অস্ট্রেলিয়ার স্থানীয় প্রজাতি থাইলাসিন অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূখণ্ড এবং পাপুয়া নিউগিনি থেকে দুই হাজার বছরেরও আগে হারিয়ে গেছে। কেউ কেউ এর পেছনে আরেক শিকারী প্রাণী ডিঙ্গোর আগমনকে দায়ী করেন। তবে অনেকেই এই যুক্তি মানতে নারাজ। তবে অস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে থাকা তাসমানিয়া দ্বীপে বাস করা ৫ হাজারেরও বেশি থাইলাসিনের ভাগ্যে কী ঘটেছিল তা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই।
উনিশ শতকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিকদের তাসমানিয়ায় পা রাখার সাথে সাথেই তাদের ভাগ্য নির্ধারণ করা হয়ে গিয়েছিল। অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ‘গণহত্যা’ চালিয়েছিল বলে বিশ্বাস করা অনেকেই মনে করেন, তাসমানিয়ার অন্যতম শীর্ষ এই শিকারী প্রাণীর ওপরেও একইভাবে ‘গণহত্যা’ চালিয়েছিল তারা।
জীববিজ্ঞানী, সংরক্ষণবাদী এবং তাসমানিয়ার অন্যতম থাইলাসিন বিশেষজ্ঞ নিক মুনি মাথা নেড়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন, “এটি এক মর্মান্তিক কাহিনী।”
অস্ট্রেলিয়ার ও তাসমানিয়াকে ১৪ হাজার বছর ধরে আলাদা করে রাখা ব্যাস প্রণালীর একটি খাঁড়ির কিনারায় গাছের নিচে দাঁড়িয়ে মুনি ব্যাখ্যা করতে লাগলেন কীভাবে ঔপনিবেশিকরা লাজুক ও নিশাচর এই মার্সুপিয়াল তাসমানিয়ান টাইগারকে শেষ করে দিয়েছিল।
“অনেক ইংরেজই এখানে আসার আগে ভারতীয় বাঘের সম্পর্কে জেনেছিল। থাইলাসিনের গায়ের ডোরাকাটা দেখে তারাও একে বাঘ বলা শুরু করে।” নিক মুনির মতে, “এটি ইউরোপীয়দের এক ধরনের হিস্টেরিয়া। বড় দাঁত বা থাবাওয়ালা যেকোনো প্রাণীই তাদের কাছে বিপদজনক।”
“তবে তাসমানিয়ায় বসতি স্থাপনের পর খামারের কাজে ভেড়া আনার সাথে সাথেই শুরু হয় দ্বন্দ্ব। এক সময় গিয়ে দাবি করা হয়, প্রচুর পরিমাণে ভেড়া মেরে ফেলছে থাইলাসিনরা। এবং তারা যে সংখ্যা দাবি করেছিল, সে পরিমাণ ভেড়া তাসমানিয়াতে ছিলই না। ট্যাবলয়েড পত্রিকার গালগল্প ছাড়া এটি আর কিছুই নয়। তাই একে মারার জন্য পুরস্কার ঘোষণা করা হয়, এবং এই কাণ্ডই হয়ে ওঠে থাইলাসিনের মৃত্যুর কারণ।”
১৮৩০-এর দশকের গোড়া থেকেই তাসমানিয়ান টাইগারের ওপর বেসরকারিভাবে বাউন্টি প্রবর্তন করা হয়; অর্থাৎ মারতে পারলেই অর্থপুরস্কার। উনিশ শতকের শেষদিকে সরকারও পুরস্কার ঘোষণা করে। যেসব থাইলাসিন এই বাউন্টি হান্টারদেরকে এড়িয়ে যেতে সফল হয়, তারাও শিকার হয় অন্য প্রাণীদের জন্য পেতে রাখা ফাঁদে।
শেষ বন্য থাইলাসিনটিকে মারার কৃতিত্ব দেওয়া হয় ১৯৩০ সালে ইয়র্কশায়ার থেকে আসা কৃষক উইলফ্রেড ব্যাটিকে। তাসমানিয়ার উত্তর-পশ্চিমে থাকা মাওবান্নায় তার মুরগির খামারের কাছে তিনি প্রাণীটিকে ঘোরাফেরা করতে দেখেন। এই উর্বর কৃষি অঞ্চল একসময় ছিল থাইলাসিনের প্রধান আবাসস্থল।
ব্যাটির নাতি বেভান অ্যান্ডারসন এখনও ওই এলাকায় থাকেন। প্রতিবেশীর বাসায় বসে তিনি তার কোলে রাখা তার দাদার ছবিটি দেখছিলেন। ছবিটিতে দেখা যায় হাস্যোজ্জ্বল ব্যাটিকে। তিনি তার বন্দুকটি ধরে তার আতঙ্কিত কুকুর এবং মারাত্মকভাবে আহত থাইলাসিনটির মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন।
তার দাদার কুখ্যাতি সম্পর্কে বলতে গিয়ে অ্যান্ডারসন বলেন, “পপ যখন বাঘটিকে গুলি করে, তখন তারা স্ট্যানলি [তাসমানিয়ার শহর] থেকে একজন প্রতিবেদককে পাঠিয়েছিলেন। সাথে এসেছিলেন একজন ফটোগ্রাফারও।”
“আমি নিশ্চিত নই, এটি গর্বের বিষয় নাকি লজ্জার। তবে আমার মনে হয়, এই থাইলাসিনগুলো তার জীবিকার জন্য হুমকি ছিল। সেগুলো তার মুরগি চুরি করতো। তাই তাকে তার মুরগিগুলোকে রক্ষা করার জন্যই এই কাজ করতে হয়েছিল। তবে তিনি যদি জানতেন, এটি এই প্রজাতির শেষগুলোর একটি, তবে তিনি সম্ভবত এ কাজ করতেন না।”
ছবির দিকে তাকিয়ে শেষবারের মতো অ্যান্ডারসন বলেন, “আমি এটিই বিশ্বাস করি।”
হোবার্ট জাদুঘরের বেজমেন্টের সংগ্রহশালায় দেখা গেল জাদুঘরের অবসরপ্রাপ্ত সিনিয়র কিউরেটর এবং থাইলাসিন বিশেষজ্ঞ, ক্যাথরিন মেডলককে। ফ্লুরোসেন্ট বাতির আলোতে চোখে পড়লো তাকের মধ্যে রাখা অসংখ্য লেবেলযুক্ত বাক্স। সেগুলোর মধ্য থেকে সাবধানে একটি থাইলাসিনের খুলি বের করলেন তিনি। কপালের একটি গর্তের দিকে ইঙ্গিত করে জানালেন, “এই মাথার খুলিটি বেশ আকর্ষণীয়, কারণ এতে একটি বুলেটের ছিদ্র রয়েছে।”
তিনি ব্যাখ্যা করলেন, কীভাবে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ থাইলাসিনের এই নমুনাগুলো সংগ্রহ করেছে। তার ক্যাটালগ অনুযায়ী, এক ট্র্যাপার (ফাঁদ পেতে প্রাণী ধরা শিকারী) একটি থাইলাসিনকে ১৯২৮ সালে বন্দী করে ২৫ পাউন্ডের বিনিময়ে একটি চিড়িয়াখানায় বিক্রি করে দেয়। এটি মারা গেলে জাদুঘর কর্তৃপক্ষ চিড়িয়াখানার কাছ থেকে থাইলাসিনের মৃতদেহটি ৫ পাউন্ডে কিনে নেয়।
“এটি অদ্ভুত যে, একদিকে জাদুঘর থাইলাসিনের মৃতদেহ সংগ্রহ করতো। আবার একই সময়ে জাদুঘরের তিনজন পরিচালক থাইলাসিন সংরক্ষণ, তাদের আইনি সুরক্ষা, এবং শিকারের ওপর নিষেধাজ্ঞার জন্য কাজ করে যাছিলেন। দুটো সম্পূর্ণ বিপরীতই বটে।”
১৯৩৬ সালের জুলাই মাসে অবশেষে তাসমানিয়ার সরকার থাইলাসিনকে একটি সংরক্ষিত প্রজাতি হিসেবে ঘোষণা করে। কিন্তু ততদিনে অনেক দেরি হয়ে গেছে। হোবার্টের কেন্দ্রে থাকা বর্তমানে পরিত্যক্ত বিউমারিস চিড়িয়াখানায় শেষ থাইলাসিনটি তার কিছুদিন পরেই মারা যায়। মারা যাওয়ার আগে নিষ্ঠুর অবহেলার শিকার হয় সেটি।
থাইলাসিনের অস্তিত্বের ভিডিওগুলো করা হয়েছে তাকে বন্দী রাখা অবস্থাতেই। থাইলাসিনটিকে বন্দী করে হোবার্ট চিড়িয়াখানায় আনার পরপরই বেঁচে থাকা থাইলাসিনটির ভিডিও করা হয়। অস্পষ্ট কালো এবং সাদা ভিডিওতে পুরুষ থাইলাসিনটিকে অস্থিরভাবে ছোটাছুটি করতে দেখা যায়, যেখানে ছোট সিমেন্টের ঘরের মধ্যে তারের বেড়া দিয়ে তাকে আটকে রাখা হয়েছে। ভিডিওটি কষ্টদায়ক হলেও এটিই এ প্রজাতির একমাত্র প্রমাণ; প্রজাতিটি মানুষের হাতে বিলুপ্ত হওয়া প্রাণীদের একটি আইকন হয়ে উঠেছে। থাইলাসিনটি যেদিন মারা যায়, সেই দিনটিকে স্মরণীয় করে রাখতেই অস্ট্রেলিয়া সরকার বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণীদের দিবস হিসেবে ঘোষণা করে।
তবে ১৯৮২ সালে ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচার থাইলাসিনকে বিলুপ্ত ঘোষণা করলেও, তাসমানিয়ার অনেকেই এখনো বিশ্বাস করেন প্রাণীটি এখনও সেখানে রয়েছে।
এসডব্লিউএসএস/২৩০৫
আপনার মতামত জানানঃ