মিশরের ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি বোয়িং ৭৭৭-২০০ ইআর মডেলের প্লেন লিজ নেয়ার প্রক্রিয়ায় অনিয়মের অভিযোগে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ২৩ কর্মকর্তার নামে মামলা দায়ের করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)।
দুদক সচিব মাহবুব হোসেন মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করে সাংবাদিকদের বলেন, ঘটনার সত্যতা পাওয়ায় বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ২৩ কর্মকর্তার নামে মামলার অনুমোদন দেয়া হয়েছে। কমিশনের উপ-পরিচালক জেসমিন আক্তার বাদী হয়ে সংস্থাটির সমন্বিত কার্যালয় ঢাকা-১ এ মামলাটি দায়ের করেছেন।
মামলার অভিযোগে বলা হয়, মামলার আসামিরা পূর্বপরিকল্পিতভাবে পরস্পর যোগসাজশ ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে প্রতারণার মাধ্যমে আগে নিজেরা লাভবান হয়ে ও অপরকে লাভবান করার অসৎ উদ্দেশ্যে ইজিপ্ট এয়ার থেকে দুটি প্লেন লিজ নিয়ে ও পরে রি-ডেলিভারি পর্যন্ত বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স লিমিটেডের ১ হাজার ১৬১ কোটি টাকার ক্ষতি ও অর্থ আত্মসাৎ করে দণ্ডবিধির ১০৯/৪০৯/৪২০ ধারায় এবং ১৯৪৭ সালের দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন ৫(২) ধারায় শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছেন।
যে কারণে মামলা
দুর্নীতি দমন কমিশন, প্রধান কার্যালয়, ঢাকার নথি মূলে প্রাপ্ত অভিযোগ অনুসন্ধানকালে ঘটনাস্থল পরিদর্শন, প্রাপ্ত রেকর্ডপত্র ও সংশ্লিষ্টদের বক্তব্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্স লি. এর ২০১২ সালে প্রণীত ১০ বছর মেয়াদি দুটি উড়োজাহাজ বা এয়ারক্রাফট লীজের বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
বিমানের বোর্ড অব ডিরেক্টর এবং এমডি’র সমন্বয়ে বিমানের ১১৬তম সভায় বি ৭৭৭-২০০ইআর উড়োজাহাজ লিজ নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বিমান লিজ গ্রহণের জন্য ২০১৩ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর দরপত্র আহ্বান করে বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। যার প্রেক্ষিতে ৪টি বিডার জেসকো এভিয়েশন-ইউএসএ, ইউরো আটলান্টিক-পর্তুগাল, স্টান্ডার্ড চার্টার্ড, ইজিপট এয়ার হোল্ডিং কোং অংশগ্রহণ করে।
ওই বছরের ৩০শে অক্টোবর উক্ত দরপত্র উন্মুক্ত করা হয়। উই: কমান্ডার এম.এম. আসাদুজ্জামান, পরিচালক (ইঞ্জি.) এর সভাপতিত্বে ১৪ সদস্য সমন্বয়ে গঠিত টেকনো ফিন্যান্সিয়াল সাব-কমিটি ইজিপট এয়ার হোল্ডিং কোং রেসপন্সিভ করে প্রতিবেদন দাখিল করে।
কমিটির দাখিলকৃত প্রতিবেদনে ৪টি বিডারের মধ্যে কনফিগারেশনের তুলনামূলক আলোচনা করলে দেখা যায় ইজিপট এয়ার ছাড়া বাকি ৩টি বিডারই বিশ্বের মধ্যে উন্নতমানের উড়োজাহাজ সরবরাহকারী কোম্পানি। সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে আর্থিক ক্যাটাগরীতে রেসপনসিভ হয় ইজিপ্ট এয়ার ১ম সর্বনিম্ন এবং স্টান্ডার্ড চাটার্ড ২য় সর্বনিম্ন দরদাতা হিসেবে বিবেচিত হয়।
এই দুটির মধ্যে ইজিপ্ট এয়ার এর ইঞ্জিন ছিল অনেক পুরোনো এবং দুর্বল। যার স্পেয়ার পার্টস পাওয়া খুব কঠিন এবং স্টান্ডার্ড চাটার্ড এর ইঞ্জিন ইজিপ্ট এয়ার অপেক্ষা অনেক ভালো ছিল। এখানে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড যেহেতু বিশ্বের নামকরা প্রতিষ্ঠান এবং এখানে একটা নেগোসিয়েশনের সুযোগ ছিল।
তদুপরি বর্ণিত সময়ে স্টান্ডার্ড চার্টার্ড সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সে চলমান ছিল আর ইজিপ্ট এয়ার ৭ মাস ধরে স্টোরেজে অব্যবহৃত/মজুত ছিল। এতদ্সত্ত্বেও অসৎ উদ্দেশ্যে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স মিশরের ইজিপ্ট এয়ার হোল্ডিং কোং থেকে লীজ গ্রহণের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশ বিমান চুক্তির পূর্বে উড়োজাহাজ দুইটির ফিজিক্যাল ইনস্পেকশনের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যার ভিত্তিতে ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদ এর নেতৃত্বে ৮ (আট) সদস্য সমন্বয়ে একটি পরিদর্শন দল গঠন করা হয়।
তারপর দুটি এয়ারক্রাফট ড্রাই লিজ নেয়ার জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এর পক্ষ থেকে ৮ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দল ক্যাপ্টেন ইশরাতের উড়োজাহাজ দুটির টেকনিক্যাল অবস্থা পর্যবেক্ষণে মিশরের কায়রোতে যান। পরিদর্শন টিম পরিদর্শন শেষে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করে। পরিদর্শন প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কিছু এডি ওপেন আছে। সে অনুসারে এয়ারক্রাফট দুটোর বেশকিছু রক্ষণাবেক্ষণের কাজ বাকি রয়েছে।
নিয়ম অনুযায়ী এডি অসম্পূর্ণ থাকলে এয়ারক্রাফট তার উড্ডয়ন যোগ্যতা হারায় মর্মে প্রতীয়মান হয়। পরিদর্শন টিম অসৎ উদ্দেশ্যে এডি’র কি কি কাজ বাকি আছে তা প্রতিবেদনে উল্লেখ করেনি। এ ছাড়াও প্রতিবেদনে ইঞ্জিনে তেল ক্ষরণ হচ্ছে মর্মে উল্লেখ করা হয়। দরপত্র অনুযায়ী এয়ারক্রাফট ইঞ্জিন কমপক্ষে ৪০০০ সাইকেল অবশিষ্ট থাকতে হবে কিন্তু লিজকৃত এয়ারক্রাফট দুইটির মধ্যে ১টি এয়ারক্রাফট এর ইঞ্জিন ৩৬১৫টি সাইকেল অবশিষ্ট ছিল এবং আরেকটি এয়ারক্রাফটির ইঞ্জিন ২১০০টি সাইকেল অবশিষ্ট ছিল। যা সম্পূর্ণভাবে দরপত্রের উল্লেখিত শর্ত বিরোধী।
এত সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও টিম ইজিপ্ট থেকে এয়ারক্রাফট লিজের বিষয়ে একমত পোষণ করে লিজের পক্ষে মতামত দিয়েছে। সি চেক একটি বিমানের এয়ারওয়ারদিং বজায় রাখার জন্য অত্যন্ত জরুরি একটি বিষয়। কিন্তু দেখা যায় ইজিপ্ট এয়ারের চেকগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল।
বিমান ডেলিভারির পূর্বে বিমানের সি চেক তদারকির জন্য বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের দেবেশ চৌধুরীর নেতৃত্বে ৪ সদস্যবিশিষ্ট প্রতিনিধি দল ১০ দিনের জন্য মিশরের কায়রো গমন করে। পরবর্তীতে সি চেকের সময় ফাইন্ডিংস আসায় আরও ১০ দিন অবস্থান করে।
এত ফাইন্ডিংস থাকা সত্ত্বেও ইজিপ্ট এয়ারের পক্ষে মো. হাছান এবং বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের পক্ষে এমডি কেভিন জন স্টিল এর মধ্যে ৫(পাঁচ) বছরের জন্য ড্রাই লিজ ভিত্তিতে চুক্তি সম্পাদিত হয়। চুক্তি মোতাবেক এয়ারক্রাফট ডেলিভারি করা হয়। যা মো. শফিকুল আলম সিদ্দিক এর নেতৃত্বে ১ম এয়ারক্রাফট এবং ২য় এয়ারক্রাফট দরপত্রে বর্ণিত স্পেসিফিকেশন মোতাবেক গ্রহণ করে।
উক্ত সার্টিফিকেট পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স এ ধরনের এয়ারক্রাফট অপারেটরে খুবই দক্ষ এবং নিজেরা সন্তোষজনকভাবে সকল পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন। কিন্তু সার্টিফিকেট অনুযায়ী মেরামতের কিছু বিষয় অসম্পূর্ণ ছিল অর্থাৎ যা পরবর্তীতে করা হবে মর্মে জানালে টিম মেনে নিয়ে ফরমায়েশী সার্টিফিকেট প্রদান করেন।
অসৎ উদ্দেশ্যে ত্রুটিপূর্ণ ও মেরামত অযোগ্য হওয়া সত্ত্বেও তা বাংলাদেশ বিমান বহরের সঙ্গে যুক্ত করার জন্য সন্তোষজনক মর্মে মতামত প্রদান করে। যার ভিত্তিতে এয়ারক্রাফট দুইটি বাংলাদেশ বিমান বহরে সংযুক্ত করা হয়। উড়োজাহাজ দুইটি ৫ (পাঁচ) বছরের জন্য লিজ নেয়া হলেও লীজ গ্রহণের পর মাত্র ১১ মাস পরিচালনা করার পর লিজকৃত উড়োজাহাজ দুইটির ইঞ্জিন নষ্ট হয়ে যায়।
ইউনাইটেড এয়ারলাইন্সে নিয়ে মেরামত করতে না পারায় উড়োজাহাজটি গ্রাউন্ডেড হয়। উড়োজাহাজগুলো সচল রাখার জন্য ইজিপ্ট এয়ার থেকে পুনরায় আরও ৪(চারটি) ইঞ্জিন লিজ নেয়া হয় এবং সেগুলোও নষ্ট হয়ে যায়। এয়ারক্রাফটগুলো রি-ডেলিভারির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হলে মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে গাজী মাহমুদ ইকবাল, ভারপ্রাপ্ত পরিচালক, মূল্যায়ন কমিটির সভাপতি হিসেবে ইজিপ্ট এয়ার থেকে লীজকৃত উড়োজাহাজগুলোর রি ডেলিভারির জন্য ঠিকাদার নিয়োগে সময় টেন্ডার ডকুমেন্টস এর শর্তভঙ্গ করে অনৈতিকভাবে নন রেস্পন্সিভকে রেস্পনসিভ করে।
দরপত্রের শতের্র ব্যত্যয় ঘটিয়ে উক্ত নন রেসপনসিভ ঠিকাদারের মাধ্যমে যন্ত্রপাতি কিনে বিমানের চৌত্রিশ কোটি বিরাশি লক্ষ নব্বই হাজার একশত আটত্রিশ টাকা ক্ষতিসাধন করে। যদি কমার্সিয়ালি সেটেলমেন্ট এর মাধ্যমে উড়োজাহাজগুলো ফেরত দেয়া যেতো তাহলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যেতো কিন্তু অসৎ উদ্দেশ্য এবং দুর্বল চুক্তির কারণে ফেরত দিতে না পারায় লীজের সময় সম্পন্ন করে এয়ার ক্রাফটগুলো ফেরত দেয়া হয় এবং গ্রাউন্ডেড অবস্থায়ও সম্পূর্ণ ভাড়া প্রদান করতে হয়। মিশর হতে গ্রহণকৃত এয়ারক্রাফট দুটি ফেরত প্রদান করে।
এসডব্লিউএসএস/১২৫৫
আপনার মতামত জানানঃ