আজ থেকে প্রায় ৪৫ হাজার বছর পূর্বে মানবজাতি অস্ট্রেলিয়ায় উপনিবেশ স্থাপনের মাধ্যমে সফলতার মাইলফলক স্থাপন করে। স্যাপিয়েন্সদের এই সাফল্যগাথার সুনিপুণ বিবরণ দিতে গিয়ে বিশেষজ্ঞদের বিস্তর বেগ পোহাতে হচ্ছে। কারণ, অস্ট্রেলিয়াতে পদার্পণ করতে গিয়ে স্যাপিয়েন্সদের বহু সামুদ্রিক প্রণালী পাড়ি দেওয়ার প্রয়োজন হয়েছিল। এর মধ্যে কোনো কোনো প্রণালীর প্রস্থ ছিল শতাধিক কিলোমিটারেরও বেশি।
বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য তথ্যানুসারে, ইন্দোনেশীয় দ্বীপপুঞ্জে বসবাসকারী স্যাপিয়েন্সদের মধ্যেই সর্বপ্রথম সমুদ্রচারী সমাজের উদ্ভব ঘটে। তাদের সমুদ্র বিষয়ক জ্ঞান ও দক্ষতায়ই তাদের দূরপাল্লার জেলে, বণিক, কিংবা দূরপাল্লার অভিযাত্রী হিসেবে গড়ে তুলেছিল। সেই বিদ্যা ও দক্ষতার কাঁধে ভর দিয়েই তারা অস্ট্রেলিয়ায় পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিল।
অস্ট্রেলিয়ায় এসে মানুষ সেখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন ধাঁচের এক বাস্তুসংস্থানের দেখা পায়, যা তাদের জন্য একেবারে নতুনই বলা চলে। বিস্তীর্ণ বেলাভূমি ছেড়ে মানুষ যত সামনের দিকে এগোতে থাকে, ততই তারা মুখোমুখি হতে থাকে অজানা সকল প্রাণীর।
সম্পূর্ণ অজানা এই মহাদেশের আকাশে উড়ে বেড়ানো পক্ষীকুল আর বুকে ভর দিয়ে হাঁটা সরীসৃপেরা বাদে বাকি প্রায় সব প্রাণীই ছিল ক্যাঙ্গারুর মতো মারসুপিয়াল। মারসুপিয়াল হচ্ছে সেসব প্রাণী, যারা ক্ষুদ্র, অসহায় ও ভ্রূণ-সদৃশ শাবক জন্ম দিয়ে, শাবককে নিজেদের উদরের কাছে অবস্থিত থলের মধ্যে রেখে মাতৃস্তনে লালন করে। আফ্রিকা বা এশিয়াতে কোনোদিন মারসুপিয়াল দেখা না গেলেও, অস্ট্রেলিয়াতে তখন সংখ্যার দিক দিয়ে তাদের একচেটিয়া আধিপত্য।
তৎকালীন অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে হরহামেশাই দেখা মিলত দু’শ কেজি ওজনের ক্যাঙ্গারুর, যারা লম্বায় ছিল প্রায় দুই মিটার। ওই মহাদেশ দাপিয়ে বেড়াতো মারসুপিয়াল সিংহ, যারা ছিল তখনকার সর্ববৃহৎ শিকারি প্রাণী। উড়তে অক্ষম উটপাখির দ্বিগুণ আকারের একদল পাখির ধুমধাম পদশব্দে মুহূর্তেই ভেঙে যেত প্রকৃতির সকল নিস্তব্ধতা।
বনে-জঙ্গলে নির্ভয়ে ঘুরে বেড়াত দানবাকৃতির প্রাণী ডাইপ্রোটোডন। তাদের একেকটির গড় ওজন ছিল প্রায় আড়াই টনের কাছাকাছি। ঝোপের আড়ালে সতর্ক দৃষ্টি ও নিঃশব্দে এগিয়ে যেত ড্রাগন-সদৃশ গিরগিটি কিংবা পাঁচ মিটার লম্বা সাপ।
স্যাপিয়েন্সরা অস্ট্রেলিয়ায় বসতি গড়ার কয়েক হাজার বছরের মধ্যেই বিলুপ্তির খাতায় নাম উঠে যায় প্রায় সবগুলো দৈত্যাকৃতির প্রাণীর। অস্ট্রেলিয়াতে তখন পঞ্চাশ কেজির বেশি ওজনের চব্বিশ প্রজাতির প্রাণী বাস করত, যার মধ্যে তেইশটি প্রজাতিই বিলুপ্ত হয়ে যায়। অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির অসংখ্য প্রজাতিও বিলুপ্তির এই ঘূর্ণিপাকে অস্ট্রেলিয়া থেকে বিলীন হয়ে যায়।
লক্ষ লক্ষ বছর ধরে তিল তিল করে গড়ে উঠা অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের বাস্তুসংস্থানের খোলস কয়েকশত বছরের মধ্যেই ভেঙে যায়। হোমো স্যাপিয়েন্স দ্বারা গড়ে উঠে সম্পূর্ণ নতুন এক বাস্তুসংস্থান।
কিছু পণ্ডিত নিজ প্রজাতিকে নির্দোষ প্রমাণ করতে গিয়ে, আবহাওয়া ও জলবায়ুর ঘাড়ে সকল দোষের বোঝা চাপিয়ে দেন। তবে হোমো স্যাপিয়েন্সরা যে নিরপরাধ নয়, অন্তত তিনটি জোরালো সাক্ষ্য-প্রমাণ ভিত্তিতে তাদেরকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো যাবে।
প্রথমত, ৪৫,০০০ বছর আগে অস্ট্রেলিয়া কোনো জলবায়ু পরিবর্তনের মুখোমুখি হলেও, সেটাকে উল্লেখযোগ্য কোনো বিপর্যয়ের কাতারে ফেলা যায় না। বিজ্ঞানীদের তথ্যমতে, গত দশ লক্ষ বছর যাবত, গড়ে প্রতি এক লক্ষ বছরে পৃথিবী একটি করে তুষার-যুগ দেখেছে। সর্বশেষ তুষার-যুগ প্রায় ৭৫,০০০ বছর আগ থেকে শুরু হয়ে ১৫,০০০ বছর আগ পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। দানবাকৃতির ডাইপ্রোটোডন অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে আবির্ভূত হয়েছিল প্রায় ১৫ লক্ষ বছর আগে।
৭০ হাজার ও ২০ হাজার বছর আগের শৈত্য তীব্রতার দুইটি সর্বোচ্চ বিন্দুসহ অন্তত দশটি তুষার-যুগের কণ্টকাকীর্ণ পথ তারা বেশ সাফল্যের সাথে পাড়ি দিয়েই পৃথিবীতে নিজেদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পেরেছিল। কিন্তু ঠিক কী কারণে ৪৫ হাজার বছর আগে এরা প্রকৃতি থেকে হঠাৎ বিলীন হয়ে গেল?
বৃহৎ প্রাণী হিসেবে যদি শুধু ডাইপ্রোটোডনরাই বিলুপ্ত হতো তবে তাকে নিছক ‘প্রাকৃতিক দুর্ঘটনা’ শিরোনামে চালিয়ে দেওয়া যেত। কিন্তু ডাইপ্রোটোডনদের সাথে বিলুপ্তির রথে চড়ে অস্ট্রেলীয় মেগাফনা (অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের যেসব প্রাণীর ওজন ১০০০ কেজিরও বেশি) নিশ্চিহ্নের পথে রওনা দিয়েছে।
বিশ্বাস করা কঠিন হলেও, ঠিক ওইসময়টাতেই তাদের বিলুপ্ত ঘটেছিল, যখন হোমো স্যাপিয়েন্সরা সাগর পাড়ি দিয়ে অস্ট্রেলিয়া মহাদেশে নিজেদের উপনিবেশ স্থাপন করেছিল।
দ্বিতীয়ত, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেগাফনারা বিলুপ্ত হয়েছে, তর্কের খাতিরে তা মেনে নিলেও, সেখানে ভজকট পাকিয়ে বসে জলের জীবেরা। ৪৫ হাজার বছর আগে ডাঙাকে বিলুপ্তির কালো থাবা আস্বাদন করলেও সামুদ্রিক প্রাণীদের বিলুপ্ত হবার কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না। কারণ, স্থলভাগে হোমো স্যাপিয়েন্সরা রীতিমতো মূর্তিমান আতঙ্কের রূপ ধারণ করলেও, জলের কাছে তারা ছিল নেহাত বাচ্চা-শিশু। তখন সবেমাত্র জলপথে দিক নির্ণয়ের দক্ষতা খানিক প্রস্ফুটিত হচ্ছিল।
এর কারণ ব্যাখ্যায় বিশেষজ্ঞরা বলে, মানুষ যখন অস্ট্রেলিয়ায় পা রেখেছিল, ততদিনে তারা আগুনের ব্যবহার বেশ ভালোভাবেই রপ্ত করে ফেলেছে। দুর্ভেদ্য ও ঘন সন্নিবিষ্ট বনভূমিকে তৃণভূমিতে পরিণত করার জন্য তারা সেই স্থানগুলো আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিত। কারণ, উন্মুক্ত তৃণভূমি ছিল শিকারের জন্য বেশ আদর্শ জায়গা।
কিছু উদ্ভিজ্জ ফসল এই ব্যাখ্যার পক্ষে সাক্ষ্য দিয়ে তা আরও পাকাপোক্ত হিসেবে প্রমাণ করে। যেমন, ৪৫ হাজার বছর আগে অস্ট্রেলিয়াতে ইউক্যালিপটাস উদ্ভিদ একপ্রকার দুষ্প্রাপ্যই ছিল। হোমো স্যাপিয়েন্সদের আগমনের ফলে ইউক্যালিপটাস উদ্ভিদের সংখ্যা অস্ট্রেলিয়ায় দ্রুত হারে বাড়তে থাকে। কারণ, বনভূমিতে আগুন দেওয়ার ফলে অন্যান্য বৃক্ষ ও গুল্মরাজি বিলুপ্ত হলেও, আগুন প্রতিরোধী হওয়ায় ইউক্যালিপটাস দূর-দূরান্তে ছড়িয়ে পড়তে পেরেছিল।
তখন ইউক্যালিপটাস গাছের উপর নির্ভরশীল কোয়ালারা বেঁচে থাকতে পারলেও, হারিয়ে গেছে বৃক্ষ ও গুল্মরাজির উপর নির্ভরশীল অন্যান্য প্রাণীকুল। খাদ্য শৃঙ্খলা ভেঙে যাওয়ায় প্রাণীরা মুখোমুখি হয়েছিল এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের। তবে আরও প্রমাণ দরকার প্রকৃত সত্যের জন্য।
এসডব্লিউএসএস/১০৩৩
আপনার মতামত জানানঃ