সমাজে নারীদের যৌনবৃত্তি আজ নতুন কিছু নয়। অর্থ, আশ্রয়ের বিনিময়ে যৌনতা বিক্রি বা বাধ্য করার ইতিহাস সুপ্রাচীন। ইতিহাসবিদ ভিন্টারনিৎসের মতে ঋগবেদের প্রথম মণ্ডলের ১২৬তম সূক্তের অন্তর্গত পঞ্চম ঋকে যে “বিশ্যা” (“সুবন্ধবো যে বিশ্যা ইব ব্রা অনস্বন্তঃ স্রব ঐযন্ত পূযা”) শব্দটি আছে তার থেকেই “বেশ্যা” কথাটির উৎপত্তি।
ওয়েবস্টার অভিধান মতে, সুমেরিয়ানদের মধ্যেই প্রথম পবিত্র পতিতার দেখা মেলে। প্রাচীন গ্রন্থাদিসূত্রে, যেমন ইতিহাসের জনক হিসাবে খ্যাত হিরোডেটাস (খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৪ থেকে খ্রিস্টপূর্ব ৪৩০/২০)-এর লেখায় এই পবিত্র বেশ্যাবৃত্তির প্রচুর উদাহরণ পাওয়া যাবে, যেটি প্রথম শুরু হয়েছিল ব্যাবিলনে। সেখানে প্রত্যেক নারীকে বছরে অন্তত একবার করে যৌনতা, উর্বরতা ও সৌন্দর্যের দেবী আফ্রোদিতির মন্দিরে যেতে হত এবং সেবাশুশ্রূষার নমুনা হিসাবে নামমাত্র মূল্যে যৌনসঙ্গম করতে হত একজন বিদেশির সঙ্গে।
এরকমই বেশ্যাবৃত্তির চর্চা হত সাইপ্রাস এবং করিন্থেও। এটি বিস্তৃত হয়েছিল সার্দিনিয়া এবং কিছু ফিনিশীয় সংস্কৃতিতে, বিশেষ করে ইস্টার দেবতার সম্মানে। ফিনিশীয়দের মাধ্যমে ক্রমশ এটি ভূমধ্যসাগরের অন্যান্য বন্দর শহরগুলিতেও সংক্রমিত হয়, যেমন সিসিলি, ক্রটন, রোসানো ভাগলিও, সিক্কা ভেনেরিয়া এবং অন্যান্য শহরে। এক্ষেত্রে অনুমান করা হয় এশিয়া মাইনর, লাইদিয়া, সিরিয়া ও এট্রাকসনের প্রাচীন গ্রিক ও রোমান সমাজে বেশ্যা বা পতিতারা ছিলেন স্বাধীন।
পতিতাদের অসংখ্য নামে ডাকা হতো ইতিহাসের আদিকাল থেকেই। যেমন –পতিতা , বারাঙ্গনা,দেহপসারিণী, দহপোজীবিনী, রক্ষিতা, খানকি, বারবনিতা, উপপত্নী, জারিণী, সাধারণী, মহানগ্নী, পুংশ্চলী, পুংশ্চলূ,অতীত্বরী, বিজর্জরা, অসোগু, অতিষ্কদ্বরী, গণিকা এবং হাল আমলের যৌনকর্মীও বোঝায়।
‘আইয়্যামে জাহেলিয়া’ যুগে আরবে পতিতাবৃত্তি সহ আরো অনেক খারাপ কাজ চালু ছিল। ইতিহাসবিদ পি.কে হিট্টি বলেন, ‘মহানবী (সাঃ) এর আবির্ভাবের একশ বছর আগে আইয়্যামে জাহিলিয়া শুরু হয়।’
প্রাচীন ভারতে এক সময় যৌনকর্মীদের বলা হত ‘গণিকা।’ বার্ষিক একটা নির্দিষ্ট বেতন দিয়ে রাজা-বাদসারা তাঁদের প্রাসাদে গণিকাদের নিয়োগ করতেন। তাদের আয়ের একটা অংশ “কর” হিসাবে রাজ্য কোষাগারে জমা হত। প্রাচীন ভারতে গণিকা বা যৌনকর্মীদের রাষ্ট্রীয় সম্পত্তি হিসাবে গণ্য করা হত। এবং যৌনকর্মীদের ঘরে বহু জ্ঞানী-গুণীদের আলোচনা-সভা বসত।
ভক্তমূলক পতিতাবৃত্তি অর্থাৎ দেবদাসী প্রথার কথা আমরা সকলেই জানি। এটি এক ধরনের সামাজিক রীতি যেখানে একজন মানুষ নিজ পতি বা পত্নী ব্যতীত অন্য কারও সাথে পবিত্র বা ধর্মীয় উদ্দেশ্যে যৌন সঙ্গম করে। এ ধরনের কাজে জড়িত মহিলা দেবদাসী বা ধর্মীয় গণিকা বলে পরিচিতি পায়। এক সময় শিল্পকর্মে পারদর্শিন দেবদাসীদের বলা হত কলাবন্তী । তারা অভিজাত শ্রেণির দ্বারা মন্দির রক্ষণাবেক্ষণের কাছে নিযুক্ত হতেন। সেখানে মন্দিরের মেঝে ঝাড়ু দেওয়া, পবিত্র প্রদীপে তেল ঢালা ও পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, পূজামন্ডপে ও ধর্মীয় শোভাযাত্রায় নৃত্যগীত পরিবেশন করা এবং পূজার সময় প্রতিমাকে বাতাস করা থাকত তাদের কাজ।
এই কাজের জন্য তাদেরকে মন্দিরের তহবিল থেকে সামান্য কিছু দেয়া হত। সেটা তাদের তাদের প্রয়োজন মেটানোর জন্য যথেষ্ট ছিলনা। তাই জীবিকা অর্জনে তাদেরকে ভক্তিমূলক পতিতাবৃত্তি (Sacred prostitution) করতে তারা বাধ্য হতো। এই প্রথা এখনো চালু আছে। মূলত এই দেবদাসী প্রথার আধিপত্য ছিল দাক্ষিণাত্যে। সেখানে রাজারা কোন অনুষ্ঠানে কয়েকশ দেবদাসী দান করতেন মন্দিরে।
প্রাচীন গ্রিস, এথেন্স ও রোমে বহু বছর আগেই পতিতা বৃত্তি চালু হয়েছিল। এমনকি সেসময় অনেককে বাধ্য করা হতো পতিতাবৃত্তি করতে। ইউস্তিয়ানের স্ত্রী রোমক সম্রাজ্ঞী থেওডেরো প্রথম জীবনে যৌনকর্মী ছিলেন। পৃথিবীতে প্রথম পতিতাবৃত্তি পেশার মতো লাইসেন্স বা নিবন্ধন দেওয়া ও কর ধার্য করা হয় রোমান আমলেই। (তথ্যসূত্র: Thomas A. McGinn, The Economy of Prostitution in the Roman World, 2004)
এথেন্সের আইন প্রণেতা ও কবি সোলোন (খ্ৰী.পূ. ৬৩৮ – খ্ৰী.পূ. ৫৫৮) যিনি প্রাচীন গ্রিকের তৎকালীন সাতজন জ্ঞানী লোকের একজন হিসাবে গণ্য হতেন, তিনি খ্রিস্টপূর্ব ছয় শতকে এথেন্সে প্রথম বেশ্যালয় স্থাপন করেন। (তথ্যসূত্র: Cf. Herodotus, Book I, para 199)
চীনে পতিতাবৃত্তির ইতিহাস সুপ্রাচীন। ‘Fang Fu Ruan’ তাঁর লেখা ‘Sex in China’ বইয়ে লিখেছেন, “Ying-chi is the first independent prostitutes in Chinese history …” অর্থাৎ ‘Yang chi’ চীনের ইতিহাসে প্রথম স্বাধীন পতিতা। তাঁর খদ্দের ছিল, উচ্চ শ্রেনির ব্যাক্তিবর্গ। এছাড়া চিনে Tang (তাং) রাজবংশ একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বেশ্যাবৃত্তি চালু করেছিল। পরবর্তী Shang (সাঙ) রাজবংশ বিভিন্ন স্থান থেকে পতিতাদের সংগ্রহ করে ‘হাঙ চৌ’ শহরে বসবাসের ব্যবস্থা করে ফলে সেখানে বড় মাপের পতিতালয় তৈরি হয়। (তথ্যসূত্র: Sex in China; Fang Fu Ruan; Springer Science & Business Media, 31st Oct. 1991)
বিভিন্ন সূত্র অনুযায়ী, প্রাচীনকালে বহুভোগ্যা নারীদের কাজ যদিও ছিল একই, শরীর বিক্রি করা, তবু বেশ্যাবৃত্তির চরিত্রানুসারে তাদের নানাবিধ নামে উল্লেখ করা হত। প্রাচীনকালে “গণিকা” বলতে বোঝাত বহুভোগ্যা নারীকেই, অর্থাৎ দল বা দলবদ্ধ হয়ে যে নারী যাপন করে তিনিই গণিকা। যে নারী বেশ বা সাজসজ্জা দ্বারা পুরুষদের প্ররোচিত বা প্রলোভিত করে তাদের বলা হত ‘বেশ্যা’। আবার ‘বেশ’ শব্দের আদি অর্থ হল বাসস্থান, এই বিশেষ বাসস্থানে যে নারী বাস করেন তিনিই বেশ্যা। পণের বাজি রেখে সম্ভোগ করা নারীদের “পণ্যাঙ্গনা” বলা হত। ‘বারস্ত্রী’ তাঁরাই, যে নারীরা যুগপৎ মন্দিরের সেবাদাসী ও রাজা বা অমাত্য মর্যাদার রাজকর্মচারীদের ভোগ্যা হতেন। পরিচারিকা বা ক্রীতদাসী রক্ষিতারা হলেন “ভুজিয়া”। যে নারীর চরিত্রের পতন হয়েছে তিনি “পতিতা” ইত্যাদি।
এরপর আসে রক্ষিতার ধারণা। রক্ষিতা অর্থ প্রতিপালিতা, উপপত্নী। অর্থাৎ যাকে ভরণ-পোষণ-নিরাপত্তা দিয়ে রক্ষা করা হয় সেই-ই রক্ষিতা।
রক্ষিতা বা উপপত্নী গ্রহণের অনুশীলন চীন থেকে শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হলেও, মূলত উপপত্নী গ্রহণের অনুশীলন হাজারো বছর পূর্বে প্রাচীন মেসোপটেমিয়া এবং ব্যাবিলোনিয়ার সভ্যতায়ও দেখা যায়। প্রাচীনকালের রাজা বাদশাদের জন্য রক্ষিতা ছিল সাধারণ বিষয়।
হারেম, যার অর্থ অন্তঃপুর, অন্দরমহল, জেনানামহল, নিষিদ্ধ বা পবিত্র স্থান, সেখানে অবস্থান করতেন রাজা, সুলতান বা সম্রাটের স্ত্রীরা, উপপত্নীরা, অপ্রাপ্ত বয়স্ক পুত্র, অবিবাহিত কন্যা, মহিলা আত্মীয় এবং দাসীরা। এখানে রাজা বা রাজপুত্রদের বিনোদনের জন্য থাকত শত শত যুবতী নারীরা।
যে রাজা যত বেশি অভিজাত, ক্ষমতাশালী ও অর্থবিত্তের অধিকারী তার হারেমে নারীর সংখ্যাও তত বেশি থাকত। নারীদের পবিত্র স্থান হারেমে রাজা বা রাজপুত্র ছাড়া অন্য কোনো পুরুষের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ ছিল।
সেই আমলে যুদ্ধ সব সময় লেগেই থাকত। যুদ্ধে পরাজিত নারীদের দাসী হিসেবে, কখনো বিয়ে কিংবা উপঢৌকন হিসেবে হারেমে নিয়ে আসা হতো। অনেককে দাসী হিসাবে কিনে আনা হত। এরা সবাই রাজা বা সম্রাটের উপপত্নী হিসেবেই সারা জীবন কাটিয়ে দিত। ভাগ্য ভাল হলে কেউ কেউ রাজার স্ত্রী হওয়ার সুযোগ পেত।
যদিও বর্তমানে খ্রিস্টান ধর্মে রক্ষিতা বা উপপত্নী গ্রহণযোগ্য নয়, তবে ইহুদী ধর্মেও উপপত্নীর অনুমতি ছিল। ইহুদি চিন্তাবিদ মাইমোনাইডস বিশ্বাস করেন, উপপত্নীদের রাজাদের জন্য কঠোরভাবে সংরক্ষিত করে রাখা হত। ইসরাইলের প্রথম এবং গুরুত্বপূর্ন রাজা সম্রাট সলোমনের (১০১১-৯৩১ খ্রিস্টপূর্বাব্দ) ৭০০ স্ত্রী ছাড়াও ৩০০ উপপত্নী ছিল বলে জানা যায়।
এক সময় ইসলাম ধর্মেও ইসলামী নিয়ম ও শাসনের অধীনে, যুদ্ধবন্দী হিসাবে গৃহীত অমুসলিম নারী এবং ক্রীতদাস হিসেবে মূল্য দিয়ে ক্রয় করা নারীদের উপপত্নী বা রক্ষিতা হিসাবে গ্রহণের অনুমতি ছিল। প্রাক-ইসলামিক যুগে দাসী ক্রয় বিক্রয়ের একটি সামাজিক আইন ছিল। কিন্তু ইসলাম গ্রহণের পর সেই দাস নারীদের মুক্ত করা বা বিয়ের অনুমতি দেয়।
বিভিন্ন তথ্য অনুযায়ী, মুগল ও সুলতানি আমলেও হারেম প্রথা প্রচলিত ছিল। মুঘল হারেমে পাঁচ হাজার থেকে সাত হাজার নারীর অবস্থান ছিল বলে শোনা যায়। কথিত আছে, বাংলার সুলতান সিকান্দার শাহের হারেমে ১০ হাজার নারী ছিল। সম্রাটরা তাদের উপপত্নীদেরকে উপহার হিসেবে বিদেশি শাসকের কাছে আদান-প্রদান করতে পারতেন।
সে সব রক্ষিতাদের অনেক কিছুতেই ছিল বাধ্যবাধকতা। প্রাসাদের বাহিরে যাবার অনুমতি ছিল না তাদের। এমন কি অসুস্থ্ হলেও অন্য দাসদের চিকিৎসকের কাছে পাঠিয়ে পরামর্শ নেয়া হত এবং প্রাসাদ এর ভিতরে অন্দরমহলে থেকে চিকিৎসা চলত।
ইতিহাসে এমন অনেক আরো প্রমান রয়ছে যেখানে নজর দিলে আমরা দেখতে পাই যে, আদিকাল থেকে আজ পর্যন্ত নারীদের সবসময় ভোগের পন্যই মনে করা হয়েছে। ইতিহাস তা-ই বলে।
এসডব্লিউএসএস/২০২৫
আপনার মতামত জানানঃ