হোমো স্যাপিয়েন্সের উদ্ভবের পর থেকেই প্রাকৃতিক নির্বাচনের কারণে আমাদের পূর্বপুরুষেরা পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়েছেন। এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে জিনগত বিবর্তন। জেনেটিক এই রূপান্তরের কারণেই বর্তমান মানুষের আবির্ভাব। তবে এক গবেষণায় দেখা গেছে, আধুনিককালের পৃথিবীতে মানুষের বিবর্তন শুধু জিনের ওপর নির্ভরশীল নয়। বরং জেনেটিক রূপান্তরের চেয়ে সংস্কৃতিই মানব বিবর্তনকে ত্বরান্বিত করছে। মূলত এই দুইটি বিষয়ের উপরেই নির্ভর করছে বর্তমান মানুষের বিবর্তন। পাশাপাশি এই দুইটি বিষয়ে সমন্বয়ে আমরা ধারণা করে নিতে পারি কেমন হতে চলেছে ভবিষ্যতে মানুষের বিবর্তন।
এবার, মানুষের বিবর্তন এখনও হচ্ছে নাকি বিবর্তন থেমে গেছে প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার আগে চলুন মুখোমুখি হওয়া যাক অন্য একটি প্রশ্নের। আর সেটি হল, যদি বিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষ আসে, তাহলে মানুষ থেকে কেনও বিবর্তিত নতুন কোনও প্রাণীর সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে না?
এর উত্তর, বিবর্তন ঘটেই চলেছে, কিন্তু বিবর্তনে একটা প্রাণী এতটাই বদল হয়ে গেছে যে সে যাদের থেকে এসেছে তাদের সাথে আর প্রজনন করতে পারছেনা এমন অবস্থা হতে লাগে বহু নিযুত বা কোটি বছর। মানুষ আর শিম্পাঞ্জি এক সময় একই প্রাণী ছিল, কিন্তু এদের দুটো দল ৭০ লাখ থেক ৯০ লাখ বা আরো বেশি বছর ধরে পরস্পরের থেকে আলাদা ভাবে বির্বতিত হয়ে এতোটাই বদল হয়ে গেছে যে মানুষ আর শিম্পাঞ্জি এখন আর প্রজনন সঙ্গী হতে পারেনা।
ন্যাচারাল সিলেকশন জিনিসটা দেখলে একই প্রজাতির মানুষ (যারা প্রজননের সঙ্গী হতে পারে) কত বদল হয়েছে কালো আর সাদা লোক দেখে কিছুটা আন্দাজ করা যায়। গরম অঞ্চলে কড়া রোদে চামড়া পুড়ে ক্যন্সার হয়ে মারা যাবে যদি লোকের চামড়া সাদা হয়, যাতে মেলানিন থাকে খুব কম। আপনি যদি সাহারা মরুভূমিতে ১০০০ কালো চামড়া আর ১০০০ সাদা চামড়ার লোক রেখে যান, আর তারা যদি কোন টেকনোলজি দিয়ে প্রকৃতির নিয়ম লঙ্ঘন না করেন (যদি ছাতা ব্যাবহার না করে), তাওলে ১ লাখ বছর পরে ফিরে আসেন, দেখবেন সাদা মানুষেরা সব মরে গেছে কিন্তু কালো মানুষেরা মরেনি। কড়া রোদে সাদা চামড়ার লোক বেশি মারা যাবে, এই হলো কারণ। আবার বরফের দেশে যদি একই পরীক্ষা করেন, দশ লাখ বছরে পরে এসে দেখবেন কালো মানুষেরা মরে গেছে কিন্তু সাদা মানুষেরা মরেনি।
যেহেতু মানুষ এসেছে খুব অল্প সময় আগে, তার বিবর্তন দেখার সুযোগ এখনও আসেনি। আপনি বরং অতীত ইতিহাস থেকে দেখে নিতে পারেন যে গত চল্লিশ লাখ বছরে মানুষ যথেষ্ট পরিমাণে বদলে গেছে। তারা মানুষই রয়ে গেছে, কিন্তু তবু তাদের মাঝে ঘটে গেছে বিস্তর পার্থক্য।
বিবর্তন এখনো হচ্ছে নাকি থেমে গেছে এর সাথে প্রাসঙ্গিক আরও একটি প্রশ্ন হচ্ছে, যদি মানুষের বিবর্তন বানর বা এপ থেকে হয় তাহলে এখনো কেন বানর/এপ আছে? তারা কেন বিবর্তিত হয়নি?
এর উত্তর অত্যন্ত সহজ এবং সরল। আর তা হল, মানুষ বানর বা এপ থেকে বিবর্তিত হয় নি। মানুষ এবং বানর বা এপের একক একটা পূর্বপুরুষ ছিল। যদি সময় যাত্রা করে আমরা কয়েক মিলিয়ন বছর অতীতে যেতে পারি তবে আমরা আমাদের এপ সদৃশ পূর্বপুরুষদের দেখতে পাবো। এদের জনসংখ্যা কয়েকটি ধারায় বিভক্ত হয়েছিল আর বিবর্তনের ভিন্ন ভিন্ন পথে যাত্রা শুরু করেছিল। একটা ধারায় আসা সর্বশেষ প্রাণী আমরা, আরেকটা ধারার সর্বশেষ প্রাণী শিম্পাঞ্জী।
এবার আসা যাক প্রকৃত প্রশ্নে। আর প্রশ্নটা হল বিবর্তন কি হচ্ছে? আর হলে কিভাবে হচ্ছে? আর এই প্রশ্নের উত্তর হল, মূলত ৬ মিলিয়ন বছর ধরে চলে আসছে বিবর্তন। এর মধ্যে গত ২ দশমিক ৫ মিলিয়ন বছর থেকে পাথর সংস্কৃতির মধ্যদিয়ে এই প্রাগ-ইতিহাসের সূচনার অগ্রগতি হয়েছে সাম্রাজ্য, নগর ও শহরের মধ্য দিয়ে। ১ লাখ বছর ধরে মানুষের কাছাকাছি অন্যান্য যে এপস আছে এরা বিভিন্ন গোত্র উপগোত্রে বিভক্ত হয়েছে। এই বিভক্ত হওয়ার পেছনে সাগর, পাহার-পর্বত, পরবর্তীতে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের অনুঘটক কোথাও ভিন্ন ধরনের আবহাওয়া, দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাস-রুটিন, জীবনধারা তার বিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে।
অঞ্চল ও খাদ্যাভ্যাসভেদে আমরা মানুষের চেহারা আকৃতির গঠনেও বৈচিত্র্য লক্ষ্য করি। বিশেষ করে গত ১০ হাজার বছর ধরে এই বিবর্তন বেশ সক্রিয়। পরবর্তী সময়ে কৃষিভিত্তিক জীবন ও সভ্যতা গড়ে তোলায় এই পরিবর্তন নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এর পরবর্তীতে সভ্যতার উত্থান ও নব নব প্রযুক্তির আবিষ্কার সব মানুষকে আবার পরস্পরের কাছাকাছি করে দিয়েছে।
সংস্কৃতিক বিবর্তনও কিন্তু জিনেটিক বিবর্তনে বিপুল প্রভাব রাখতে পারে। আর এর সবথেকে বড় প্রমাণ আমাদের কৃষিকাজে যুক্ত হওয়া। নবোপলীয় সংস্কৃতিতে কৃষিভিত্তিক জীবন ব্যবস্থায় মানুষ যাযাবর জীবন থেকে স্থায়ী বসতি গড়েছে। ফলে নির্দিষ্ট কিছুদিন পরিশ্রম করে পরবর্তী দিনগুলোতে শুয়ে বসে আরামে দিন কাটাত। যা মানুষের হাড়ের ঘনত্ব কমিয়ে এনেছে। এখন বর্তমান সময় আমরা অনেক বেশি ডেস্কে বসে সময় পার করি, যা হয়ত আমাদের এই হাড়ের ক্ষয়মান আরও চলমান রাখবে। অন্যান্য এপ বা বানর প্রজাতির সাথে মানুষের কল্পনা করলে মানুষের মাসেলও কমে আসছে। বিশেষ করে আমাদের শরীরের উপরের অংশের।
আমাদের পূর্বপুরুষদের প্রাণী শিকার, শিকড় খনন করতে হতো, পরবর্তীতে তারা খেত খামারে খনন ও ফসল কাটত। কিন্তু বর্তমান চাকরি বলতে মানুষের সাথেই মানুষের বোঝাপড়া, শব্দের ব্যবহার, কোডিং এর ব্যবহার। এতে ব্রেইনের ওপর প্রেসার বাড়লেও শরীরের উপর বাড়ছে না। একথা কৃষক, মৎস্যজীবী, কাঠুরের বেলায়ও প্রযোজ্য। তারাও কাজের সহযোগিতায় মেশিন নির্ভর হচ্ছে। ট্রাকটর, হাইড্রোলিকস, চেইনশ এর উপর ভিত্তি করে তাদের কাজগুলো সম্পাদন করছে।
বর্তমানে শারীরিক শক্তির খুব একটা প্রয়োজন নাই, পেশীর ব্যবহার কমে যাওয়ায় আমাদের পেশীও হয়ত অদূর ভবিষ্যতে সঙ্কুচিত হয়ে আসবে। আমাদের চোয়াল এবং দাঁতও ছোট হয়ে আসছে। আগের তৃণভোজী মানুষের লতাপাতা ঘাস খেতে গিয়ে পেষণ দাঁত ও চোয়ালের ব্যবহার বেশি হতো, এরপর থেকে যখন মাংসভোজীতে ফিরল তখন রান্নাবান্নার কারণে দাঁত ও চোয়াল সঙ্কুচিত হয়ে এলো। বর্তমানে প্রস্তুতকৃত খাবার যেমন চিকেন বল, চিকেন নাগেট, বার্গার, আইসক্রিম এগুলো খেতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়ায় আমাদের চিবিয়ে খাওয়ার প্রয়োজন কমে গেছে। চোয়ালও চিকন হয়ে আসছে। এর মধ্য দিয়ে আমাদের দাঁত ও দাঁতের শক্তি কমে আসছে।
পাশাপাশি বর্তমান বিশ্বায়নে আমরা পৃথিবীর নানাপ্রান্তে নানা ধর্মের, বর্ণের, গোত্রের মানুষদের সঙ্গে দেখা করি, যা একধরনের নতুন হাইব্রিড জেনারেশন তৈরি করছে। আফ্রিকান, আমেরিকান, ইউরোপিয়ান, এশিয়ান, অস্ট্রেলিয়ানদের মধ্যে সংযোগ ঘটাচ্ছে। যা কিনা পরবর্তীতে আমাদের বিবাহিত জীবনের মধ্য দিয়েও বিবর্তন ঘটাবে।
কিছু বিজ্ঞানীরা মনে করছেন পৃথিবী আজ সভ্যতার সর্বোচ্চ শিখরে ধাবিত হচ্ছে। অতীতে যে অনুঘটকরা শক্তি, ক্ষমতা, নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় ছিল, বিশেষ করে- দূর্ভিক্ষ, মহামারী, যুদ্ধবাজ শিকারী প্রাণীদের মধ্যে সিংহ, নেকড়ে, মেছো বাঘ এরা এক সময় দাপুটে থাকলেও এখন প্রাণীগুলো সেই ক্ষমতা হারিয়েছে।
বর্তমানে সারের প্রয়োগে খাদ্য-শস্যের ব্যাপক উৎপাদন হচ্ছে। এর ফলে ক্ষুধা এবং দূর্ভিক্ষ অনেকটা পৃথিবীতে কমে এসেছে। পরিবার পরিকল্পনা বেড়েছে। তুলনামূলক ভায়োলেন্স ও যুদ্ধাবস্থা কমে এসেছে আগের সময়ের তুলনায়। মহামারী, গুটিবসন্ত, কালো জ্বর, কলেরার প্রতিষেধক হিসেবে ভ্যাকসিন, আ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়েছে। বেড়েছে পরিস্কার পানির ব্যবহার।
এর মধ্য দিয়ে বিবর্তন কিংবা পরিবর্তন থেমে যায়নি বরং তা প্রাকৃতিক দূর্যোগ কিংবা সমস্যাগুলো থেকে মুক্তি দিলেও অপরদিকে আমাদের নিজেদের তৈরি করা কৃত্রিম পরিবেশ- সংস্কৃতি, প্রযুক্তি, শহর এগুলো আবার আমাদের নতুন সংকট তৈরি করছে। মানুষের গড়া এই নতুন কৃত্রিম বিশ্বের সাথে মানুষেরই আবার নতুন করে খাপ খাওয়াতে হচ্ছে।
এটি আমাদের জানান দিচ্ছে যে বরফযুগ আন্তঃবরফ যুগের মতো এই সময়ে মানুষের তৈরি করা পৃথিবীতে মানুষকে আবার নতুন করে অভিযোজিত হতে হবে। এর প্রক্রিয়া ইতোমধ্যে শুরু হয়ে গেছে, আমাদের খাদ্যভ্যাস শস্য, দুগ্ধ যেগুলো খাই সবই প্রসেস ফুড খাওয়া প্রাণীদের মাধ্যমে, যা খেয়ে আমরা বেড়ে উঠছি। জনসংখ্যার ঘনত্বে রোগবালাই বাড়ছে,
কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মুতাসিম বিল্লাহ তার একটি নিবন্ধে লিখেছেন, কিছু কিছু কারণে আমাদের ব্রেইনের আকারও ছোট হয়ে আসছে। কৃত্রিম পরিবেশ আমাদের ন্যাচারাল সিলেকশন এর ভূমিকায় আবর্তিত হচ্ছে। আমাদের ও অন্যান্য প্রাণীদের মস্তিস্ক ছোট হয়ে আসছে। ইউরোপে যদি আমরা দেখি তাহলে ১০ হাজার-২০ হাজার বছর আগে যখন কিনা কৃষির বিকাশ ঘটেছে তখন থেকে আমাদের মস্তিস্ক ছোট হতে শুরু করেছে।
আমাদের প্রাচীন মানুষদের চেয়ে বর্তমান সময়ের মানুষদের মস্তিস্ক আরও ছোট হচ্ছে। কিন্তু কেন এমনটি হচ্ছে তা এখনও স্পষ্ট না। এমন হতে পারে ফ্যাট এবং প্রোটিনের ঘাটতি যেটি একসময় ছিল, পরবর্তীতে চাষাবাদে ফেরার কারণে বড় মস্তিস্ক ছোট হয়ে আসছে। ব্রেইনের ব্যবহার আমাদের দৈনন্দিন ২০ শতাংশ ক্যালরি ক্ষয় করে।
গত দুই শতকে পুষ্টি, ওষুধ, স্বাস্থ্যসম্মত জীবন যাপন করায় উন্নত দেশগুলোতে যুবকদের মৃত্যুহার ১ শতাংশে নেমে এসেছে। পুরো বিশ্বজুড়ে গড় আয়ু ৭০ বছর যেটি উন্নত দেশে ৮০ বছরে পৌঁছেছে। এটি সম্ভব হয়েছে স্বাস্থ্যসুরক্ষার কারণে, বিবর্তনের কারণে নয়। কিন্তু এই ঘটনাটি বিবর্তনে ভূমিকা রাখছে।
অস্ট্রালোপিথেকাস আফরেনসিস এবং হোমো হ্যাবিলিস আকারে ছিল ছোট, উচ্চতায় ৪-৫ ফিট। পরবর্তীতে হোমো ইরেকটাস, নিয়ান্ডারথালস, হোমো স্যাপিয়েন্স তাদের উচ্চতা বেশি দেখি, ঐতিহাসিক যুগে এ উচ্চতা আমরা আরও বাড়তে দেখি, এর পেছনে অনুঘটক হিসেবে পুষ্টির একটা বড় ভূমিকা আছে।
কেন এমনটি বাড়ছে, এই পুরো ব্যাখ্যাটা এখনও পরিস্কার নয়, তবে দীর্ঘ জীবন মানুষের গ্রোথ বাড়াতে ভূমিকা রাখে। কিন্তু এক্ষেত্রে নারী ও পুরুষ উভয়ের ভূমিকা আছে। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে আকৃতিতে বড় মানুষদের পাওয়া যায় ইউরোপে, যারা কিনা নিয়ান্ডারথাল বংশধরদের প্রতিনিধিত্ব করছে। এদের পুরুষদের গড় উচ্চতা ৬ ফিট, মেয়েদের ৫ ফিট ৬ ইঞ্চি। হয়তো অদূর ভবিষ্যতে মানুষ আরও বেশি লম্বা হতে পারে।
যদি মানুষ সাংস্কৃতিকভাবে আলাদা হয়, ধর্ম, শ্রেণি, জাত, এমনকি রাজনীতিও মানুষকে আলাদা করতে পারে। এইচ.জি ওয়েলস তার উপন্যাসে লিখেছিলেন, ভবিষ্যতে শ্রেণিভিত্তিক মানুষের বিবর্তন ঘটবে। উচ্চবিত্তকে দেখতে সুন্দর দেখাবে, নিম্নবিত্তকে দেখাবে কুৎসিত।
অতীতে আমরা দেখেছি ধর্ম ও জীবনধারা মানুষকে জেনেটিক্যালি পার্থক্য করেছে। উদাহরণ হিসেবে ইহুদি ও জিপসি পপুলেশনকে বলা যায়। বর্তমানে রাজনীতি আমাদেরকে পরস্পরের কাছ থেকে আলাদা করে দেয়। উদারমনা মানুষ আরেকজন উদারমনার কাছে যায়। রক্ষণশীল যায় রক্ষণশীলের কাছে। সংস্কৃতি যত বৈচিত্র্যময় হবে মানুষ জেনেটিকভাবে তত বেশি বৈচিত্র্যময় হতে পারে।
ভবিষ্যত সম্পর্কে দ্য কনভারসেশন এ প্যালিওঅনটোলোজিস্ট-ইভোলশনারি বায়োলোজিস্ট নিকোলাস এর প্রকাশিত আর্টিকেলে তিনি এ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করেছেন। তিনি ধারণা করেছেন ভবিষ্যতে মানুষ হয়ত আরও বেশি লম্বা হবে, আয়ু বাড়বে, কম আক্রমনাত্মক হবে, হাসি-খুশি থাকবে, আমরা হয়ত পরস্পর বন্ধুভাবাপন্ন হবো, কিন্তু দিন দিন হয়ত ব্রেইন সাইজ কমে আসবে।
বর্তমান দুনিয়ায় মানুষ বেশ কিছু বিষয়ের মুখোমুখি হয়েছে যে বিষয়ে তার অতীত অভিজ্ঞতা ছিল না। ওয়াদ্দাহ খানফার তার লেখায় এ বিষয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন। এর মধ্যে অন্যতম হলো, ‘স্থানের’ সাথে মানুষের সম্পর্কের ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছে। ইন্টারনেট এবং সোস্যাল মিডিয়া এসে ‘স্থান’ সম্পর্কে মানুষের ধারণা বদলে দিয়েছে। এখন মানুষ একই সময়ে ভৌগোলিক স্থানের পাশাপাশি বৈশ্বিক জায়গাতেও রয়েছে।
এরপর আরেকটি পরিবর্তন দেখা যায় ব্যক্তি ও শাসন ক্ষমতার মাঝে। এখন ভৌগোলিক সীমার উর্ধ্বে বিস্তৃত ইন্টারনেট দুনিয়া যে কাউকে বয়সের গন্ডিতে আটকে না রেখে ইন্টারনেটের প্রশস্ত পরিসরের নিয়ে এসেছে, তার সামনে নব নব দিগন্ত উন্মোচিত করেছে। এখন তাকে চাকরির পদ, গোত্রীয় পরিচয়, সামাজিক অবস্থান এমনকি তার প্রাচুর্য কোনো কিছুই বেধে রাখতে পারে না। আর ইন্টারনেট দুনিয়া প্রাতিষ্ঠানিক নেতৃত্বের চেয়ে ব্যক্তি নেতৃত্বের বিকাশ বেশি করে।
শিক্ষার ক্ষেত্রেও বিপ্লবসাধিত হয়েছে। জ্ঞান ও তথ্যের অভূতপূর্ব সরবরাহ হয়েছে। বিভিন্ন প্লাটফর্ম থেকে খুব সহজেই দেশ বিদেশের গবেষণালদ্ধ জ্ঞান নেওয়ার সুযোগ ঘটেছে। এ সময়ে এসে প্রাকৃতিক ও মানবীয় জ্ঞানের পারস্পরিক সম্পর্ক জুড়েছে। বস্তুগত পরিস্থিতি থেকে ধীরে ধীরে জ্ঞান ও তথ্যমুখী হয়েছে। আর্টিফিসিয়াল ইন্টিলিজেন্স তথা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অভাবনীয় অগ্রগতি, জ্ঞানের সার্বজনীনতা এবং সাধারণ মানুষের মাঝে তার বিকাশ, নানা বিশেষায়িত জ্ঞানের সমন্বয়, অ্যাকাডেমিক আর্টিকেলের ক্ষেত্রে জাতীয় ভূমিকা ও অবদান-এসবই মানুষের অগ্রগতির এক অভূতপূর্ব পথ খুলে দিয়েছে। মানুষের মাঝে নতুন নীতি ও গুরুত্ব তৈরি করেছে।
অন্যতম আরেকটি পরিবর্তন হলো বস্তুর সাথে প্রাণের যোগ, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আবিস্কার যেমন ন্যানো টেকনোলজি, বায়োলজিক্যাল টেকনোলজি, আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, মেমোরি সংরক্ষণ, সাইকোলজিক্যাল নানা গবেষণাপত্র, পশু এবং মানুষের জীন আবিষ্কার, রোবট এবং কৃত্রিম অস্তিত্ব তৈরিতে তার সক্ষমতা ইত্যাদি। এই অভূতপূর্ব ঘটনা মানুষের বিবর্তনকে নতুন দিকে ধাবিত করবে। একশ্রেণীর মানুষ এই পরিবর্তনকে পুঁজি করে ক্ষমতার ছড়ি ঘুরাবে পৃথিবীর উপর। অন্যদিকে অন্য এক শ্রেণীর মানুষ, যারা টেকনোলজি থেকে দূরে থেকে নিজেদের বিকাশকে ভগবান করেছে বলে চুপচাপ বসে থাকবে, তারা হয়তো ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হবে কিংবা অভিযোজিত হবে নতুন ভাবে। কিন্তু তাদের পরিবর্তিত হতেই হবে। আর এমনই পরিবর্তন যদি বহুকাল ধরে চলে তাহলে সেটা হয়ে যাবে বিবর্তন। তাই বিবর্তন থামেনি। বিবর্তন থামবেও না।
এসডব্লিউএসএস/১৮৪৫
আপনার মতামত জানানঃ