চীনের আলীবাবা একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেল বা প্রোগ্রাম তৈরি করেন। ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘রিডিং’ ও ‘কম্প্রিহেনশন’ পরীক্ষায় মানুষকে হারিয়ে দেয় ওই প্রোগ্রাম। ওই পরীক্ষায় আলিবাবার ইনস্টিটিউট অব ডাটা সায়েন্স অব টেকনোলজির ডিপ নিউরাল নেটওয়ার্ক মডেলটির স্কোর ছিল ৮২ দশমিক ৪৪ আর প্রতিপক্ষ হিসেবে মানুষের স্কোর ছিল ৮২ দশমিক ৩০।
মানুষকে হারিয়ে দেওয়ার এই ঘটনার তাৎপর্য বুঝতে আজ আমরা জানব, মানুষের ব্রেইন কিভাবে কাজ করে৷ আর এর মাধ্যমে আমরা বুঝতে পারবো, কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের স্থান দখল করে নিচ্ছে। বর্তমান সময়ে পুরো পৃথিবীর মানুষ ভেঙে পড়েছে চ্যাট-জিপিটি নামের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন একটি চ্যাটবটের ওপর৷ আর মানুষের এই প্রবনতাই মানুষের অস্তিত্বকে হুমকির মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে।
কারণ আমাদের ব্রেইনটাই আসলে আমরা। মানুষ বলতে এই ব্রেইনটাকেই বোঝানো হয়! এই ব্রেইনের কারণেই আমরা প্রকৃতির অন্যান্য প্রাণীদের থেকে আলাদা৷ আবার মানুষের ভেতরও নানান ক্যাপাসিটির মানুষ হয় তার ব্রেইনের কারণে৷
একটি উদাহরণ দিলে বুঝতে আরো সহজ হতে পারে৷ ধরুন, আজ ৩টি শিশুর জন্ম হয়েছে৷ প্রথম শিশুটিকে আপনি একটি বাড়িতে আটকে রেখে সেখানেই বড় করলেন৷ তাকে খাওয়া দিলেন, পোষাক দিলেন, কিন্তু আর কিছুই করলেন না; কারো সাথে তার যোগাযোগ নাই৷ দ্বিতীয় শিশুটিকে বাংলাদেশের কোনও একটি বস্তিতে রেখে এলেন৷ আর তৃতীয় শিশুটিকে উন্নত কোনো দেশে ভালো পরিবেশে লেখাপড়া এবং প্রযুক্তিগত সুবিধা দিলেন৷ ৩০ বছর পর এই শিশুরা যখন প্রাপ্তবয়ষ্ক হবে, কার অবস্থা কী হবে?
প্রথম শিশুটির শারীরিক বৃদ্ধি হবে৷ কিন্তু সে এই দুনিয়া সম্পর্কে কোনো ধারণাই থাকবে না৷ সে হবে হাবাগোবা টাইপের৷ কারণ, বয়সের সাথে সাথে তার ব্রেইনের বয়স বাড়েনি, বিকাশ হয়নি৷ দ্বিতীয় শিশুটি ওই বস্তিতে থেকে খেয়ে- পড়ে বেঁচে যাবে, কিন্তু লেখাপড়া তেমনটা হবে না৷ সে বর্তমান বিশ্বের সাথে নিজেকে তৈরি করার মতো অবস্থানে থাকবে না৷ তার ব্রেইন ভিন্নভাবে বিকশিত হয়েছে৷ আর শেষের শিশুটি যে যোগ্যতা নিয়ে বড় হবে, তার চিন্তা, চেতনা, মনন, লজিক – সব কিছুই ভিন্ন হবে৷ তার ক্যাপাসিটি ভিন্ন হবে৷ এই ৩ জনের শারীরিক গঠন প্রায় একই রকম থাকলেও, তারা ভিন্ন ভিন্ন মানুষ হবে, তার একমাত্র কারণ হলো তাদের ব্রেইন ভিন্ন৷
দেখবেন, মানুষ যখন বুড়ো হয়ে যায়, তার ব্রেইনটাও ধীরে ধীরে মরে যেতে থাকে৷ তখন মানুষটি একটি শিশুতে পরিণত হয়৷ তার লজিক কাজ করে না, ইমোশন নিয়ন্ত্রণে থাকে না, কিছুই মনে রাখতে পারে না, চারদিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে! সে তখন রক্ত মাংসের একটি পিন্ড ছাড়া আর কিছুই নয়!
যেভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মানুষের স্থান নিচ্ছে
মানুষের ব্রেইন যেভাবে কাজ করে, কম্পিউটারকে বানানো হয়েছে সেভাবেই৷ তার কম্পিউট করার ক্ষমতা আছে, মেমোরি আছে, ষ্টোরেজ আছে৷ সেই স্টোরেজ থেকে ডাটা নিয়ে সে বিভিন্ন রকমের প্যাটার্ন বের করতে পারে৷
দীর্ঘ দিন ধরেই কাজ হচ্ছিল এই কম্পিউটারগুলোকে যতটা সম্ভব মানুষের ব্রেইনের কাছাকাছি নিয়ে আসার৷ চ্যাট-জিপিটি আসার পর মানুষ নিশ্চিত হতে পেরেছে যে, কম্পিউটার এখন মানুষের মতো করেই ডাটা প্রসেস করতে পারে৷ তাকে মানুষের সমকক্ষ বলা যাবে৷ বিজ্ঞানীরা এই প্রথম সেটা মেনে নিয়েছেন৷
এই কম্পিউটারগুলো মানুষের ব্রেইনের মতো ডাটা যেমন প্রসেস করতে পারছে, পাশাপাশি সে মানুষের মতো ন্যাচারাল ল্যাংগুয়েজও নিজেকে প্রকাশ করতে পারছে৷ আপনি এতদিন গুগলে গিয়ে কোনো টপিক দিয়ে সার্চ দিলে, গুগল আপনাকে অসংখ্য ওয়েবসাইট হাতে ধরিয়ে দিতো, আপনি সেগুলো থেকে ক্লিক করে করে তথ্য খুঁজে নিতেন৷ এখন সেটা পাল্টে গেল৷
আপনি রোবটকে যা জিজ্ঞেস করবেন, সে তার মতো গুছিয়ে সুন্দর করে উত্তরটা আপনাকে জানিয়ে দেবে৷ আপনি পাল্টা প্রশ্ন করবেন, সে আবার উত্তর দেবে৷ এইভাবে আপনি যদি একটি মেশিনের সাথে সারা দিন কথা বলেন, আপনার একবারও মনে হবে না যে, আপনি আসলে একটি মেশিনের সাথে কথা বলছেন৷ আপনার কাছে মনে হবে, আপনি আরেকটি মানুষের সাথে কথা বলছেন, চ্যাট করছেন৷
এর অর্থ দাঁড়ালো এই যে, বুদ্ধির দিক থেকে নতুন এই কম্পিউটারগুলো এখন মানুষের মতোই আচরণ করতে সক্ষমতা অর্জন করেছে৷ শিশুকাল পেরিয়ে সে যেন যুবক হয়েছে৷ তারও ম্যাচিউরিটি এসেছে৷
আর কম্পিউটার যেহেতু মানুষের মতো ব্রেইন পেয়ে বসেছে, তাহলে সে অনেক কিছুই করতে পারছে, যেগুলো মানুষের কাজের মতো! সে এখন কবিতা লিখতে পারছে, রচনা লিখতে পারছে, পরীক্ষার খাতার উত্তর দিতে পারছে, স্কুলের শিক্ষককে বোকা বানাতে পারছে, ডেটিং অ্যাপে বসে সম্ভাব্য প্রেমিকার সাথে অন্তরঙ্গ চ্যাট করতে পারছে (যেখানে অপরপক্ষ বুঝতেই পারবে না যে, সে তার আসল পার্টনারের সাথে চ্যাট করছে না), চাকরির জন্য ভালো রিজিউমি তৈরি করে রিক্রুটারকে বোকা বানাতে পারবে, পাসওয়ার্ড চুরির জন্য ফিশিং ই-মেইল পাঠাতে পারবে, এমনকি কম্পিউটার ভাইরাস লেখার মতো কাজও খুব নিখুঁতভাবে করে দিতে পারছে৷
সে এমন একটি কবিতা লিখে দিতে পারে, যা পড়ে আপনার প্রেমিকার মন গলে যাবে; সে এমন সুন্দর করে একটি রচনা লিখে দিতে পারে যা পড়ে শিক্ষক হা করে তাকিয়ে থাকবে, কিংবা সে এমন একটি বিজনেস পরিকল্পনা দেবে যা এমবিএ ক্লাসের শিক্ষকরাও দিতে পারবে না৷
এগুলো সবই হলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার খেলা৷ বর্তমান পৃথিবী সত্যিকার অর্থেই সেই দুনিয়ায় প্রবেশ করে গেল! তাহলে সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন আসে, ভবিষ্যতের পৃথিবীটা কেমন হতে যাচ্ছে? মানুষ কি তাহলে সত্যিই হয়ে যাবে মেশিনের দাস?
মানুষ কিন্তু এমনিতেই ধীরে ধীরে মেশিনের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছিল৷ সেটা হুট করেই আজকে ঘটেনি৷ খুব বেশি দূরে গেলাম না, যখন থেকে মানুষ আধুনিক ক্যালকুলেটর ব্যবহার করতে শুরু করলো, তখন থেকেই তার ব্রেইনের অনেক কিছুই মেশিনকে দিয়ে দিতে শুরু করলো৷ এবং অনেক ক্ষেত্রেই মানুষের ব্রেইনের চেয়ে মেশিন ভালো কাজ করে থাকে৷
চ্যাট-জিপিটি’র মতো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যখন আরো প্রসার হবে, তাতে বর্তমান পৃথিবীর অনেক কিছুই পাল্টে যাবে৷ একই সাথে এই পৃথিবীর বর্তমান জনসংখ্যা হলো ৮০০ কোটি৷ তাদেরকে সঠিকভাবে সেবা দিতে, তাদের জীবনের মান উন্নত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকল্প নেই৷ আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম তাদের জন্মের পর থেকেই এর ভেতর দিয়ে বেড়ে উঠবে৷ তারা ভিন্ন ধরনের একটা জীবন যাপন করবে, যা এখানে লিখলে সায়েন্স ফিকশন মনে হতে পারে! আমরা আছি সেই দ্রুত পরিবর্তনের পথ চলার যাত্রী হয়ে!
এসডব্লিউএসএস/১৩৪০
আপনার মতামত জানানঃ