প্রাচীনকালে ভারত, আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য, দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং ওশেনিয়ায় গহনা ও অন্যান্য ধরনের ব্যক্তিগত অলঙ্করণ হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হত ব্যাপকভাবে। প্রশান্ত আর ভারত মহাসাগরের অগভীর পানিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায় এই ‘সাইপ্রিয়া’ জাতের সামুদ্রিক শামুক বা ‘কড়ি’; একসময় হয়ে ওঠে বাংলার দাস ব্যবসার মূল হাতিয়ার।
প্রাচীনকাল থেকেই পূর্ব আফ্রিকা এবং ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশে মুদ্রা হিসেবে কড়ি ব্যবহৃত হতো। ধাতব মুদ্রার প্রচলন হওয়ার আগের যুগ ছিল কড়ির যুগ। ‘সাইপ্রিমোনেটা’ বা ‘অর্থকড়ি’, ধাতব মুদ্রা প্রচলনের পরও বিনিময়ের মাধ্যম হিসাবে ব্যবহার হতো এবং ধাতব মুদ্রার পাশাপাশি একটি সমান্তরাল মুদ্রা ব্যবস্থা গঠন করেছিল।
প্রকৃতপক্ষে, উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে কেউ যদি ভারতের একজন ব্যবসায়ী হতো, বিশেষ করে তৎকালীন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি এবং মালাবার উপকূলীয় অঞ্চলে, তাহলে এই চকচকে শামুকের খোল দিয়ে বিলাসী পণ্য কিনতে খুব একটা ঝামেলা করতে হতো না।
পারস্য থেকে আসা পর্যটক সুলায়মান আল তাজির, তারপর আল মাসুদি (৯৪৩ খ্রিস্টাব্দ) এবং পরবর্তীতে একাদশ শতাব্দীর পলিম্যাথ আল বিরুনি (১০২০ খ্রিস্টাব্দ) ভারতের মুদ্রা হিসেবে কড়ির উল্লেখ করেছিলেন। ইবনে বতুতাও ১৩৪৩ সালের দিকে যখন মালদ্বীপে পৌঁছান এবং ১৮ মাস দ্বীপপুঞ্জে থাকেন, তখনও কড়ির ব্যবহার ও ব্যবসা প্রত্যক্ষ করেন।
১৮০৫ সাল পর্যন্ত ভারতের পূর্ব উপকূলে ছড়িয়ে থাকা বাণিজ্য বন্দরগুলোতে কড়িই ছিল প্রধান মুদ্রা। এরপর ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি একে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। কেবল উড়িষ্যাতেই নয়, বাংলাতেও মুদ্রা হিসেবে ব্যবহৃত হতো কড়ি। ৯৪৩ থেকে ১৮৩৩ সাল পর্যন্ত প্রায় ৯০০ বছর ধরে বাংলা মালদ্বীপের সাথে বাণিজ্য করতো
কেবল কড়ি সংগ্রহের জন্য। মালদ্বীপ ছিল এই অঞ্চলের কড়ি উৎপাদনের বৃহত্তম কেন্দ্র এবং বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের ব্যবসায়ীরা এই কড়ি পাওয়ার বিনিময়ে তাদের কাছে চাল, মশলা এবং রেশম বিনিময় করতো।
ষোড়শ শতকে ইউরোপীয়রা যখন ভারতীয় উপকূলে দাস ব্যবসা শুরু করে তখন কড়ির চাহিদা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায়। পর্তুগিজ, ওলন্দাজ, ফরাসি এবং ইংরেজদের আফ্রিকার দালালদের কাছ থেকে থেকে ক্রীতদাস কেনার জন্য মালদ্বীপের কড়ির প্রয়োজন ছিল।
লাভজনক সুযোগ খুঁজে পেয়ে বাংলার ব্যবসায়ীরা ইউরোপীয়দের কাছে বিক্রির জন্য মালদ্বীপের কাছ থেকে কড়ি সংগ্রহ করতে শুরু করে। ফলে কলকাতা হয়ে ওঠে এক গুরুত্বপূর্ণ দাস বাণিজ্য বন্দর।
অনলাইনভিত্তিক মুদ্রা ক্যাটালগ নুমিস্তার মতে, ১৮২১ খ্রিস্টাব্দে ১ রুপির সমান ছিল ২,৫৬০টি কড়ি। অর্থনৈতিক ইতিহাসের একটি আকর্ষণীয় অধ্যায় হিসেবে মালদ্বীপের কড়িশিল্পের নাম জোরেশোরেই উচ্চারিত হবে, যেটি পশ্চিম আফ্রিকা এবং বাংলার প্রধান মুদ্রা হয়ে উঠেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে প্রতি বছর ৩০ হাজার রুপির সমান কড়ি আমদানি করা হতো।
বাংলা থেকে বহুদূরে, ভারতে কয়েকটি কড়ি দিয়েই একটি গরু কেনা যেত, অন্যদিকে কড়ি উৎপাদনের কেন্দ্রস্থল মালদ্বীপে কয়েক লক্ষ কড়ির দাম ছিল মাত্র একটি সোনার দিনারের সমান। ক্রীতদাস ব্যবসায়ীরা একজন আফ্রিকান ক্রীতদাস কেনার জন্য প্রায় ২৫ হাজার কড়ি প্রদান করতো।
বাংলা অঞ্চলে পুরুষ ক্রীতদাসদেরকে দিয়ে জমিতে কৃষক হিসেবে আর গৃহস্থালির কাজ করানো হতো। অন্যদিকে, নারী ক্রীতদাসদেরকে প্রায়ই তাদের মালিকদের সাথে শারীরিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বাধ্য করা হত। ক্রীতদাসরা মালিকের সামাজিক মর্যাদারও একটি চিহ্ন ছিল। যত বেশি দাস, তত বেশি সম্পদ এবং সমৃদ্ধির চিহ্ন।
ক্রীতদাস বা ক্রীতদাস মালিকদের মধ্যে ধর্ম নিয়ে তেমন চিন্তা করতে দেখা যেত না। হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়কেই সমানতালে ক্রীতদাসে রূপান্তরিত করা হয়েছিল। হিন্দু মালিকরা তাদের দাসদের ডাকতো ‘দাস’ বা ‘ক্রীতদাস’ নামে, অন্যদিকে মুসলমান মালিকরা তাদের দাসদেরকে ডাকতো ‘গোলাম’ বা ‘নফর’ নামে। ধনী এবং প্রভাবশালী অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানদের উইলেও দাসদের উল্লেখ পাওয়া যায়, যা প্রমাণ করে বাংলায় দাসত্ব ছিল সর্বব্যাপী।
দাস ব্যবসার সমস্ত বেচাকেনা হতো মূলত কড়ির মাধ্যমেই। ১৮৩৪ সালে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে ব্রিটেন এবং তাদের সবগুলো উপনিবেশে দাসপ্রথা বিলুপ্ত করার ঘোষণা দেয়। এর ফলে বাংলার দাস ব্যবসা মারাত্মকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। তাছাড়া ১৮৩০ সাল নাগাদ ধাতব মুদ্রা বাংলায় ভালোভাবে প্রচলন শুরু হওয়ার পর থেকে অর্থ হিসেবে কড়িকে প্রতিস্থাপন করতে শুরু করে।
যা-ই হোক, ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনেকেই, যারা দাস ব্যবসাকে প্রথম থেকেই বৈধতা দিয়ে আসছিল এবং সরাসরি অংশ নিয়েছিল, তারা তাদের স্বার্থে আঘাত লাগায় এই আইনের বিরোধিতা করে। যেমন: গভর্নর-জেনারেল লর্ড অকল্যান্ড যুক্তি দেখায়, “দাস ব্যবসা দাস এবং প্রভু উভয়ের জন্যই ‘পারস্পরিক সুবিধা’ প্রদান করে।”
এসব কারণেই আইন প্রণয়নের পরেও বাংলায় দাসপ্রথা বিলোপ হতে বহু দশক সময় লেগে যায়। তবে, দাসপ্রথার চূড়ান্ত বিলুপ্তির ভিত্তি স্থাপন করে এই আইন। ক্রীতদাসদের আমদানি ও রপ্তানি অবৈধ করা ছিল এই সামাজিক ও মানবিক অপরাধ নির্মূলের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ এবং শেষ পর্যন্ত তা সফল হয়।
এসডব্লিউএসএস/১০৩৫
আপনার মতামত জানানঃ