পৃথিবী তার গুটি গুটি পায়ে প্রযুক্তির কাঁধে চড়ার বাসনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে, অন্যদিকে প্রযুক্তিও নিজেকে বিস্তৃত করে চওড়া করে নিচ্ছে তার কাঁধ। ইতোমধ্যে অবশ্য পৃথিবী প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। আসলে প্রযুক্তিই এমন সব আশ্রয় মেলে ধরে যেখানে নির্ভরশীল না হয়ে পারা যায় না। আমাদের দৈনন্দিন প্রায় সমস্ত কাজেই রয়েছে প্রযুক্তির সরব এবং নিরব উপস্থিতি। বিশ্বের সমস্ত দেশই প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক দিয়ে নিজেকে সময়োপযোগী করার প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এক্ষেত্রে পিছিয়ে নেই বাংলাদেশও। প্রযুক্তির রঙ্গিন ছোঁয়ায় রঙ্গিন বাংলাদেশও এগিয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে। তবে সবকিছুরই রয়েছে পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া। প্রযুক্তি ব্যবহারে বিশ্বের অন্যান্য অনেক দেশ পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে এগিয়ে গেলেও বাংলাদেশ এই ক্ষেত্রে অনেকটাই তালচ্যুত। তবুও ধারণা করা হয়, বাংলাদেশ প্রযুক্তি ব্যবহারের দিক দিয়ে অনেকটাই দক্ষ হয়ে উঠছে।
বাংলাদেশ সরকার ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দিয়ে নতুন দেশ গড়ার পরিকল্পনা নিয়ে আগালেও তাদের গতি অতোটা চোখের পড়ার মতো নয়। বরং স্বাভাবিকের চেয়ে অনেকটাই পিছিয়ে ছিল তালে। অর্থাৎ প্রযুক্তি নামের জোয়ারটি যেভাবে আসার কথা ছিল, পৃথিবীর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের তুলনায় তা স্বল্পই বটে। তবে দেশে প্রযুক্তির বিস্তার এবং মানুষের প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে ওঠার পেছনে অধুনা উদ্ভব কোভিড-১৯ ভাইরাসটিই মূখ্যত ভূমিকা পালন করেছে। করোনা ভাইরাসের কারণে মানুষ যতো ঘরবন্ধী হয়েছে প্রযুক্তির বিকাশ এবং ব্যবহার ততোটা বেড়েছে। আগামী কয়েকবছর পরে প্রযুক্তির যে পরিবর্তনগুলো দেশের মধ্যে আশা করেছিলেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা, করোনার ধাক্কায় সেটি ঘটে গেছে চলতি বছরেই। অর্থনীতি, শিক্ষা, চিকিৎসা, ব্যবসা-বাণিজ্য, যোগযোগ সবকিছুতেই লেগেছে প্রযুক্তির ছোঁয়া। ঘরে বসেই চলছে অফিসের কাজ। প্রধানমন্ত্রীর মিটিং, ব্যাংক-বিমা, বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, কর্পোরেট কোম্পানিসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা গুরুত্বপূর্ণ মিটিং করছেন বাসায় বসে। শিক্ষার্থীদের ক্লাস-পরীক্ষা, ভর্তি, চাল-ডাল-সবজীসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য কেনা, অসুস্থ রোগীর চিকিৎসা কোনকিছুর জন্যই বের হতে হচ্ছে না ঘর থেকে। করোনাকালে বিচারকার্যও চলেছে ভার্চুয়াল জগতে। মানুষের জন্য ভয়ঙ্কর হয়ে দেখা দেয়া ভাইরাস আর্শিবাদ হিসেবে এসেছে প্রযুক্তি ক্ষেত্রে। করোনা পরিস্থিতিই বদলে দিয়েছে সবকিছু। আকস্মিক এক পরিস্থিতিতে বিপ্লব ঘটে গেছে প্রযুক্তির।
মহামারি করোনার ধাক্কায় মানুষ সবচেয়ে বেশি যে প্রযুক্তির নিকট গেছে সেটা হলো ই-কমার্স। করোনা কর্তৃক উদ্ভব পরিস্থিতিই আসলে ই-কমার্সের দিকে ঝুঁকে পড়ার প্রধানতম কারণ। বিশেষ করে লকডাউনে বসে মানুষ ই-কমার্সের মাধ্যমেই তার দৈনন্দিন নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সুবিধা গ্রহণ করেছে। বিগত বছরগুলোর তুলনায় তাই এবার ৫০ শতাংশ বেশি বিক্রি হয়েছে ই-কমার্সে। চলতি বছরে ই-কমার্স এসোসিয়েশনের অন্তর্ভূক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর মার্কেট আকার দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকার বেশি। যেটি চার বছর আগে ২০১৬ সালে ছিল মাত্র ৬৫০ কোটি টাকা। এর বাইরে এফ-কমার্স (ফেসবুক কমার্স), জেলা-উপজেলার ই-কমার্সগুলোর মার্কেটের আকারও কয়েক হাজার কোটি টাকা।
ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ই-ক্যাব) এর তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে বাংলাদেশে ই-কমার্স মার্কেটের আকার ছিল ৫৬০ কোটি টাকা, পরের বছর সেটি দাঁড়ায় ৮ হাজার ৬৩২ কোটি, ২০১৮ সালে ১০ হাজার ৫০৪ কোটি, ২০১৯ সালের ১৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। আর চলতি বছরে এটি দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকা।
প্রযুক্তির বিকাশ এবং ব্যবহার তো বাড়ছে কিন্তু আমাদের দেশে এর পর্যাপ্ত যোগান নেই। এই বিষয়ে প্রযুক্তিবিদেরা মনে করেন, যেভাবে হঠাৎ করেই প্রযুক্তি নির্ভরতা বেড়ে গেছে, তাতে প্রচলিত প্রযুক্তির পরিবর্তে উচ্চগতির ফাইবার ভিত্তিক কানেকটিভিটি বৃদ্ধি করতে হবে। করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেও টেলিমেডিসিন সেবা, দূরশিক্ষণ, অনলাইন প্রশিক্ষণ, বাণিজ্যিক সভা-সম্মেলন প্রভৃতি খাতে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও বিগডাটা প্রয়োগ বৃদ্ধি পাবে। এছাড়াও ই-কমার্স, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের ধারণ ক্ষমতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। তারা মনে করেন, বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে ৫-জি নেটওয়ার্ক এখন সময়ের দাবি। ৫জি এর জন্য টেলিকম কর্মকর্তাদের দক্ষ ও সক্ষম করে গড়ে তুলতে হবে। সারাদেশকে ফাইবার নেটওয়ার্কের আওতায় আনতে হবে।
তবে প্রযুক্তি ব্যবহারে বাংলাদেশ পিছিয়ে আছে কৃষি সংক্রান্ত ক্ষেত্রগুলোতে। চাষাবাদে পৃথিবীর অন্যান্য দেশগুলোতে প্রযুক্তির স্পর্শে উচ্চফলন অর্জন করলেও বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পিছিয়ে। চাষাবাদে এক ট্রাক্টর ব্যতিত অন্যকোনো যন্ত্রের ছোঁয়া একদমই চোখে পড়ার মতো নয়। ফলে জমি থেকে যতটা উৎপাদন আসা জরুরি ততোটা আসছে না। এদিকে মাছ চাষেও নেই তেমন কোনো উন্নতি। মাছ চাষ সংক্রান্ত সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প থাকলেও সেখানে রয়েছে প্রযুক্তির যথাযথ ব্যবহারের অভাব।
এদিকে প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন বেড়েছে তেমনি বেড়েছে এর পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়ামূলক ক্ষতিকর দিকটিও। প্রযুক্তির বিকাশে সংকুচিত হয়ে আসছে প্রকৃতি, জীব-বৈচিত্রে দেখা দিয়েছে গোলযোগ। প্রাণী উদ্ভিদ থেকে শুরু করে চারপাশের প্রাকৃতিক সমস্ত কিছুতেই পড়েছে ক্ষতিকর চোট। অনেকে ধারণা করে থাকেন, প্রযুক্তির আকস্মিক বিকাশে পৃথিবী এবং প্রকৃতির ওপর যে চোট পড়েছে, সেটার ধকল কাটানোর জন্যই করোনা ভাইরাসের উত্থান। যদিও করোনা ভাইরাসের উত্থান নিয়ে এই যুক্তি ধোপে টেকানোর মতো না। কিন্তু করোনার ফলে পৃথিবী এবং প্রকৃতি যেভাবে রোগ শোক বালা মছিবত ঝেরে-ঝুড়ে যেভাবে নতুন করে দাঁড়াবার প্রয়াস নিয়েছে, এতে ধারণা করাই যায়, পৃথিবীর সুস্থতার জন্যই আগমন ঘটেছে মহামারি এই রোগের।
অন্যান্য ক্ষেত্রগুলোতে বাংলাদেশ সরকার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দিকে যেভাবে নজর দিয়েছে, তেমনি নির্বিচারে মা-মাছ, ডলফিন নিধন, অবাধে জাল ফেলে মাছ শিকার, দখল-দূষণ-ভরাট, জীববৈচিত্র্য ধ্বংস, বালু উত্তোলন, ড্রেজার দিয়ে তলদেশে খোঁড়াখুঁড়ি, পোড়া তেল, রাসায়নিক, নদীতীরে গড়ে উঠা ট্যানারি-কাগজকল-পোলট্রি, বিদ্যুৎ কেন্দ্রসহ শিল্প-কারখানার বিষাক্ত বর্জ্য নিঃসরণ, উজানে পাহাড়ি জুম ও তামাক চাষের বর্জ্য ভেসে আসা, নদীপাড়ে বৃক্ষ নিধন, পানি নিয়ন্ত্রণ বাঁধ ও রাবারড্যাম নির্মাণ, নদীর বাঁক কেটে ফেলাসহ আরো অন্যান্য দিকে রয়েছে অবহেলা। ফলে একদিক উন্নত হচ্ছে তো দেবে যাচ্ছে অন্যদিক। এই বিষয়ে সামঞ্জস্যতা জরুরি বলে মনে করেন পরিবেশ এবং কৃষি সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা।
আপনার মতামত জানানঃ