অর্থ পাচার কিংবা অন্য কোনো অপরাধের প্রধান উপাদান হচ্ছে ব্যক্তি কিংবা ব্যক্তিদের স্বার্থ। এই যে ব্যক্তিস্বার্থ কিংবা গোষ্ঠীগত স্বার্থ, সেখানে ঢুকতে হলে অবশ্য শক্ত হতে হবে। যদি সেটা না হয়, তাহলে কিন্তু অর্থ পাচারকারীরা তাদের কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখবেন। যদি এটি হয়ে থাকে, সেটি ভীষণ দুঃখজনক। এ ব্যাপারে আমাদের সরকার যে খুব একটা মনোযোগী, সেটা বলা যাবে না। অর্থ পাচার রোধে সরকার যদি খুব শক্ত অবস্থান নেয়, তাহলে কিন্তু অর্থ পাচার অপরাধ ব্যাপকভাবে সংঘটিত হতে পারে না।- এমনটাই বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শফিক আহমেদ, যিনি আওয়ামী লীগ সরকারের আইনমন্ত্রী ছিলেন।
শফিক আহমেদ বলেন, অর্থ পাচারের ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় প্রশ্নটা হচ্ছে, অর্থ পাচার প্রতিরোধ করতে আমাদের সরকার কিংবা সরকারি যেসব সংস্থা দায়িত্বে আছে, তারা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করছে কি না। যদি সংস্থাগুলোর কর্তাব্যক্তিরা আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে থাকেন, তারা যদি চিহ্নিত করে থাকেন যে এ ধরনের অপরাধগুলো সংঘটিত হচ্ছে।
আর যারা এসব অপরাধ করছেন, তাদের যদি গ্রেপ্তার করে বিচারের মুখোমুখি করা যায়, তাদের যদি শাস্তি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়, তাহলে অপরাধ নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ধরনের উদ্যোগ যদি তারা না নেন, তাহলে তো দেশ থেকে অর্থ পাচার বন্ধ হবে না। সত্যিকার অর্থে যদি কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হয়, তাহলে অর্থ পাচার ঠেকানো সম্ভব। কিন্তু আমি মনে করি না, আমাদের দেশের সংস্থাগুলো গুরুত্বের সঙ্গে কাজগুলো করে।
আমি মনে করি, সরকারের একটা বিভাগ অর্থ পাচার ঠেকাতে মোটেও আন্তরিক নয়। তারা ভালোভাবে নজরদারি করছে না। অর্থ পাচার পুরোপুরি বন্ধ করা যদি উদ্দেশ্য না হয়, তাহলে তো অপরাধ সংঘটিত হবেই। নিবেদিতভাবে কাজটা করতে হবে। তা না হলে অর্থ পাচার ঠেকানো যাবে না।
কারণ, প্রত্যেকে একটা ইনটেনশন নিয়ে ঘোরেন। এই ইনটেনশন যদি থামাতে হয়, তাহলে আপনাকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে। এ অপরাধ ঠেকানো যাদের দায়িত্ব, তাদের সরকার জিজ্ঞাসা করুক, কেন অপরাধ থামানো যাচ্ছে না। সংস্থাগুলো বিস্তারিত তথ্য পর্যালোচনা করে ব্যর্থতার কারণগুলো চিহ্নিত করুক।
শফিক আহমেদ জানান, যারা ইতিমধ্যে অর্থ পাচার অপরাধ সংঘটিত করে ফেলেছেন, তারা কারা, সেটি আগে চিহ্নিত করা দরকার। তাদের বিরুদ্ধে এখনই আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া হোক। বাংলাদেশ থেকে যেসব অর্থ বিদেশে পাচার হয়েছে, সেই অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে সরকার বাধ্য। ব্যাপারটি সরকারকে অবিলম্বে শতভাগ গুরুত্বের সঙ্গে দেখা উচিত।
তিনি বলেন, যে দেশে টাকাটা পাচার হয়েছে, তথ্য আনতে হলে সেই দেশের সহযোগিতা লাগবে। রাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ের সহযোগিতায় বিদেশ থেকে অপরাধীদের তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করতে হবে। যারা করেছেন, তাদের শাস্তি পেতে হবে। সোজা কথা হচ্ছে, যারা অপরাধ করেছেন, তাদের তথ্য জোগাড় করা কঠিন কোনো কাজ নয়। দরকার শুধু সরকারি কর্মকর্তাদের আন্তরিকতা।
শফিক আহমেদের মতে, ইতিপূর্বে যারা অর্থ পাচার করেছেন, তাদের তো দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হচ্ছে না। যারা চিহ্নিত অর্থ পাচার অপরাধে জড়িত, তাদের যদি শাস্তি না হয়, তাহলে তো অন্যরা এ ধরনের অপরাধ করতে ভয় পাবেন না। সেটাই হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশে।
আইনি প্রক্রিয়ায় যদি একজনের শাস্তি হয়, তখন অন্যরা তা দেখে সতর্ক হন। কিন্তু যদি এমন হয়, অপরাধ করলে কিচ্ছু হবে না, তাহলে তো অপরাধ বন্ধ হবে না। বাংলাদেশে সেটাই হচ্ছে। সরকার যদি তাদের সুযোগ দেয়, তাহলে তো কোনোভাবে অপরাধ নিয়ন্ত্রণ হবে না।
পাশাপাশি তিনি বলেন, কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেওয়া যথাযথ নয় বলে আমি মনে করি। প্রশ্ন হচ্ছে, কেন একজন লোক কালোটাকা সাদা করার সুযোগ পাবেন? যারা কালোটাকা সাদা করেন, তাদের চিহ্নিত করুন। অন্যরা কে কী মনে করেন জানি না, আমি কালোটাকা সাদা করার বিপক্ষে। এটা মোটেও হওয়া উচিত নয়। অর্থ পাচার যদি ঠেকাতে হয়, তাহলে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ পুরোপুরি বাতিল করতে হবে।
শফিক আহমেদ বলেন, আমাদের দেশে বিদ্যমান যে আইন, তার সংস্কার প্রয়োজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা কীভাবে আইনটা ব্যবহার করছি, সেটা দেখার বিষয়। আমরা কতটা গুরুত্বের সঙ্গে আইন প্রয়োগ করছি, সেটি দেখার বিষয়। বিষয়টি আমরা কীভাবে দেখছি, সেটি কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ। যদি আইনের সঠিক প্রয়োগ হয়, তাহলে তো অপরাধ বন্ধ হয়ে যাবে। তা না হলে এটা কিন্তু থামবে না।
তিনি জানান, যারাই বাজার নিয়ন্ত্রণ করেন, তাদের অনেকেই বিদেশে টাকা পাচার করে নিয়ে যাচ্ছেন। সরকার যখনই সেটি জানতে পারবে, তখনই তো আইনগত পদক্ষেপ নেওয়া উচিত ছিল। দেশে কঠোরভাবে আইনের শাসন নেই। আইনের শাসন সত্যিকার অর্থে ব্যবহৃত হচ্ছে না। সোজা কথা হচ্ছে, আইনের শাসন তো এত লুজ হতে পারে না। যদি কঠোরভাবে আইনের শাসন প্রয়োগ করা হয়ে থাকত, তাহলে অর্থ পাচার নিয়ন্ত্রণে থাকত। কিন্তু সেটি হচ্ছে না বাংলাদেশে।
তার মতে, বাংলাদেশে বিচারহীনতার যে সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেছে, সেটি যদি সংশোধিত না হয়, তাহলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর নানা কুপ্রভাব পড়বে। আমাদের দেশে যা করণীয়, তা হচ্ছে না। যেটি করলে পরে রাষ্ট্রের উন্নয়ন হবে, সেটি তো হচ্ছে না। তাহলে আমরা কীভাবে বলতে পারি, সবকিছু ঠিকঠাক চলছে। রাষ্ট্রের নজরদারিতে থাকা উচিত, কাদের হাতে অঢেল সম্পদ রয়েছে। কার কাছে কত টাকা, সেটির একটি পূর্ণাঙ্গ তথ্যভান্ডার থাকা উচিত। এতে অর্থ পাচার অনেকখানি কমে আসবে।
যে যার খুশি মতো অবৈধ সম্পদ আয় করবেন, যে যার ইচ্ছেমতো বিদেশে অর্থ পাচার করবেন, সেটি তো হতে পারে না। লোকে যদি জানে, আমার যত সম্পদ, তা সরকারের জানা আছে, তখন তো তিনি সাবধান হবেন।
এসডব্লিউএসএস/১২৩০
আপনার মতামত জানানঃ