রাতের বেলায় নিজের বিছানায় ঘুমাচ্ছেন নিশ্চিন্তে। এমন সময় কানের সামনে কেউ ফিস ফিস করে যদি নরকের গল্প শোনায়? আঁতকে ওঠাই স্বাভাবিক। তবে এই পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ হয়ে উঠবে, যদি এই দ্বিতীয় কণ্ঠস্বরটি আপনারই এক ভিন্ন সত্তা হয়ে থাকে।
না, ডিসঅ্যাসোসিয়েটিভ আইডেন্টিটি ডিসঅর্ডার বা ডিআইডির কথা হচ্ছে না। কথা হচ্ছে এমন এক বিরল ঘটনা নিয়ে, যেখানে একই মাথায় দেখা যায় দুটি মুখ। দুটিই স্বতন্ত্রভাবে কথা বলতে পারে, পারে ভাব প্রকাশ করতে।
চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ‘ডাইপ্রোসোপাস’। এই ল্যাটিন কথাটির অর্থ ‘দু’মুখো মানুষ’। তবে এই ঘটনাকে ‘পলিসেফালি’ ভাবলে ভুল হবে। পলিসেফালির ক্ষেত্রে একই ধরে দুটি ভিন্ন ভিন্ন মস্তিষ্ক দেখতে পাওয়া যায়। অন্যদিকে ডাইপ্রোসোপাসে ডিসঅর্ডারের ক্ষেত্রে একই মস্তিষ্ক বা করোটিতে দেখা যায় দুটি মুখ।
বিজ্ঞানের এই জটিল তত্ত্বাবলি পাশে সরিয়ে আপাতত ফিরে যাওয়া যাক মূল প্রসঙ্গে। এই গল্প ডাইপ্রোসোপাস নিয়ে নয়, বরং এমন এক ব্যক্তির যিনি আজীবন লড়াই চালিয়ে গেছেন দুটি ভিন্ন ভিন্ন সত্তা, মুখের সঙ্গে।
এডওয়ার্ড মরডেক। উনিশ শতকের শেষ দিক সেটা। ১৮৭১ কি ৮২ সাল। ব্রিটেনের এক অভিজাত পরিবারে জন্ম এডওয়ার্ডের। অবশ্য অভিজাত পরিবারে জন্মানোর পরও খুব একটা সুখকর ছিল না তার জীবন। আর তার অন্যতম কারণ হল তার দ্বিতীয় মুখ।
এডওয়ার্ড নিজে পুরুষ হলেও, মাথার ঠিক পিছন দিকে অবস্থিত এই দ্বিতীয় মুখমণ্ডলটা ছিল একটি মহিলার। স্বতন্ত্রভাবে এই দ্বিতীয় মুখটি হাসতে পারত, কাঁদতে পারত, এমনকি পিছনে অবস্থিত দুটি চোখ দিয়ে দেখতেও পারত সবকিছু। শুধু কথা বলতে পারত না।
তবে কথা বলতে পারত না বললে খানিক ভুল হবে। বলা ভালো, তার কথা কেবলমাত্র শুনতে পেতেন এডওয়ার্ড। সেই প্রসঙ্গে একটু পরে আসা যাবে।
এডওয়ার্ডের এই বিকৃত শারীরিক গঠনের কারণেই তার আড়ালে আলোচনা চলত পরিবারের মধ্যে। প্রতিবেশীরাও যে খুব একটা ভালো চোখে দেখতেন এডওয়ার্ডকে, তেমনটা নয়। সর্বত্রই যেন অভিশাপ বয়ে নিয়ে বেড়াতে হত এডওয়ার্ডকে। স্বাভাবিকভাবেই নিজেকে তাই পরিবারের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেন তিনি।
পারিবারিক বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে বসবাস শুরু করেন এক নির্জন বাগানবাড়িতে। এমনকি পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের সঙ্গেও দেখা-সাক্ষাৎ করতেন না তিনি। প্রিয়জন বলতে ছিল দুই চিকিৎসক। ডঃ জর্জ এম গোল্ড এবং ডেভিড পাইল।
অবশ্য বাড়ি থেকে দূরে চলে এসেও শাপমুক্তি হয়নি এডওয়ার্ডের। আর তার কারণ তার দ্বিতীয় মুখটিই। ডেভিড এবং গোল্ড— দুই চিকিৎসকের বয়ানই বলছে অভিব্যক্তি করতে পারলেও এডওয়ার্ডের দ্বিতীয় মুখটি কথা বলতে পারত না। এমনকি তার দ্বিতীয় মুখটি থেকে কোনোদিন কোনো শব্দ শোনেননি তার পরিবারের মানুষজনরাও।
তবে এডওয়ার্ড একাধিকবার তার চিকিৎসকদের কাছে জানিয়েছেন, ঘুমের সময় সারাক্ষণ কানে কানে ফিসফিস করে চলে তার এই দ্বিতীয় মুখটি। বলতে থাকে নরক এবং আশ্চর্য সব বিভীষিকাময় কাহিনি। শুধু ঘুমের মধ্যেই নয়, শেষের দিকে সারাদিনই নাকি এডওয়ার্ডকে এইসব রোমহর্ষকর ভয়ঙ্কর গল্প বলত তারই পরজীবী যমজ।
হ্যাঁ, চিকিৎসাবিদ্যার ভাষায় এ ধরনের যজমকে বলা হয় ‘প্যারাসাইটিক টুইন’ বা ‘পরজীবী যমজ’।
পরিস্থিতি এতটাই খারাপ হয়ে উঠেছিল যে শেষের দিকে এডওয়ার্ড একাধিকবার তার দুই চিকিৎসকের কাছেই অনুরোধ করেছেন অস্ত্রোপচার করে তাঁর দ্বিতীয় মুখটিকে বাদ দেওয়ার জন্য। একজন ভালো শিল্পী হওয়া সত্ত্বেও, দ্বিতীয় এই সত্তার বাড়বাড়ন্তে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার সঙ্গীতসাধনা, ছবি আঁকা, পড়াশোনা।
এমনকি স্বয়ং এডওয়ার্ড এই মুখটিকে তকমা দেন ‘ডেভিল ফেস’-এর। বলাই বাহুল্য, তার এই আশ্চর্য অনুরোধে সায় ছিল না চিকিৎসকদের। উপায়ন্ত না দেখে, এই অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে মাত্র ২৩ বছর বয়সে বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেন এডওয়ার্ড। চিঠি লিখে যান, তাকে সমাধিস্থ করার সময় যেন ধ্বংস করে দেওয়া হয় এই দ্বিতীয় মুখটিকে।
ডঃ গোল্ড তার ডায়েরিতে লিখেছেন, ‘(হিজ) সেকেন্ড ফেস ইজ লাভলি অ্যাস আ ড্রিম, হিডিয়াস অ্যাস আ ডেভিল’। অর্থাৎ, স্বপ্নের মতো সুন্দর আবার শয়তানের মতোই কুৎসিত। ১৮৯৩ সালে প্রথম তার এই কাহিনি আন্তর্জাতিক মঞ্চে জায়গা পায় ‘বস্টন সানডে’ নামের একটি মার্কিন পত্রিকায়।
তারপর ধীরে ধীরে একাধিক পত্রপত্রিকাতেও প্রকাশিত হতে থাকে তাঁর কাহিনি। তাছাড়া বিভিন্ন গল্প, উপন্যাস, গান এবং পরবর্তীতে সিনেমাতেও জায়গা পেয়েছেন এডওয়ার্ড। অনেকে অভিযোগ তুলেছিলেন এডওয়ার্ডের এই কাহিনি আসলে ভুয়ো।
তবে রয়্যাল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত তারও আগেকার একটি গবেষণা পত্রই প্রমাণ দেয়, বাস্তবেই অস্তিত্ব ছিল এডওয়ার্ডের।
মজার বিষয় হল, ইন্টারনেট সার্চ করলে আজ এডওয়ার্ডের যে-সমস্ত ছবি পাওয়া যায়, সেগুলি একটিও তার ছবি নয়। বরং, চিকিৎসকদের বর্ণনা অনুযায়ী কৃত্রিমভাবে তৈরি করা মূর্তি। তবে এডওয়ার্ড একা নন, তার সমসাময়িক আরও এক ব্যক্তির ক্ষেত্রেও দেখা গিয়েছিল এই বিরল রোগ।
তিনি মেক্সিকোর প্যাসকুয়েল পিনোন। তবে পিনোনের ক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় মুখটির অবস্থান ছিল ছিল মাথার ওপরে। পাশাপাশি তা ছিল নিষ্ক্রিয়। উপরের জিনিস দেখতে পাওয়া ছাড়া, আর কোনো কাজই করতে পারত না পিনোনের সেকেন্ড ফেস। সেদিক থেকে দেখতে গেলে বিশ্বের ইতিহাসে একমাত্র ‘সক্রিয়’ দু-মুখো মানুষ বলা চলে এডওয়ার্ড মরডেককেই।
এডওয়ার্ডের জন্মের পর পেরিয়ে গেছে প্রায় দেড়শো বছর। প্রশ্ন থেকে যায়, এই দেড়শ বছরেও এ-ধরনের দ্বিতীয় কোনো ঘটনার হদিশ পাওয়া গেল না কেন? না, হদিশ পাওয়া যায়নি—এ কথা ভুল।
২০১৪ সালে ভারতের রাজধানী দিল্লিতেই জন্ম নিয়েছিল এমনই এক শিশু লালি সিং। তার মাথাতেও ছিল চারটি করে চোখ-কান এবং দুটি নাক ও মুখ। শুধু ভারতই নয়, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তেই চিকিৎসকদের মেডিক্যাল রেকর্ড উল্লেখ রয়েছে এ ধরনের বহু ঘটনার।
তবে প্রতিটি ক্ষেত্রেই জন্মের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয়েছে সদ্যোজাত শিশুটির। সেখানে দাঁড়িয়ে এডওয়ার্ড বেঁচে ছিলেন ২৩ বছর! চিকিৎসকরা এই রহস্যের সমাধান খুঁজে বের করতে পারেননি আজও।
এসডব্লিউএসএস/১১১০
আপনার মতামত জানানঃ