সম্রাট লাগালজাগিসির আমলে অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব আনুমানিক ২৩৭৫ অব্দের দিকে স্বর্ণযুগ ছিল সুমেরের। তারপর ক্রমশ অবক্ষয় এবং আক্কাদিয় সম্রাট সারগনের মাধ্যমে বিস্তৃতি ঘটে আক্কাদিয় সাম্রাজ্যের। এক শতাব্দী পরে তা-ও স্তিমিত হতে থাকে।
সুমের এবং আক্কাদের মধ্যে রাজনৈতিক ঐক্য ছিল। তবে সুমেরিয় ভাষা ক্রমশ মলিন হতে থাকে। প্রাধ্যান্য হারাতে থাকে আন, এনলিল এবং ইয়ার মতো দেবতারাও। সেই স্থান দখল করে নিতে থাকে মারদুক, ইশতার এবং শামাস।
“বিশ্বজগতের সৃষ্টি কীভাবে?” সেই প্রশ্নের সুমেরিয়-আক্কাদিয় চিন্তায় উত্তর দিয়েছে এনুমা এলিশ। তিয়ামাত ছিলেন লোনাপানির দেবী আর আপসু মিঠা পানির দেবতা। তাদের সন্তান আনশার এবং কিশার। তাদের থেকে আকাশ দেবতা আনু এবং আনুর থেকে দেবতা ইয়া জন্মলাভ করে। তবে এনুমা এলিশের মূল আখ্যান দেবতা মারদুককে নিয়ে। দেবতা ইয়া আর দেবী দামকিনার সন্তান মারদুক।
বিশ্বজগতের প্রতি বিরক্ত হয়ে ওঠে আপসু। সিদ্ধান্ত নেয় সবকিছু ধ্বংস করে দেবে। সিদ্ধান্তটা তিয়ামাতকে আতঙ্কিত করলে জানিয়ে দেয় ইয়াসহ অন্যান্য দেবতাদের। ইয়াই অবশেষে আপসুকে ঘুম পাড়িয়ে হত্যা করে। কিন্তু তিয়ামাত এটা চায়নি। প্রতিশোধের সিদ্ধান্তে উন্মত্ত হয়ে ওঠে তাই। তার সাথে যোগ দেয় দেবতাদের কেউ কেউ। এবার কেবল ইয়া না; দেবলোকের অন্য দেবতারাও ভীত হয়ে ওঠে তিয়ামাতের ক্রোধ দেখে।
উপায়ন্তর না পেয়ে সকলে দ্বারস্থ হয় মারদুকের। দেবকূলের মধ্যে শীর্ষস্থান পাবার শর্তে শত্রুর মুখোমুখি হয় মারদুক। প্রবল রক্তক্ষয়ী সংঘাতের মাধ্যমে পরাজিত করে তিয়ামাত ও তার অনুসারীদের। মৃত তিয়ামাতের দেহ দুই ভাগ করে একভাগ দিয়ে আকাশ, আরেকভাগ দিয়ে জমিন তৈরি করে মারদুক।
শরীরের অন্যান্য অংশ দিয়ে প্রস্তুত হয় গ্রহ, তারা এবং স্বর্গ। তিয়ামাতের সহচর কিঙ্গুকে হত্যা করে সেই রক্ত দিয়ে তৈরি করা হয় মানুষ। মানুষ সৃষ্টি এবং মহাবিশ্বের উৎস সংক্রান্ত বেশ জটিল এই মিথ মেসোপটেমিয়ার পরবর্তী সংস্কৃতিতেও প্রচলিত হয়েছিল।
এদিকে, মানুষের উৎস ব্যাখ্যা করতে অন্তত চারটি বিবরণ বিদ্যমান সুমেরিয় ঐতিহ্যে। তাদের পার্থক্যও এত বেশি যে, মনে হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন চারটি সংস্কৃতি সহাবস্থানে ছিলো।
প্রথম মিথ অনুসারে, আদি মানব উদ্ভিদের মতোই মাটি থেকে অঙ্কুরিত হয়েছে। দ্বিতীয় মিথ আরো সমৃদ্ধ। স্বর্গের শিল্পীরা মানুষকে তৈরি করেছে কাদামাটি দ্বারা। তারপর দেবী নামমু তৈরি করেছে হৃদয় আর দেবতা এনকি ফুঁকে দিয়েছেন প্রাণ। তৃতীয় মিথে আদিমানবকে সৃষ্টি করেছেন দেবী আরুরু। চতুর্থ সংস্করণ অনুসারে দুই লাহমা দেবতার রক্ত থেকে বিশেষ উদ্দেশ্য সম্পাদনের জন্য সৃষ্ট মানবজাতি। শেষ বর্ণনাই বিবর্তিত ব্যাখ্যায় বিখ্যাত হয় ব্যাবিলন আমলে।
সুমেরিয় মিথের অন্তত দুটো সংস্করণেই মানবসৃষ্টির মূল উদ্দেশ্য দেবতাদের সেবা করা। দেবতাদের উদ্দেশ্যে উপাসনা, উপঢৌকন এবং বলি দেয়া। নববর্ষ, ফসল উত্তোলন এবং অন্যান্য সামষ্টিক উৎসবে অংশগ্রহণ করা। মানুষ কেবল দেবতাদের সেবক নয়, তাদের প্রতিনিধি এবং অনুকরণকারীও।
যেহেতু দেবতারাই সৃষ্টিজগতের পরম সিদ্ধান্তের হর্তাকর্তা, মানুষকে সেই আইন অনুসারেই চলতে হবে। এই আনুগত্যেই পাপ আর পূণ্যের ধারণা নিহিত। মানুষের অপকর্ম আর অবাধ্যতায় বারবার কলুষিত হয়েছে দুনিয়া। নববর্ষের মর্তবা এখানেই। প্রতি নববর্ষে পৃথিবী দূষণমুক্ত হয়ে নতুনভাবে জেগে ওঠে। স্বর্গীয় শক্তির স্পর্শে নতুন উদ্যম পায় জমিন। এজন্যই সুমেরিয় ভাষায় নববর্ষ উৎসবকে আকাতিল বলা হতো, যার অর্থ পৃথিবীকে পুনরুজ্জীবিত করার শক্তি।
মন্দির প্রতিষ্ঠার প্রেক্ষাপট আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাজা গোদিয়া স্বপ্নে দেখেন, দেবী নিদাবা তাকে নক্ষত্রের গুণাগুণ এবং নাম বোঝাচ্ছেন। একইসাথে একজন দেবতা প্রকাশ করছেন মন্দির নির্মাণের পরিকল্পনা। অর্থাৎ স্বর্গে যথারীতি মন্দির রয়েছে; জমিনে নির্মিত মন্দির মূলত তারই আদলে। সুমেরিয় জ্যোতির্বিদ্যা আর ধর্মচর্চা এভাবে একীভূত হয়ে গেছে।
সুমেরিয় সংস্কৃতিতে বেহেশত পরিচিত হতো দিলমুন নামে। সেখানে থাকে দেবতারা। মানুষের মৃত্যুর পরে আত্মা যায় পাতালে। যাদের শেষকৃত্য যথাযথভাবে হয়নি, সেই সব আত্মা দুনিয়ায় ফিরে এসে অত্যাচার করে। কবর সাধারণত দেয়া হতো বাড়ির পাশেই। ফলে প্রতিটি বাড়ির সাথেই সমাধিস্তম্ভ বিদ্যমান। মৃতের আত্মার উদ্দেশ্যে খাবার উৎসর্গের রীতিও অপ্রচলিত ছিল না। কবিরাজদের কর্মপ্রণালিও ছিল অনেকাংশেই ধর্মনির্ভর। নারী এবং পুরুষদের জন্য গৃহীত হতো ভিন্ন ব্যবস্থা।
এসডব্লিউএসএস/১৫০০
আপনার মতামত জানানঃ