তিমি সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণী এই তিমি। যদিও পরিবেশের ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণে আশ্চর্য এ প্রাণীটি আজ বিলুপ্তির পথে। তবে কখনো কি ভেবে দেখেছেন, মহাসাগরে তিমি না থাকলে কি হতো? যদি কখনো তিমির অস্তিত্ব পৃথিবীর বুক থেকে মুছে যায়, তবে কি ঘটতে পারে?
এই প্রশ্নের উত্তর জানার আগে চলুন জানা যাক তিমির বিলুপ্তির কারণ। মূলত জাহাজের আনাগোনা, মৎস্যজীবীদের নানা রকম ফাঁদ। সব মিলিয়ে শিকারিদের হানা—এ সবেই ধীরে ধীরে বিপন্ন হয়ে উঠেছে ‘নর্থ অ্যাটলান্টিক রাইট হোয়েল’।
আমেরিকা এবং কানাডার সমুদ্র উপকূল ঘেঁষে নয় মাসে ছয় মাসে এই প্রজাতির দুই একটি তিমিকে দেখা গেলেও বিশেষজ্ঞদের দাবি, এই মুহূর্তে মোটে ৩৫০টিই বেঁচে রয়েছে।
৩৫০-এর মধ্যে প্রজননক্ষম মোটে ১০০টি তিমি। এবং দূষণ-সহ নানা কারণে এই প্রজাতির তিমিদের প্রসবের পর অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার ব্যবধান বাড়তে থাকায় তাদের অস্তিত্ব আরও সঙ্কটে পড়েছে।
সম্প্রতি ‘নর্থ অ্যাটলান্টিক রাইট হোয়েল’ প্রজাতির একটি ৪ বছরের তিমি মৃত্যুমুখে পড়েছে বলে জানিয়েছে ন্যাশনাল ওশেনিক অ্যান্ড অ্যাটমস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ)। তা নিয়ে আরও চিন্তায় পড়েছেন এনওএএ বিশেষজ্ঞরা। তাদের দাবি, তিমির বিরল প্রজাতিগুলির মধ্যে ঐ ৪ বছরের ছানাটির শীঘ্রই মৃত্যু হবে।
‘নর্থ অ্যাটলান্টিক রাইট হোয়েল’ প্রজাতির সংখ্যা ক্রমশ কমছে বলে জানিয়েছে এনওএএ। মূলত জাহাজের যাতায়াতের জেরে তিমিদের প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই সঙ্গে মৎস্যজীবীদের ছোড়া জালের ফাঁদে ফেঁসে যাচ্ছে তিমি। এমনই একটি দড়ির ফাঁদে আটকে পড়েছিল ওই তিমির ছানাটি।
এনওএএ-এর মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, স্ত্রীলিঙ্গের ঐ তিমিশাবকটিকে নর্থ ক্যারোলাইনার রোদান্তে উপকূলের ৩২ কিলোমিটার পূর্বদিকে দেখা গিয়েছে। তাদের দাবি, দড়ির ফাঁদে তিমিশাবকটি এমন ভাবে জড়িয়ে পড়েছে, সম্ভবত মৃত্যুই হবে সেটির।
সম্প্রতি ওই তিমিশাবকটিকে দেখতে পায় ফ্লরিডার স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা ‘ক্লিয়ারওয়াটার মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম’-এক সমীক্ষক দল। সাধারণত সামুদ্রিক প্রাণীদের উদ্ধার, পুনর্বাসনের কাজে জড়িত সংস্থাটি।
সমীক্ষকেরা জানিয়েছেন, ৮ জানুয়ারি আকাশপথে সমীক্ষা চালাতে গিয়ে দেখা যায়, তিমিশাবকটির লেজে, মুখে অসংখ্য দড়ি জড়িয়ে গিয়েছে। যার জেরে সেটির গোটা দেহ জুড়ে অজস্র ক্ষত তৈরি হয়েছে।
ওই ক্ষতগুলিতে অসংখ্য ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পরজীবী বা ‘তিমিউকুন’ও বাসা বেঁধেছে। এর জেরে তিমিটির হাল আরও সঙ্গিন হয়ে উঠেছে।
কীভাবে জানা গেল ওই তিমিশাবকটিই ‘নর্থ অ্যাটলান্টিক রাইট হোয়েল’ প্রজাতির? আমেরিকার সংবাদমাধ্যম ‘সিএনএন’ জানিয়েছে, এই প্রজাতির তিমিকে সমুদ্রের জলে কখন দেখা গিয়েছে, তার দিন ক্ষণ, ইতিহাস নথিবদ্ধ করছে ‘নিউ ইংল্যান্ড অ্যাকোয়ারিয়াম’ নামে এক সংস্থা।
এমনকি, এক-একটি সংখ্যার মাধ্যমে ওই তিমিগুলোর চিহ্নিতকরণের কাজ করেছেন তারা। ‘নিউ ইংল্যান্ড অ্যাকোয়ারিয়াম’-এর বিজ্ঞানীরা যেমন ঐ তিমিশাবকটিকে ৪৯০৪ নম্বর দিয়ে চিহ্নিত করেন। তাঁরা জানিয়েছেন, ৪৯০৪ নম্বর তিমিশাবকটি আসলে ‘স্পিন্ডল’ (১২০৪ নম্বর) নামে একটি পূর্ণবয়স্ক তিমির সন্তান।
সম্প্রতি জর্জিয়ার সেন্ট ক্যাথেরিনস দ্বীপে স্পিন্ডলকে তার অন্য একটি সন্তান-সহ দেখা গেছে। তবে গত বছরের মে মাসে ম্যাসাচুসেট্স উপকূলে ৪৯০৪ নম্বরের ঐ ৪ বছরের তিমিশাবকটিকে দেখা গিয়েছিল বলে জানিয়েছিল ‘নিউ ইংল্যান্ড অ্যাকোয়ারিয়াম’।
চলতি মাসে ৪৯০৪ নম্বরের তিমিশাবকটিকে ক্ষতবিক্ষত অবস্থায় দেখতে পান ‘ক্লিয়ারওয়াটার মেরিন অ্যাকোয়ারিয়াম’-এক সমীক্ষকেরা। তবে সেটির উদ্ধারে কোনও দলের সাহায্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
একটি বিবৃতিতে এনওএএ-এর বিজ্ঞানীরা বলেছেন, ‘বেলা গড়িয়ে যাওয়ায় ওই তিমিশাবকটিকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে পরিবেশ অনুকূল হলে সংশ্লিষ্ট আধিকারিকদের সঙ্গে মিলে সেটিকে অবস্থা জানার চেষ্টা করবে এনওএএ-এর মৎস্য বিভাগ। ঐ দড়ির ফাঁস ছাড়ানো সম্ভব কিনা, তারও চেষ্টা করা হবে। ঐ ক্ষতগুলোর জেরে হয়তো মৃত্যু হতে পারে তিমিশাবকটির।’
‘নর্থ অ্যাটলান্টিক রাইট হোয়েল’ প্রজাতির মধ্যে সম্প্রতি মৃত্যুহার বাড়ছে বলেও চিন্তায় পড়েছেন পরিবেশবিদ এবং বিজ্ঞানীরা। ২০১৭ সালে এনওএএ-এর মৎস্য বিভাগ জানিয়েছিল, আমেরিকা এবং কানাডা ঘেঁষে উত্তর অতলান্তিকে এই প্রজাতির তিমিদের মৃত্যু ও জখমের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়েছে।
এর পেছনে যে মৎস্যজীবীদের ফাঁদ এবং জাহাজ থেকে তিমির উপর হামলাই অনেকাংশে দায়ী, তা মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
এই প্রজাতির আরো একটি তিমির সম্ভাব্য মৃত্যুর দিকে এগোচ্ছে। একে অত্যন্ত দুঃসংবাদ বলে মনে করছে এনওএএ। তারা জানিয়েছে, ১০ বছর বয়সের পর প্রজননক্ষম হয় এই প্রজাতির তিমি।
তবে এক বার প্রসবের পর দ্বিতীয় বার অন্তঃসত্ত্বা হওয়ার মাঝে সাধারণত ৩ বছরের ব্যবধান থাকে। যদিও আজকাল তা বেড়ে ৬-১০ বছরে দাঁড়িয়েছে।
এনওএএ-এর দাবি, জাহাজের যাতায়াতের কারণে শব্দদূষণ, মানসিক কারণের পাশাপাশি খাবারের অভাবেও প্রজননে বাধা পাচ্ছে তিমিরা। শব্দদূষণের জেরে নিজেদের বাসস্থানের পথ খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় তিমিদের। এমনকি, এতে খাবারদাবার খুঁজে পাওয়া বা সঙ্গী চিহ্নিত করার ক্ষেত্রেও সমস্যায় পড়ে তারা।
এনওএএ-এর মতে, এই মুহূর্তে প্রজননক্ষম ‘নর্থ অ্যাটলান্টিক রাইট হোয়েল’ হয়েছে মোটে ১০০টি। তাদের সংখ্যা বাড়াতে বছরে ৫০টি বা তার বেশি সন্তানের জন্ম দিতে হবে তিমিদের।
তবে ২০১৭ সাল থেকে মোটে ৫৭টি এই প্রজাতির তিমি জন্মেছে। তার মধ্যে মাত্র ১৫টি তিমিশাবকের দেখা পাওয়া গিয়েছে ২০২১-’২২ মৌসুমে।
১৯৩৫ সালেই উত্তর অতলান্তিকে বাণিজ্যিক কারণে তিমিশিকারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তবে তার আগে থেকে এদের সংখ্যা কমছিল। যে পরিস্থিতির এখনও হেরফের হয়নি বলে দাবি এনওএএ-এর।
এবার চলুন জানা যাক, তিমি না থাকলে পরিবেশের উপর কী প্রভাব পড়বে। সম্প্রতি রয়টার্সের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখে নীল তিমি। দক্ষিণ মহাসাগরের স্পার্ম হোয়েল সাগরের পানিতে মলত্যাগের মাধ্যমে প্রচুর পরিমাণে কার্বন নিঃসরণ করে। এসব বর্জ্য পদার্থে আছে আয়রন, যা সাগরে প্ল্যাংকটন জন্মাতে সহায়তা করে।
তিমির শ্বাসত্যাগের মাধ্যমে যে কার্বন ডাইঅক্সাইড পানিতে মেশে তা আবার ফাইটোপ্ল্যাংকটন সালোকসংশ্লেষণ প্রক্রিয়ায় তাদের খাদ্য তৈরিতে ব্যবহার করে এবং শক্তি উৎপন্ন করে।
এক পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, একটি স্পার্ম হোয়েল বছরে প্রায় ৫০ টন মলত্যাগ করে। আবার একটি তিমি যে পরিমাণ কার্বন পরিবেশে ত্যাগ করে তার দ্বিগুণ পরিমাণ কার্বন তার মল দ্বারা শোষিত হয়।
২০১০ সালের হিসাব অনুযায়ী, দক্ষিণ মহাসাগরে তিমির সংখ্যা ছিল ১২ হাজার, যা প্রায় চার লাখ টন কার্বন শোষণ করেছে। অন্যভাবে বলতে গেলে, স্পার্ম হোয়েল তাদের অগোচরেই জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে চলেছে।
সায়েন্টিফিক আমেরিকান জার্নালের মতে, প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলসমূহেও তিমি পর্যাপ্ত কার্বন শোষন করে। তাই যদি তিমির সংখ্যা দিনদিন কমতে কমতে শূন্যের কোটায় নেমে আসে তাহলে সেটা হবে এ পৃথিবীর জন্য চরম অভিশাপ।
একটি বিজ্ঞান জাদুঘরের গবেষণা মতে, একটি তিমির মৃতদেহ সমুদ্রের প্রাণীদের ১০ বছরের খোরাক। মাত্র একটি তিমির মৃতদেহ সম্পূর্ণ ইকোসিস্টেমের খাবারের জোগান দিতে পারে। মাটিতে পচতে থাকা তিমির মৃতদেহ বহু ব্যাকটেরিয়া ও স্ক্যাভেঞ্জারের খাবারেরও উৎস।
এসডব্লিউএসএস/১৬৩০
আপনার মতামত জানানঃ