রোজেন, নক্ষত্রে সৃষ্ট নাইট্রোজেন, কার্বন, এবং অক্সিজেন মিলে তৈরি করে পৃথিবীতে প্রাণের সূচনা। DNA, যে সর্পিলাকার আণুবীক্ষণিক গঠনে লুকিয়ে আছে প্রাণের রহস্য। এটি ছিল পৃথিবীর সর্বপ্রথম মহাবিপ্লব। এরপর DNA থেকে কালক্রমে তৈরি হল প্রথম অণুজীব, ব্যাকটেরিয়া। যেটি শুধু তখন নয় এখনো জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। মানুষের দেহ সারা পৃথিবীর জনসংখ্যার চেয়ে বেশি সংখ্যক ব্যাকটেরিয়ার একটা ‘চিড়িয়াখানা’।
এরপর প্রায় একশ কোটি বছর পৃথিবী শুধুমাত্র নানা ধরনের অণুজীবের দখলে ছিল। প্রায় ২৫০ কোটি বছর পূর্বে কিছু ‘বিশেষ’ ব্যাকটেরিয়া সূর্য থেকে আসা শক্তি ব্যবহার করে জীবন ধারণ করা শুরু করলো। জীবন ধারণের এ প্রক্রিয়ায় তারা পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান ও গুরুত্বপূর্ণ বর্জ্য পদার্থটি উৎপাদন ও নিঃসরণ শুরু করলো, যার নাম ‘অক্সিজেন’। সুতরাং আমরা এখন যে অক্সিজেনের সাহায্যে বেঁচে আছি তা আমাদের আদি-প্রাণের উচ্ছিষ্ট ছাড়া কিছুই নয়।
সেসময় সমুদ্রের পানি ছিলো প্রচুর লৌহ উপাদানে পরিপূর্ণ। ব্যাকটেরিয়া নির্গত অক্সিজেন লৌহ উপাদানের সাথে বিক্রিয়া করে তৈরি করে ভারি ধাতব-অক্সাইড যা থিতিয়ে জমা হয় সমুদ্র তলদেশে। শত কোটি বছর ধরে জমতে থাকা অক্সাইডের স্তর তৈরি করে লোহার বিশাল সংগ্রহশালা যা সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে উত্থিত হয়ে এখন আমাদের কাছে “লোহার খনি” নামে পরিচিত। আপনার সুঁই থেকে শুরু করে জুতার পেরেক পর্যন্ত যত স্থানে লোহা রয়েছে তার সবার প্রাথমিক অবস্থান ও রূপান্তর একই।
পানিতে থাকা সকল অসম্পৃক্ত লৌহ উপাদান যখন অক্সাইডে পরিণত হলো, তখন অক্সিজেন মিশতে থাকলো সমুদ্রের পানিতে। সমুদ্রের পানি অক্সিজেনে পূর্ণ হবার পর অতিরিক্ত অক্সিজেন উঠে এলো সমুদ্র পৃষ্ঠ ছেড়ে বায়ুমণ্ডলে, বায়ুমণ্ডল পূর্ণ হলো পর্যাপ্ত অক্সিজেনে।
এরপর ঘটলো প্রাণের গুরুত্বপূর্ণ ও বৃহৎ একটি উত্থান। কিছু ব্যাকটেরিয়া অক্সিজেন থেকে শক্তি সংগ্রহ করে বেঁচে থাকার কায়দা রপ্ত করলো, যাতে পূর্বের যে কোনো পদ্ধতি থেকে প্রায় ২০ গুন দক্ষতার সাথে শক্তির ব্যবহার করা গেলো। অক্সিজেন থেকে শক্তি সংগ্রহ করে বেঁচে থাকার ফলে তাদের জৈবিক পরিবর্তন পরিবর্ধন ঘটতে থাকলো আরও দ্রুত। একাধিক অণুজীব মিলে তৈরি করতে থাকলো আরও ক্রমান্বয়ে জটিল থেকে জটিলতর জৈবিক প্রাণ।
পরবর্তী দু’শ কোটি বছর এভাবেই চলল প্রাণের জটিল থেকে জটিলতর, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর, আর এককোষী জীব থেকে বহুকোষী জীবে রূপান্তর হবার প্রক্রিয়া। সমুদ্রের পানিতে বাড়তে থাকলো জীব বৈচিত্র্য। সৃষ্টি হল অসংখ্য ভিন্ন ভিন্ন প্রজাতির বহুকোষী উদ্ভিদ ও প্রাণী। এই সময়ের সর্বশেষ তিন কোটি বছরে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে বিবর্তিত হয়েছে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক জলজ প্রাণী।
বর্তমান সময় থেকে প্রায় ৫০ কোটি বছর পূর্বে সমুদ্রে বিবর্তিত হয়ে সৃষ্টি হলো প্রথম কাঁটাযুক্ত দেহাভ্যন্তর বিশিষ্ট মাছ। এদেরকেই বলা যায় আমাদের সর্বপ্রথম ‘পূর্বপুরুষ’ যাদের মধ্যে প্রথমবারের মত ছিল বর্তমান জীবের মত দেহাংশ এবং দাঁতবিশিষ্ট চোয়াল সহ মুখ। প্রাণী ও উদ্ভিদ বিবর্তিত হতে থাকলো আরো নতুন বৈশিষ্ট্য সম্পন্ন ও জটিল ক্ষমতা সম্পন্ন জীবে।
এর মধ্যেই পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলস্থ অক্সিজেনের একটা অংশ বায়ুমণ্ডলের উপরিভাগে তৈরি করল ‘ওজন’ গ্যাসের আস্তরণ যা তখন থেকে এখন পর্যন্ত এমনকি ভবিষ্যতেও রক্ষা করে চলবে প্রাণের গতিধারাকে; মহাজাগতিক ও সূর্য থেকে আগত ক্ষতিকর রশ্মি ও বিকিরণের প্রভাব থেকে।
‘ওজন’ স্তর তৈরির পূর্ব পর্যন্ত প্রাণের অস্তিত্ব ছিলো কেবল সমুদ্রের তলদেশের পানিতে। এরপর তা স্থলভূমিতে উঠে আসার পরিবেশ পেল। প্রথমে পানির নিচে থাকা উদ্ভিদরা বিবর্তিত হয়ে স্থলে বাঁচার উপযুক্ত হয়ে উঠে আসলো স্থলজ পৃথিবীতে। শিকড়ের সাহায্যে পানি আর সূর্যালোকের শক্তিতে বেঁচে থাকার শক্তি সংগ্রহ করতে থাকলো। প্রথমবারের মত উদ্ভিদের প্রাণের স্পন্দনে স্পন্দিত হলো পৃথিবী।
প্রায় চল্লিশ কোটি বছর পূর্বে জলজ প্রাণীর একটি অংশ বিবর্তিত হয়ে উভচর প্রাণীর সৃষ্টি করলো যা পানি ছেড়ে উঠে এলো মাটিতে। সূচনা হলো সমগ্র পৃথিবীতে চলমান প্রাণের বিচরণ।
প্রাথমিক উভচরদের, বর্তমান ব্যাঙের ডিমের মত পানিতে ডিম ছেড়ে বংশবৃদ্ধি করতে হতো। তা না হলে সে ডিম স্থলে শুকিয়ে নষ্ট হয়ে যেতো। এটি ছিল তাদের সমুদ্র ছেড়েও দূরে না যেতে পারার একটি কারণ।
বিবর্তন এ সমস্যার সমাধান এনে দিল একদল উভচরের জন্য। তারা সম্পূর্ণ নতুন গঠনের ডিম দিতে শুরু করল যেটা শক্ত খোলসে আবৃত কিন্তু তার ভেতরে প্রাণের জন্য প্রয়োজনীয় ‘সমুদ্রের আর্দ্রতা’। এই বিবর্তন এধরনের উভচর থেকে কালক্রমে বিবর্তিত হল সরীসৃপ।
প্রায় ২৫ কোটি বছর পূর্বে পৃথিবীতে বয়ে যায় এক ভয়াবহ দুর্যোগ। পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আগ্নেয়গিরির উদগীরণ শুরু হয় দানবীয় আকারে। বায়ুমণ্ডলের অনেকাংশ ভরে ওঠে জীবনের জন্য ক্ষতিকর কার্বন-ডাই-অক্সাইডে। পৃথিবীর প্রায় ৭০ শতাংশের অধিক প্রজাতির জীব মারা যায় এই দুর্যোগে। একে বলা হয় ‘পার্মিয়ন গণবিলুপ্তি’।
এরপর আরো কিছু গণবিলুপ্তি সংগঠিত হয়েছে পৃথিবীতে যাতে প্রচুর প্রজাতির প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে নতুন প্রজাতির প্রাণীর বিকাশ ঘটে। পার্মিয়ন গণবিলুপ্তির পর আরো কয়েকটি গণবিলুপ্তি কাটিয়ে উদ্ভব হয় ডাইনোসরদের। উৎপত্তির পর প্রায় ১৬ কোটি বছর পৃথিবী শাসন করে নানা জাতি-প্রজাতিতে বিভক্ত ডাইনোসরের দল। এসময় পৃথিবীতে প্রথম সৃষ্টি হয় কঠিন কাণ্ডবিশিষ্ট উদ্ভিদের বনভূমি। এসময় চাঁদ সৃষ্টির প্রায় ৪২৫ কোটি বছর পর চাঁদের আকর্ষণ পৃথিবীর আহ্নিক গতি নির্দিষ্ট করে প্রায় ২৪ ঘণ্টার দিবারাত্রি নির্ধারণ করে।
ডাইনোসর যুগের শুরুতে পৃথিবীর স্থলভাগ একত্রিত অবস্থায় ছিলো। ডাইনোসর যুগের মাঝামাঝি অংশে এসে স্থলভাগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যেতে থাকলো। স্থলভাগ সমুদ্র দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে কয়েকটি সুবৃহৎ দ্বীপের মত অংশ বিভক্ত হলো। আফ্রিকা থেকে দক্ষিণ আমেরিকার অংশ আলাদা হলো। মাঝখানে চলে এলো আটলান্টিক মহাসাগর।এভাবেই চলল ডাইনোসর যুগের ১৬ কোটি বছর। ডাইনোসরের যুগে ডাইনোসরের প্রতিপত্তির দাপটে অন্য কোনো বড় প্রাণীর বিকাশ হতে না পারলেও সৃষ্টি হলো নানা প্রজাতির ছোট ছোট স্তন্যপায়ী জীব। এগুলো আকারে ডাইনোসরের তুলনায় ইঁদুরের মত ছোট হওয়াতে ডাইনোসরের প্রভাব এদের উপর তেমন একটা পড়েনি। এতে এরা বিভিন্ন প্রজাতিতে বিভক্ত হয়ে বিবর্তিত হয়।
প্রায় সাড়ে ছয় কোটি বছর পূর্বে, প্রায় ৬ মাইল চওড়া একটি গ্রহাণুর সাথে পৃথিবীর সংঘর্ষ ঘটে। এতে সৃষ্ট ধুলোর মেঘ সারা পৃথিবীর আকাশে ছড়িয়ে পড়ে। সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা সৃষ্টি হয়। পৃথিবীতে থাকা ২৩ কেজির চেয়ে বেশি ওজনের সকল জীবের বিলুপ্তি ঘটে। ডাইনোসরদের ১৬ কোটি বছরের শাসন শেষ হয় পৃথিবীর বুকে।
পৃথিবী থেকে ডাইনোসর বিলুপ্ত হবার পর ছোট স্তন্যপায়ীরা বড় আকারে বিবর্তিত হতে বেশি সময় নেয়নি। ৫ কোটি বছর পূর্বে প্রথম বিবর্তিত হয় ‘প্রাইমেট’ যা আমাদের সরাসরি পূর্বপুরুষ। যাদের দেহগঠনের সাথে অনেকাংশেই মিলে যায় আমাদের দৈহিক গঠন। এসময় বিবর্তনের ধারায় তারা পায় পাঁচ আঙ্গুলের নমনীয় হাত যার সাহায্যে কোন কিছুকে ভালভাবে আঁকড়ে ধরা যায়, আর পায় উন্নত দৃষ্টির চোখ যা আরো বিবর্তিত হয়ে আরো প্রখর দৃষ্টিসম্পন্ন চোখের ‘প্রাইমেট’ এর উদ্ভব হয়। পাঁচ কোটি বছর পূর্বে আমাদের পূর্বপুরুষ এই প্রাইমেটদের উদ্ভব হয় পৃথিবীতে। সেসময় আফ্রিকা ও আমেরিকা মহাদেশ নির্দিষ্ট আকৃতি প্রাপ্ত হয় যেটি প্রায় বর্তমানের কাছাকাছি। পৃথিবী হয়ে ওঠে উত্তপ্ত।
এখন থেকে প্রায় এক কোটি বছর আগে পৃথিবীতে তৈরি হতে শুরু করে আমাদের বর্তমান পৃথিবীর মত দৃশ্যপট। কলোরাডো নদী ও গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের সৃষ্টি হয়, তৈরি হয় হিমালয় পর্বত। হিমালয় এসময় এতই উঁচু হয়ে যায় যে এটি আবহাওয়ার ধরনের পরিবর্তন ঘটায়। উত্তপ্ত পৃথিবীকে তুলনামূলক ঠাণ্ডা একটা অবস্থায় নিয়ে আসে।আটলান্টিক মহাসাগরের মধ্যদিয়ে চ্যানেলের মত একটি অবিচ্ছিন্ন দ্বীপ সৃষ্টি হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার মধ্যে সংযোগ ঘটায়। এর ফলে সৃষ্ট সমুদ্রস্রোতের পরিবর্তন পৃথিবীকে আরো ঠাণ্ডা করে এক বরফ যুগের সূচনা করে। ‘প্রাইমেট’রা বসবাস শুরু করে পৃথিবীর উষ্ণ অঞ্চলগুলোতে।
বর্তমান থেকে সত্তর লক্ষ বছর পূর্বে ‘প্রাইমেট’ বিবর্তিত ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে টিকে গিয়ে হয়ে ওঠে আমাদের আরো কাছাকাছি পূর্বপুরুষ যার নাম ‘এপ’। এরা বৃক্ষবাসী হয়ে এসময় বেশ স্বাচ্ছন্দ্যেই জীবন যাপন করছিল পৃথিবীতে। তখনই পৃথিবীতে ঘটে আরেকটি বিপ্লব যেটি ‘এপ’ কে ‘মানুষ’ এ বিবর্তিত করার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। ঘটে যায় ‘ঘাস বিপ্লব’। পৃথিবীর বুকে দেখা যায় ঘাস নামের নতুন একধরনের উদ্ভিদ। আকারে ছোট হয়েও পৃথিবীতে বিস্তীর্ণ অঞ্চল দখল করে নেয় ঘাস। বিশাল বিশাল বৃক্ষ জঙ্গল বিলুপ্ত হয়ে সেখানে সৃষ্টি হয় তৃণভূমি। আফ্রিকার তৃণভূমি, ইউরেশিয়ার তৃণভূমি, উত্তর আমেরিকার তৃণভূমি, আর্জেন্টিনার বৃহত্তর তৃণভূমি ঘাস বিপ্লবের সময় সৃষ্ট।
ঘাস বিপ্লব ঘটার পরবর্তী সময়ে পূর্ব আফ্রিকায় কিছু সংখ্যক ‘এপ’ বাস করত। সেখানে তখন তৃণভূমির ভেতরেও কিছু বৃক্ষ অবশিষ্ট ছিল ‘এপ’দের জন্য। তবে সেগুলোর একটা থেকে আরেকটি ছিল বেশ দূরে দূরে। তাই এক গাছের ‘এপ’ রা সেই গাছেই থাকত। প্রজন্মান্তরে একই গাছে ‘এপ’ এর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এই খাদ্যাভাব দেখা দেয়ার পেছনে মরুকরণও দায়ী ছিলো। আর এই মরুকরণ তৈরি হয়েছিলো অনেক অনেক দূরে (একদম আরেক মহাদেশে) স্থলদ্বীপ তৈরি হয়ে সমুদ্রের স্রোত (ocean current) পালটে যাওয়ার ফলে, এবং মৌসুমী বৃষ্টিপাত বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে। খাদ্যসংস্থানের তাগিদে কিছু ‘এপ’ নেমে আসে গাছ থেকে মাটিতে। যেটি মানবসভ্যতা তথা মানুষ সৃষ্টির পথে এক বড় ধরনের অগ্রগতি।
গাছের ‘এপ’ মাটিতে নেমে আসার পর থেকেই শুরু হয় তাদের মানুষে বিবর্তনের মূল প্রক্রিয়া। তারা ঘাসের উপর দিয়ে মাথা উঁচু করে দেখার চেষ্টা করে শত্রু থেকে নিরাপদ থাকতে। এভাবে তারা একসময় দুই পায়ে ভর করে দাঁড়াতে ও হাঁটতে সক্ষম হয়। এটি ছিল মানব সভ্যতার জন্য যুগান্তকারী একটি ঘটনা। কারণ দুই পায়ে দাঁড়ানোর সাথে সাথে ‘এপ’ রা পায় দুটি আপাত মুক্ত অঙ্গ; যার নাম ‘হাত’। এ হাত দিয়েই মানুষ শুরু থেকে সভ্যতা নিয়ে এসেছে আজকের অবস্থায়। এসময় এই ‘এপ’ রা বিবর্তিত হতে থাকে ‘প্রোটো-হিউম্যান’ নামে পরিচিত ‘হোমিনিড’-এ।
আজ থেকে প্রায় ২৫ লক্ষ বছর পূর্বে হোমিনিডরা দুই পায়ে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায় পৃথিবীর পাথুরে মাটিতে। এরপর সময় এগিয়ে চলে। প্রায় ১৫ লক্ষ বছরের পথ পরিক্রমায় হোমিনিডরা বিবর্তিত ও প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে পর্যায়ক্রমে হোমো ইরেকটাস, হোমো হ্যাবিলিস এবং সবশেষে হোমো সেপিয়েন্সে পৌঁছে। যে হোমো সেপিয়েন্স আমরা, ‘মানুষ’।
এসডব্লিউএসএস/১৪৪০
আপনার মতামত জানানঃ